নিমগাছিতে সুচিত্রা সেনের প্রেমিক

Spread the love

আব্দুল কুদ্দুস তালুকদার  

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি  মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের গোঁড়া অন্ধ-ভক্ত তথা প্রেমিক সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধামাইনগর গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। বাসা তার নিমগাছির ধামাইনগরের মির্জাপুর প্রাইমারী স্কুলের সামনে পাকা রাস্তার পূর্বপাশে। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আজো তার প্রিয়া প্রয়াত সূচিত্রা সেনকে  নিয়মিত স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নের নায়িকাকে সে তার ভালবাসার কথা জানায়, জবাবে তার হৃদয় সিংহাসনের রানী তাকে ধৈর্য ধরে প্রতীক্ষা করতে বলেন। এজনমে তাকে পাবে না হাবিবুর রহমান; তবে পরজনমে অবশ্যই তার “দিদি” তাকে বুকে টেনে নেবেই- এই আশা নিয়ে দিন গুজরান করেন তিনি। এ ব্যাপারে স্বপ্নে তাকে ওয়াদা করেছেন মহানায়িকা – জানান হাবিবুর। হাবিবুর পেশায় দর্জি, সামান্য জমি আছে। দুই ছেলে, দুই মেয়ে তার। সবার বিয়ে দিয়েছেন।

এখন বয়সের ভারে আর কাজ করতে পারেন না। ধামাইনগরে বাড়ী করেছেন দেশ স্বাধীনের তিন বছর পর। তার জন্ম সিরাজগঞ্জের শহরতলী ভাংগাবাড়ী এলাকায়। পিতার নাম শুক্কুর আলী। ছোটবেলায় বা যুবক বয়সে তিনি দর্জির দোকানে কর্মচারী ছিলেন শহরে। টাউনের লক্ষী সিনেমা হলের গেটম্যান ছিল তার পড়শী ও বন্ধু। ফলে পয়সা লাগতো না তার ছবি দেখতে। নিয়মিত সে সন্ধ্যার পর দোকানের কাজ সেরে হলে প্রবেশ করতো বিশেষ করে শেষ পর্বে বা নাইট শোতে। ঐ সময়ে সুচিত্রা সেনের যে সব ছবি হলে আসতো তা মিস করতেন না কোনো মতেই। এ ছাড়া অন্যান্য ছবিও দেখতেন। তাতেই ভক্ত হয়ে যান তিনি প্রচন্ডভাবে তার প্রিয় নায়িকার। আজো তিনি এত বছর পরেও সুচিত্রা সেন অভিনীত প্রায় সকল ছবির গান শুনলেই বলে দিতে পারেন কোন্ দৃশ্যে ঐ গান গাওয়া,  এছাড়া ছবির কাহিনীও। আমার(লেখকের) দোকানে তিনি মাঝে মাঝে আসেন। নানা কথা বলি সুচিত্রা প্রসংগে।

লেখা পড়া তেমন জানেন না তিনি।  আমি তাকে পরীক্ষা করার জন্য কিছু গান শোনাই আমার ফোনের ইউটিউব হতে। যেমন – ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত, আসেনি তো বুঝি আর ; জীবনে আমার.. তিনি শুনেই বললেন, এটা সবার উপরে ছবিতে সুচিত্রা সেন গায় খুনের মামলায় জেলে আটক বাবার মামলার  কিনারা করতে আসা আশ্রয়হীন নব্য উকিল উত্তম কুমারকে তার মেসে আশ্রয় দিয়ে আপন বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে নিজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এরপর শোনাই – তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার, কানে কানে শুধূ একবার বলো তুমি যে আমার.. শুনে তিনি জানালেন, গানটি হারানো সূর ছবিতে সুচিত্রা সেন শোনান উত্তম কুমারকে গেয়ে শোনায় তাদের বাসর রাতে এবং যখন উত্তম কুমার স্মরণশক্তি হারিয়ে ভুলে যায় সুচিত্রাকে তখন উত্তমের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে চাকরী নিয়ে তার স্মৃতি ফিরে পেতে ; দু’বার গানটি শোনে দর্শক একই ছবি দেখতে বসে । তারপর শোনাই – এ শুধূূ গানের দিন এ লগনও গান শোনাবার, এ তিথি শুধূ গো যেন দখিন হাওয়ার.. গানের খানিক শুনেই তিনি হেসে বললেন, এটা পথে হলো দেরী ছবিতে মল্লিকা ওরফে মলির ভূমিকায় অভিনয় করা মহানায়িকা সূচিত্রা সেন গেয়ে শোনায় জয়ন্ত ডাঃ রূপী উত্তম কুমারকে তার সাথে পাহাড়ে উঠে নিরিবিলিতে গোপন প্রেম পর্বের চুড়ান্ত অভিসার পর্যায়ে এবং পাহাড় থেকে নেমে বাসার গেটে ফিরে ধরা পড়ে তার দাদু ছবি বিশ্বাসের হাতে । এবারে শুনেন তিনি – এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো… শুনে বললেন, এ গান সপ্তপদী ছবির। এটা যুগল গান। উত্তম কুমার ও এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ড্রেসে সুচিত্রা সেন দু’ জনেই  হোন্ডায় চড়ে লং জার্নিতে টুরে গিয়ে গায় রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে বাঁক নিতে নিতে। এবার শোনাই – এই মধূ রাত শুধু ফুল পাপিয়ার, এই মায়া রাত শুধূ তোমার আমার..  গানটি শুনে তিনি জানালেন, এটা সাগরিকা ছবিতে সুচিত্রা সেন গায় গবেষনাগার দূর্ঘটনায়  অন্ধ বিলাত ফেরত ডাঃ অরুনাংশ মৈত্র ওরফে অরূন রূপী  উত্তম কুমারকে তার নিজ বাড়ীতে আশ্রয় দিয়ে বিছানায় শুইয়ে তাকে ঘুম পাড়াতে। এবার আরও  তাকে একটা গান শোনাই। তা হলো — তুমি না হয় রহিতে কাছে,  আরও কিছুক্ষণ না হয় রহিতে কাছে। আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে.. শুনে তিনি বললেন, এটা পথে হলো দেরী ছবিতে গায় সুচিত্রা সেন যখন ডাঃ বেশী উত্তম কুমার রোগী রূপী সুচিত্রাকে দেখে তার দাদুর প্রাসাদোপম বাড়ীর দোতলা থেকে নেমে আসতে থাকে। উত্তম কুমার নীচ তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে মন দিয়ে শোনে গানটি। এবার তাকে শোনালাম গান – নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড় ; এমন বলাকা মোর অজানার আহবানে চঞ্চল পাখা মেলে ধরো.. শুনে তিনি জানালেন এটা ইন্দ্রানী ছবির গান। সুচিত্রা সেন ভালবেসে বিয়ে করে উত্তমকে। ভাই – ভাবীগন বেকার উত্তমকে নানা কথা বললে সে বউ নিয়ে বাড়ী ছেড়ে ছোট একটা ভাড়া বাড়ীতে ওঠে পড়ে। বাড়ীটা বেজায় ছোট মন্তব্য করে সুচিত্রা। এতে একটু পরেই দুজনে মিলিত কন্ঠে গায় এই গান, পরিবেশ ফ্রি করার জন্য। সবশেষে একটা বিষাদের গান শোনাই তাকে। তা হলো – কে তুমি আমারে ডাকো, অলোকে লুকায়ে থাকো ; ফিরে ফিরে চাই, দেখিতে না পাই.. শুনে বললেন, এটা অগ্নি পরীক্ষা ছবির গান। উত্তম কুমার দেখা করতে আসে সুচিত্রার সাথে তার বাসায়। গাড়ী বারান্দায় এসে গাড়ীতে বসেই  নামার আগে এই গান তিনি শুনতে পান, দোতলায় গাইছে সুচিত্রা আপন মনের দ্বিধায় পড়ে। কারণ, সুচিত্রার বিয়ে হয় বাল্যকালে। কিন্তু যার সাথে বিয়ে হয় সে কোথায় হারিয়ে গেছে জানে না সুচিত্রা। এদিকে তার সিরিয়াস নিবিড় প্রেমপর্ব চলছে তখন উত্তম কুমারের সাথে। মনের দোটানায় পড়ে সে। এমন আরও বেশ কিছু গান তাকে শোনালে আমায় অবাক করে দিয়ে সঠিক উত্তর দেন তিনি সব প্রশ্নের ।

প্রায়ই তার বাড়ীর সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করি।  কিন্তু সময় অভাবে যাওয়া হয়নি তার বাসায়। কয়েকদিন আগে আমার সূহৃদ বিশিষ্ট উপন্যাসিক, কবি, সাংবাদিক ও নিমগাছি অনার্স কলেজের টিচার আলহাজ্ব এম এ হাশিম সরকার মনিকে সাথে নিয়ে হাবিবুরের বাড়ী যাই। গিয়ে দেখলাম, অতি দরিদ্র পরিবার। হাবিবুর জানালেন, গাভীর দুধ বেচে তার সংসার চলতো কোনমতে। কিন্তু চোরেরা চুরি করে নেয় তার গরু। জানা গেল, প্রায় ১৫ বছর হলো তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্য ঘরে থাকে। কারণ, প্রায় সারা রাত ঘুমের ঘোরে সুচিত্রার সাথে কথা কয় হাবিবুর। তাই তার বউ বিরক্ত হয়ে তাকে ফেলে স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েকে নিয়ে পাশের ঘরে রাত কাটায়। হাবিবুরের নিজের মাটির দেয়ালের ঘরে একটা ছোট চৌকির অর্ধেক পাতলা একটা কাঁথা বিছানো, আর বাকীটুকু ফাঁকা তক্তা মাত্র। ঐ তার বেড বা বেডরুম কিংবা শয়নমন্দির। ছোট একটা বালিশও আছে বটে কাঁথার উপর। আমাদের বসতে বললেন। তবে বসার মত জায়গা না পেয়ে মিনিট খানেক পরে চলে আসি যা দেখার তা দেখে। আমিও সূচিত্রা ভক্ত বটে এবং তার অভিনীত বেশ কিছু ছবি আমারও দেখা ; আর সেকারণেই আমি প্রায় ৩০ বছর আগে ভিসিআর কিনি, পরে সিডি সেট শুধূমাত্র সুচিত্রা – উত্তমের ছবি দেখার জন্য বলা চলে, যে সেট ক্যাসেটগুলোসহ আমার আলমারীতে পড়ে আছে আজো অচল হয়ে । ভালবাসার প্রকাশ হিসেবেই হয়তো মহানায়িকার একটা ছবি এনলার্জ সাইজ করে বাঁধিয়ে আমার দোকানের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম কয়েকশ টাকা ব্যায়ে তার মহাপ্রয়াণের পর পরই। ঐদিন হাবিবুরকে ওটা দিয়ে এলাম উপহার। হিসাব করে দেখলাম, আমার চেয়ে সূচিত্রা সেনের প্রতি তার ভালবাসার ভোল্টেজ হাজার গুন বেশী। তাই ওটা তারই প্রাপ্য, থাকুক তার কাছেই। হোক সে দীন-হীন। তার পায়ে আমি জুতা দেখিনি কোনদিন। হয়তো কেনার শক্তি নেই বা প্রয়োজন বোধ করেন না।  ভারতবর্ষের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজীর গায়ে জামা – গেঞ্জী নেই বা ছিল না জীবনের শেষ ভাগে বেশীর ভাগ সময়। তাতে  সন্মান মর্যাদা কমে গেছে কি তাঁর ?

 

 

 

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD