তাড়াশে তালাক যেন মামুলী ব্যাপার

Spread the love

এম.আতিকুল ইসলাম বুলবুল, তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ)ঃ

মাধাইনগর ইউনিয়নের গুড়মা গ্রামের উত্তর পাড়ার মো. শহিদুল ইসলামের মেয়ে পূর্নিমা খাতুন (১৭) এবং একই গ্রামের পশ্চিম পাড়ার মুনজিল হোসেনের ছেলে রাসেল হোসেন (২১) প্রেম করেছিলেন প্রায় দুই বছর। তারপর ২০২৩ সালের মে মাসের দিকে দু’পরিবারের অসম্মতিতে দু’জনে বিয়েও করেন। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই স্বামী-স্ত্রী’তে বনিবনা না হওয়ায় সংসারে বাঁধে চরম কলহ, অশান্তি। দু’জনে সিদ্ধন্ত নেন বিয়ে বিচ্ছেদ বা তালাকের। তাদের তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়ে এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তি এবং দুই পরিবারের অভিভাবকরা সালিশ করেন। পরে কাবিন, খোরপোশসহ স্বামীর কাছ থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকাও বুঝে নেন পূর্নিমা। তারপর কাজী অফিসে গিয়ে তালাক নামায় দু’ জনেই স্বাক্ষর করে বাড়ি চলে যান। বাড়ি এসে এক পর্য্যায়ে তালাকের ২২ ঘন্টা পর গত বুধবার দুপুরে বাবার বাড়ির শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘরের আড়ার সাথে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আতœহত্যা করে প্রেমের জ্বালা মেটান গৃহবধূ পূর্নিমা খাতুন।এভাবেই সিরাজগঞ্জের তাড়াশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও তালাকের ভয়াবহতা বাড়ছে। পাশাপাশি তালাক নিয়ে ঘটছে নানা অঘটন। যা কিছু প্রকাশ্যে এলেও বেশির ভাগ অপ্রকাশিতই থাকছে।

উপজেলার মাইনগর ইউনিয়নের নিকাহ্ রেজিষ্টার এবং তাড়াশ উপজেলার নিকাহ্ রেজিষ্টার সমিতির সভাপতি মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, তালাক যেন এখন “মামুলী ব্যাপার” হয়েছে গেছে। কেননা, মাধাইনগর ইউনিয়নে গত ২০২৩ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে ৮৫টি। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত হয়েছে ৩৩ টি। এর মধ্যে ২০২৩ সালে তালাকের ৮৫টি ঘটনার মধ্যে ৩৮ টিই তালাক দিয়েছেন স্ত্রী নিজেই স্বামীকে। আর তালাকের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানা হচ্ছে না রাষ্ট্রীয় বা ধমীয় আইনের কোনটাই।

অবশ্য, ইসলামে তালাক সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তালাক তিন প্রকার। রাজি তালাক। অথাৎ স্বামী-স্ত্রী দু’ জনের সম্মতিতে। রজিয়া তালাক বা স্ত্রীর পক্ষ থেকে মোহরানা পরিশোধ করে স্বামীকে তালাক। বায়ানে তালাক হলো স্বামী স্ত্রীকে মোহরানা পরিশোধ করে তালাক।

নিকাহ্ রেজিষ্টার সমিতির সভাপতি মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ আরো জানান, গত দেড় বছরে মাধাইনগর ইউনিয়ন এলাকায় তালাকের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখেছেন, দরিদ্র পরিবারের বাল্য বিয়ের শিকার, বয়স না হওয়ায় বিয়ের অর্থ না বোঝা, প্রেম করে বিয়ে করা, মোবাইলে পরকিয়ায় আসক্ত কম বয়সি অশিক্ষিত বিয়ে বিচ্ছেদি নারী-পুরুষেরদের হার সবচেয়ে বেশি। যা চরম সামাজিক অবক্ষয়।

তা ছাড়া কাজী অফিসে এসেই যে স্বামী স্ত্রী তালাক দেন এটাও ঠিকনা। এ সংখ্যার বাহিরেও বহু তালাক হচ্ছে। যেমন- কাজী অফিসে বাহিরে পারিবারিকভাবে, গ্রাম্য সালিশে তালাকের ঘটনাও অনেক। কারণ কাজী অফিসে ফি দিতে হয় বা আইনী রেবর্ড থাকে। এ সকল ঝামেলা ও মান-সন্মানের ভয়ে অনেকেই বাড়িতেই মুখে মুখে তালাক দিয়ে কাবিন বা খোরপোষের টাকা কম বেশি করে মিমাংসা করে নেন। যা আমাদের রেকর্ডের বাইরে থাকে বলে জানান তাড়াশ সদর ইউনিয়নের কাজী মো. তাসাদ্দেক।

মুলত তালাকের আইনসিদ্ধ প্রত্রিয়া হলো- কাজী অফিসে বিয়ে বিচ্ছেদ বা তালাকের প্রক্রিয়ায় প্রথমে তালাকের জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই লিখিত আবেদন করতে হবে। আবেদন পত্রে তাদের নাম, ঠিকানা, বিয়ের তারিখ, দেন মোহরানার পরিমাণ, তালাকের কারণ ইত্যাদি উল্লেখ থাকতে হবে। আবেদনের সাথে ন্যায়পরায়ণ দু’ জন সাক্ষির স্বাক্ষর থাকতে হয়। স্বামী-স্ত্রী’র জাতীয় পরিচয় পত্র, দুই কপি ছবি জমা দিতে হবে। সংশ্লিট কাজী অফিসে নির্ধারিত পরিমাণ ফি দিতে হবে। যা অনেকেই মানেন না বলেই প্রকৃত তালাকের সংখাও না পাওয়ার অন্যতম কারণ মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

তারপরও রেকর্ডমূলে তাড়াশ উপজেলায় আটটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌর এলাকার মধ্যে তাড়াশ পৌর এলাকা ও ৬ ইউনিয়নের নিকাহ্ রেজিষ্টাদের কাছ থেকে ১ বছর ৬ মাসের তালাকের প্রাপ্ত চিত্র বেশ ভয়াবহ। যেমন- তাড়াশ পৌরসভা এলাকায় নয়টি ওয়ার্ডে ২০২৩ সালে মোট ৭৮ টি বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। ২০২৪ সালে জুন পর্যন্ত হয় ৩৫ টি। তাড়াশ সদর ইউনিয়নে ২০২৩ সালে মোট ৩৯ টি বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। ২০২৪ সালে হয় ৩১ টি। বারুহাঁস ইউনিয়ন এলাকায় ২০২৩ বিয়ে বিচ্ছেদ ৩২টি। আর ২০২৪ সালে হয় ২৭ টি। সগুনা ইউনিয়ন এলাকায় ২০২৩ বিয়ে বিচ্ছেদ ১১টি। আবার ২০২৪ সালে হয় ০৮ টি। মাধাইনগর ইউনিয়ন এলাকায় ২০২৩ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ ৮৫টি। আর ২০২৪ সালে হয় ৩৩ টি। মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নে ২০২৩ সালে ৫৬ টি। ২০২৪ সালে ৩০ টি বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। পাশাপাশি তালম ইউনিয়নে ২০২৩ সালে হয় ৫৩ টি। ২০২৪ সালে হয় ২৫ টি। অথাৎ ২০২৩ সালে ১ টি পৌর ও ৬টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে তালাক হয় মোট- ৩৫৪ জন স্বামী- স্ত্রীর। আর ২০২৪ সালের ৬ মাসে তালাক হয়েছে মোট ১৮৯ জনের।
তালম ইউনিয়ন এলাকার কাজী আবুল কাসেম বলেন, তিনি এ পেশায় আছেন, প্রায় দুই দশক। আর কর্ম জীবনের শুরুতে প্রথম ১০ বছরে তালম ইউনিয়নে এত তালাক দেখেননি যা সাম্প্রতিক ৭ থেকে ৮ বছরে যতগুলো তালাকের ঘটনা ঘটেছে।
এর সত্যতা পাওয়া যায় তাড়াশের বাসিন্দা যিনি ৪২ বছর যাবত আইন পেশায় রয়েছেন। তিনি হলেন সিরাজগঞ্জ জজ কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবি এ্যাডভোকেট মো. রফিকুল ইসলাম বাটুল। তিনি জানান, জেলার আদালত গুলোতে গ্রাম এলাকার যে মামলা হয় তার প্রায় ৮০ ভাগই স্বামী স্ত্রীকে মারধর করেন, তাদের বনিবনা হচ্ছে না বা যৌতুক চান এ ধরনের। আর তাড়াশ উপজেলা এলাকার আদালতে মামলাগুলোর বেশির ভাগের ধরণ একই। তাই এ সব ঘটনায় তালাকের হারও বাড়ছে তাড়াশ এলাকায়ও।
তালম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল খালেক বলেন, তালম ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে বিচারের জন্য যে বিষয়গুলো আসে তার মধ্যে তালাকের বিষয়ও অনেক থাকে। আর গ্রাম আদালতে তালাক সংক্রান্ত বিষয়গুলো যারা নিয়ে আসেন সে সকল স্বামী-স্ত্রীর বয়স ১৬ থেকে ২৪ এর মধ্যেই বেশি। যারা লেখা পড়া জানে না বললেই চলে। আবার আর্থিক অবস্থায় দিন-মজুর, ভ্যান চালক ইত্যাকার।
এ প্রসঙ্গে তাড়াশ ডিগ্রী কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মো. মেহেরুল ইসলাম বাদল বলেন, সমাজে সু-শিক্ষার অভাব, বাল্য বিয়ের করুণ পরিণতি, যৌতুক দাবী, মারধর, মোবাইলের অপব্যবহার সহ নানা কারণে খুব দ্রুত শিথিল হচ্ছে সামাজিক বন্ধন। আর ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থায় তালাক হার বাড়ছে। যা এখন ছড়িয়ে পড়ার কারণে তালাককে “মামুলী ঘটনার মতোই” মনে করা হচ্ছে। তালাক নিয়ে এখনই সর্তক না হলে গৃহবধূ পূর্নিমা খাতুনের মত মূল্যবান জীবনের করুণ পরিণতি আমাদের অনেকের জন্য আগামীতে অপেক্ষা করছে।

 

 

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD