জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও আন্তঃক্যাডার বৈষম্য
শামসুল আলম সেলিম
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতিদমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা প্রদান করেন। সে মোতাবেক গত ৪ অক্টোবর তারিখে পাঁচটি কমিশনের সদস্যদের নাম ঘোষণা করে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে ৭ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনে প্রধান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দুইজন সাবেক সচিব, সংশ্লিট মন্ত্রণালয়ের একজন বর্তমান সিনিয়র সচিব, দুই জন সাবেক অতিরিক্ত সচিব, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সাত সদস্যের মধ্যে ছয়জনই ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। কমিশনে আমলাদের বাইরে ছিলেন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের একজন সাবেক চেয়ারম্যান । বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে বর্তমানে ২৬টি সার্ভিস ক্যাডার; কিন্তু প্রশাসন ব্যতীত অপর ২৫টি ক্যাডারের কোন সাবেক বা বর্তমান কর্মকর্তাকে ঐ সংস্কার কমিশনে না রাখায় গত ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যদের প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপরে গত ২৪ অক্টোবর উক্ত কমিশনকে পুনর্গঠিত করে আরও তিনজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন তিনজন সদস্য বিসিএস (স্বাস্থ্য)(অবসরপ্রাপ্ত), বিসিএস (অডিট একাউন্স) (অবসরপ্রাপ্ত) এবং বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) (অবসরপ্রাপ্ত) ক্যাডারের। এ নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সংখ্যা ১১ জনে উন্নীত হয়েছে।
অন্তর্র্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের পদোন্নতি ও পদায়ন সংক্রান্ত বৈষম্য দূরীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পুনর্গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কর্তৃক সকল সার্ভিসের দুর্বলতা বিশেষ করে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণ করে সব ক্যাডারের সমতা ও ভারসাম্য আনয়ন অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের মধ্যে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দীর্ঘদিনের এবং বিগত দুই দশকে তা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। প্রকৃচি (প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক)- বিসিএস সমন্বয় কমিটি ও ক্যাডার সংগঠনগুলো ১৯৭৮ সাল থেকে সেসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিরসনের দাবিকরে আসছেন। তারা ২০১৫ সালেও উপজেলা পরিষদ ম্যানুয়াল সংশোধিত আইন এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সম্মেলন, মানববন্ধন, প্রতিবাদসভার মত সব কর্মসূচি পালন করেন। সম্প্রতি কর্মকর্তাগণ ‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার’ শ্লোগান, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের ব্যানার ও দাবীদাওয়া সম্বলিত ফেসবুক প্রোফাইলের ছবিতে ধারণ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, একই পরীক্ষায় সাক্ষাৎকার, একই দিনে যোগদান করে সিভিল সার্ভিসের কেউ সিনিয়র সচিব হন আর কোন ক্যাডারের কর্মকর্তা দুই থেকে চার ধাপ নিচে থেকে যান। অনেকে চাকরি জীবনের ১৫-২০ বছরে শুধু একবার পদোন্নতি এমনকি পদোন্নতি ছাড়াই ৬ষ্ঠ বা ৭ম গ্রেডে অবসরে চলে যেতে হয় প্রচলিত এ নিয়ম চরম বৈষম্যমূলক ও লজ্জাজনক। উদাহরণস্বরূপ প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার পদোন্নতি পেয়ে সর্বোচ্চ পদ সিনিয়র সচিব হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদই ৩ নম্বর গ্রেডের। তারপরও চিকিৎসকের মত মেধাবী ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের মধ্যে ৫ শতাংশও সমস্ত চাকরি জীবনে সেই ৩ নম্বর গ্রেডে যেতে পারেন না। শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ অধ্যাপক পদটি আরও নিচে অর্থাৎ ৪ নম্বর গ্রেডে। এসব ক্যাডারের নিয়োগ, বদলি, পদায়নসহ নীতি নির্ধারণী সর্বোচ্চ পদগুলো সব প্রশাসন ক্যাডারের দখলে।
উপমহাদেশে লুটেরা ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করার জন্য বৃটিশেরা ক্যাডারপ্রথা তৈরি করেছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া ক্যাডর প্রথা পৃথিবীর কোথাও কোন উন্নত দেশ এমনকি এই প্রথার উদ্ভাবক খোদ বৃটেনেও নেই। এই ব্যবস্থা বর্তমান জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জনমানুষের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্যের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের অরাজনৈতিক ও স্থায়ী অংশ হলো জনপ্রশাসন। এটি শুধু প্রশাসন ক্যাডার নয়, মূলতঃ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ২৬টি ক্যাডারের সমষ্টি। প্রশাসন ক্যাডারের সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। তারা যেসব কাজ করে থাকেন তার জন্য বাকি ২৫ টিক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই সুনির্দিষ্ট কর্ম এবং পেশাগত ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। এর মধ্যে টেকনিক্যাল ক্যাডার সমূহের কর্মকর্তাদের রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কাজেই দেশের খাত ভিত্তিক বা সেক্টরওয়াইজ উন্নয়ন মূলত সংশ্লিষ্ট ২৫টি ক্যাডারই করে থাকে। প্রশাসন ক্যাডার আরও কিছু কাজ করে যেগুলো প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় সরকারের। সদ্য সাম্প্রতিক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং জনপ্রতিনিধিগণের কারণে বেশ কিছু কাজ প্রশাসন ক্যাডারের কাছে চলে গিয়েছে। উপজেলা পরিষদের কর্তৃত্বও এখন অনেকাংশে উপজেলা প্রশাসনের হাতে ।
রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী রাজনৈতিক নেতৃত্ব অংশের অদক্ষতা ও দেউলিয়াত্বের কারণে সরকার অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আমলানির্ভর বা প্রশাসন ক্যাডার নির্ভর হয়ে পরে। বিগত ১৫ বছরে অবশ্য পুলিশ ক্যাডারও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সদ্য সাম্প্রতিক সরকারের সময় প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার প্রাধিকারভুক্ত। এই দুটি ক্যাডারের কর্মকর্তা সঙ্গে থাকলে সরকারের যেন আর অন্য কোনো ক্যাডার লাগেনা। অনিয়ম দুর্নীতি, বিনা ভোটে নির্বাচন আয়োজন আর ভিন্নমত বা বিরোধী দলকে দমনের উদ্দেশ্যে পুলিশ ক্যাডারে উপর নির্ভরতা বেড়েছে। পুলিশ ক্যাডারও বিগত ১৫ বছরে তাদের নিজেদের অবস্থানের উন্নতি করতে পেরেছেন।
প্রশাসন ক্যাডারের হাতে নিয়ম তৈরি এবং পদোন্নতি নির্ভর করায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য বেড়েছে। এই ক্যাডার নিজেদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এমনকি অস্বাভাবিক সুযোগ গ্রহণ করেছে। ২০০৬ সাল থেকে নির্ধারিত পদের বাইরে ’সুপারনিউমারি’ পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, হয়েছে ‘সুপারশেসন’ । চেয়ার বা পদের অতিরিক্ত এবং ‘ইনসিটো’ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ডিএস পুলে কোটার কারণে সবচেয়ে বেশী সুবিধা পাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডার।
প্রশাসন ক্যাডার অন্যান্য ক্যাডার থেকে আরও কিছু বাড়তি সুবিধা ভোগ করে । যেমন শুধু তাদের ক্যাডারের ৫ নম্বর গ্রেডের উপসচিবদের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য সুদমুক্ত ৩০ লাখটাকা ঋণ দেওয়া হয়। এছাড়া, গাড়ির চালক, তেলের খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ আরও মাসিক ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। সরকারের এমন বিশেষ সুবিধা অন্যান্য সকল ক্যাডারের ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তাদের ওপাওয়া উচিত।
যদিও সব ক্যাডার থেকেই উপসচিব বা তদূর্ধ্ব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কিন্তু সুফল ভোগ করেছে শুধু প্রশাসন ক্যাডার। সাম্প্রতিককালে গ্রেডেশন, জ্যেষ্ঠতা সব লঙ্ঘন করে অনৈতিক ও অস্বচ্ছভাবে ব্যাপক হারে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। লাগামহীন পদোন্নতিতে একস ময়ের (২০১৫সাল) পরিসংখ্যান হয়ে দাঁড়ায় ঃ অতিরিক্ত সচিব ১০৮ টি পদের বিপরীতে ৪৩৭ জন, যুগ্ম সচিব ৪৩০ টি পদের বিপরীতে ৯৩২ জন এবং উপসচিব ৮৩০ পদের বিপরীতে ১২৮৮ জন। সেসময় অন্যান্য ক্যাডার ও ফাংশনাল সার্ভিসে ৫ম ও তদূর্ধ্ব গ্রেডগুলোতে পদশূন্য থাকা সত্তেও¡ পদোন্নতি হয় নাই এমনকি তারা উচ্চতর গ্রেডও পান নাই।
প্রশাসন ক্যাডার থেকে বিভিন্ন অধিদপ্তর, সংস্থা বা কর্পোরেশনে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয় । ফলে একদিকে যেমন ঐ সংস্থা বা অধিদপ্তরের অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তাগণ পদোন্নতি বঞ্চিত হন তেমনি নিযুক্ত বহিরাগত কর্মকর্তার সংস্থাটির মৌলিক কাজ সম্পর্কে পূর্ব ধারণা বা দক্ষতা না থাকায় তার স্বল্প কর্মকালীন সময়ে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারেন না।
রাষ্ট্রে বিভিন্ন সংবিধানিক কমিশন বা অনুরূপ সংস্থা গুলোতে কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই পছন্দমাফিক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে নিয়োগপ্রাপ্তরা সংস্থায় প্রভাব বিস্তার করেন । অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ অপচয় ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ধরনের নিয়োগ স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক হওয়া জরুরি।
জনপ্রশাসনে সুযোগ সমতার সাথে ক্ষমতারও ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। নবগঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের সাথে অন্য ক্যাডারগুলোর বৈষম্য দূরীকরণের জন্য নি¤œলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে ঃ
১। সম্ভব হলে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের এই ক্যাডারপ্রথা বাতিল করা ।
২। প্রশাসন ক্যাডারের প্রভাবমুক্ত রেখে সুনির্দিষ্ট কর্ম ও পেশাভিত্তিক ২৬ ক্যাডার সার্ভিস গুলোকে শক্তিশালী করা। একইসাথে বিসিএস (্সচিবালয়) ও বিসিএস (ইকোনোমিকস) পুনরজ্জীবিত এবং আলাদা বিসিএস (ভূমি ও রাজস্ব) সার্ভিসচালু করা।
৩। মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত সকল পর্যায়ে সংশি¬ষ্ট ক্যাডারের নিজস্ব কর্মকর্তাদের পদায়ন করা। সেই সাথে বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সকল ক্যাডারের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রাখা।
৪। প্রজাতন্ত্রের নিয়মিত পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ রোধে আইন করা।
৫। ডিএসপুলের কোটা বাতিল করা এবং সকল ক্যাডারের সুযোগ নিশ্চিত করা।
৬। উপজেলা পরিষদের কর্তৃত্ব পূনঃপ্রতিষ্ঠা করে চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধি এবং বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সক্রিয় প্রতিনিধিত্ব জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
৭। নিজস্ব ক্যাডার ও ফাংশনাল সার্ভিসবহির্ভূত প্রেষণের নিয়ম বাতিল করে সংস্থাগুলোকে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। কমিশন, বোর্ড বা সংস্থাগুলোতে স্বচ্ছভাবে এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করা।
৮। সকল ক্যাডার এবং ফাংশনাল সার্ভিসে পদোন্নতি ও নিয়ন্ত্রণের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা।