ভাঙ্গুড়ায় ঘুষ দিতে না পারায় মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বন্ধ

Spread the love

ভাঙ্গুড়া প্রতিনিধি : মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রথম প্রহরে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মকবুল হোসেন। এরপর পর্যায়ক্রমে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিট, উপজেলা প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সহ প্রায় অর্ধশতাধিক সরকারি ও বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এইদিন স্মৃতিসৌধের অদূরে দাড়িয়ে সকল আনুষ্ঠানিকতা দেখে নীরবে কাঁদছিলেন ৬৮ বছর বয়স্ক হতদরিদ্র যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী। ওমর আলীর বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার মন্ডতোষ গ্রামে।
এ সময় ওমর আলীর সাথে কথা বললে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘দেশের জন্য জীবনবাজি রাইখা যুদ্ধ করছিলাম। এখন আমাকে না খাইয়া থাকতে হয়। পরণের জামাটা মানুষের দেয়া। বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমাকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিছিল। ভাতার ট্যাহায় দুই বছর বৌ আর এক মেয়েরে লইয়া সুখেই ছিলাম। এহেনকার কমান্ডার মোকছেদ আলীরে তিন লাখ টাহা না দিবার পাইরা সেটাও চার বছর ধরে বন্ধ হয়া গেছে। এখন রিলিফ ছাড়া কিছু পাইনা। আমরা খামু কি?’
যুদ্ধকালীন সময়ে ওমর আলীর কমান্ডার এস এম মোজাহার আলী ও সহযোদ্ধা সিকান্দার আলী জানান, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পাবনার চাটমোহর উপজেলায় পাকিস্তানী ক্যাম্পে ওমর আলী সাত দিন প্রশিক্ষণ নেন। পরের মাসে চাটমোহরের ডেঙ্গার রেল ব্রিজে ডিউটির সময় তিনি কৌশলে পাঁচটি রাইফেল নিয়ে পালিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর থেকে ওমর আলী পাবনার চাটমোহর উপজেলার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মোজাহার আলীর নেতৃত্বে তাড়াশের নওগাঁ, চাটমোহর রেলস্টেশন, সিংগাইর রেলসেতু ও নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে চাটমোহর থানা ও ডাকবাংলো আক্রমণকালে পাকসেনাদের একটি গুলি ওমর আলীর মাথায় লাগে। এতে পড়ে গিয়ে তার কোমর ভেঙ্গে যায়। দীর্ঘদিন মুক্তিবাহিনীর তত্বাবধানে চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে বাকি জীবন চলতে হচ্ছে তাকে খোঁড়া হয়ে।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী জানান, পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে তিনি অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করেন। কিন্তু শারীরিক কার্যক্ষমতা কম থাকায় মজুরি কম পেতেন তিনি। তাই স্ত্রী ও এক কন্যাকে নিয়ে কোনমতে তার সংসার চলত। এরপর ২০০৩ সালে তিনি ভাতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এতে ২২/১১/২০০৫ইং তারিখে প্রকাশ হওয়া সরকারি গেজেটে ওমর আলীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয় (নং-১৬৮৩)। পরে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে গেজেটভুক্তদের ভাতা প্রদান শুরু হলে ২০১৩ সালের জুলাই মাস থেকে তিনি ভাতা পাওয়া শুরু করেন। ভাতার টাকায় চায়ের দোকান দিলে তার সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসে। এরপর ২০১৫ সালে উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে রহস্যজনকভাবে ওমর আলীর নাম বাদ পড়লে তার ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ভাতা বন্ধ হওয়া সকলে পুনরায় ভাতা পেতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে আবেদনকারীদের মধ্যে ওমর আলীকে সঠিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মতামত প্রদান করা হয়। এই চিঠি নিয়ে ওমর আলী তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উ¤ুল বানীন দূত্যি ও উপজেলা কমান্ডার মোকছেদ আলীর কাছে কয়েকবার আবেদন করেন। কিন্তু মোকছেদ আলীর চাহিদা মোতাবেক তিন লাখ টাকা ওমর আলী দিতে না পারায় তিনি ভাতা পাননি। গত এক বছর ধরে উপজেলা কমান্ড ইউনিটের মেয়াদ শেষ হয়ে পুনরায় কমিটি গঠন না হলে হতাশ হয়ে ওমর আলী আর কারো কাছে ভাতার জন্য তদবির করেন না। এখন সময় পেলেই দুঃখ ভরা মন নিয়ে তিনি স্মৃতিসৌধের সামনে গিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে কাঁদেন।
অর্থ না পেয়ে যাচাই-বাছাই কমিটিতে ভাতা বন্ধ করার অভিযোগের বিষয়ে তৎকালীন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিটের কমান্ডার মোকছেদ আলীকে একাধিকবার ফোন করলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
এ বিষয়ে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাছুদুর রহমান বলেন, ‘ভাতা বন্ধের ব্যাপারে ওমর আলী নামে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে আসেনি। তাই বিষয়টি আমার জানা নেই। বিস্তারিত জানলে বিষয়টি দেখা যাবে।’

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD