মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়ন এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য

Spread the love

মোঃ আনোয়ার হোসেন (সাগর)
মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়ন ঐতিহাসিক চলনবিলের মধ্য অবস্থিত একটি ইউনিয়ন । এটির আয়তন ৪২.৪৬ বর্গ কিলোমিটার । সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, উল্লাপাড়া, নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর, পাবনা জেলার চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া উপজেলার সমন্বয়ে চলনবিল অঞ্চল গঠিত। চলনবিল একটি নিম্নভূমি এলাকা । অতীতকালে এই বিল অনেক গভীর ও অত্যন্ত বিপদ-সংকুল ছিল। অনুমান করা হয় যে, প্রায় ৪০০ বৎসর পূর্বে এই বিলটি রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া জেলার অধিকাংশ স্থান জুড়ে ব্রক্ষপুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলে উত্তর পশ্চিম অংশে বিস্তৃত ছিল। কালের পরিক্রমায় পলি জমে বিলটি ভরাট হয়েছে এবং এর বিভিন্ন চরে গ্রাম গড়ে উঠেছে। অবস্থান, আকৃতি-প্রকৃতি দেখে চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদ-নদী স্নায়ুজালের নাভীকেন্দ্র বললে অত্যুক্তি হবে না। সার্বক্ষণিক বিশাল বিলের পানি চলনমান বা প্রবাহমান থাকার কারণে এই বিলের নাম হয় চলনবিল।এখানে সাইটখাল পাড়ে ২টি হিজল গাছ কালের স্বাক্ষী বহন করে । কথিত আছে বেহুলার নৌকায় নাকি দুই গোলুইতে ২ জন শিশু ছিল। ঝড়ের কবলে নৌকা ডুবে গেলে দুই গোলুইয়ের ২ শিশু থেকে ২টি গাছ জন্মে । যার কারণে চলনবিলে যতই পানি বৃদ্ধি পাক না কেন ঐ গাছ ২টি পানিতে ডোবে না । ৮৮ এর বন্যায়ও ঐ গাছ ডোবেনি ।
অবস্থান: সভ্যতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে গড়ে উঠা ঐতিহ্যবাহী চলনবিলের মধ্যে তাড়াশ উপজেলার অন্তর্গত বিল অঞ্চল হল ৪নং মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়ন পরিষদ। সভ্যতা ও বিবর্তনের হাত ধরে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নে শিক্ষা,সংস্কৃতি,ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও ক্রিড়া সংগঠনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার ঐতিহ্য আজও সমুজ্জল।কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন তথ্য নিম্নে তুলে ধরা হল: আয়তন : ৮৯১৪ একর, মৌজা: ১৩টি, ওয়ার্ড: ৯ টি, গ্রাম: ১৪ টি, লোক সংখ্যা: ২৬৯৬৫ জন, মুসলমান :২৫৭৩৯ জন, হিন্দু: ১২২৬ জন, ভুমিহীন : ১২৭৭ জন, কৃষক :৫৩৭৬ জন, ব্রীজ : ১৯টি, কালভার্ট : ১৭টি, নদী: ১টি, খাল: ৭টি, প,প ক্লিনিক: ১টি, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র: ৩টি, শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র: ৩টি, সরকারী প্রা: বিদ্যা: ৬টি, বেসরকারী প্রা: বিদ্যা: ১০টি, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যা: ৩টি, মাধ্যামিক বিদ্যা: ২টি, মাদ্রাসা: ৪টি, হাট বাজার: ৬টি, মসজিদ: ৩৯টি, ঈদ গাহ: ২১টি, কবরস্থান: ১০টি, মন্দির: ৪টি।
যোগাযোগ ব্যবস্থা : দুই ধরনের যথা : (ক) জল পথ (খ) স্থল পথ। জল পথ : ইউনিয়নের মেধ্যে দিয়ে একটি নদী ও দুইটি খাল প্রবাহিত। তাছাড়া বর্ষা কালে নৌকা যোগে তাড়াশ সদর সহ ইউনিয়নের প্রত্যেটি গ্রামে চলাচল করা যায় ।তাছাড়া আত্রাই নদীর একটি শাখা ইউনিয়নের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পদ্মা ও বড়াল নদীতে মিশেছে। স্থল পথ: ঢাকা – রাজশাহী মহাসড়ক থেকে একটি পাকা রাস্তা ইউনিয়নের ভিতর দিয়ে তাড়াশ উপজেলা সদরে গিয়েছে। এই রাস্তা দিয়ে ইউনিয়নের বেশীর ভাগ মানুষ চলাচল করে থাকে। তাছাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে দিয়ে অনেকগুলি কাঁচা পাকা রাস্তা রয়েছে।
দর্শনীয় স্থানঃ সিরাজগঞ্জ হতে বনপাড়া মহাসড়কের মাঝ পথে অবস্থিত ৮ নং ও ৯ নং ব্রীজ বর্ষাকালে চলনবিলের পর্যটন স্পটে পরিনত হয়। সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য দুর-দুরান্ত থেকে ছুটে আসে হাজারো দর্শনার্থী।তীর ভাঙ্গা ঢেউ আর শীতল হাওয়া দর্শনার্থীর হৃদয় করে ঠান্ডা । মন ভরে উঠে বিলের প্রাকৃতিক শোভায়।

বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ :
১। মরহুম আবু সাইদ: পিতা মরহুম নাসির উদ্দিন, গ্রাম: নাদোসৈয়ধপুর।তিনি তদানিন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের সিএস,পি ছিলেন এবং পাকিস্তান গভর্নর মোনায়েম খানের ভাতিজিকে তিনি বিবাহ করেছিলেন।
২। মরহুম আব্দুল কাদের সরকার : পিতা মরহুম বাবর আলী,গ্রাম নাদোসৈয়দপুর। তিনি তৎকালীন যশোর সরকারী কলেজের একজন খ্যাতিমান প্রিন্সিপাল ছিলেন।
৩।জনাব মোঃ রেজাউল কাদের সরকার: পিতা মরহুম আব্দুল কাদের সরকার, গ্রাম : নদোসৈয়দপুর। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রনালয়ের যুগ্ন সচিব পদে কর্মরত আছেন।
৪। মরহুম জরিপ উদ্দিন সরকার : গ্রাম : হামকুড়িয়া । তিনি তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান আমলে মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রসিডেন্ট ছিলেন।তিনি ছিলেন একজন জনদরদী ব্যক্তি ।
৫।মরহুম ইব্রাহিম হোসেন তালুকদার : গ্রাম দোবিলা। তিনি তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান আমলে মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রসিডেন্ট ছিলেন।তিনি একজন মানবদরদী ব্যক্তি ছিলেন।তিনি ঘোড়ায় চরে যাতায়াত করতেন।
৬। শহীদ ইয়ার মাহমুদ: পিতা কিয়াম আলী, গ্রাম আমবাড়িয়া। তিনি একজন রাজনীতিবিদ,মুক্তিযোদ্ধা,সমাজ সেবক এবং দোবিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
৭। মরহুম খোদা বক্স সরকার: গ্রাম : হামকুড়িয়া। তিন পাকিস্তান আমেলে মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তিনি অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ও একজন বিশিষ্টি সমাজ সেবক ছিলেন।
৮। গাজী ম,ম আমজাদ হোসেন মিলন : গ্রাম : মাগুড়াবিনোদ। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সহসর্বাধিনায়ক ছিলেন। অত্র থানার নওগাঁয় তার দল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ১৫০ জন পাক হানাদার বাহিনীকে হত্যা করে অক্ষত দেহে জয়যুক্ত হয়েছিলেন।তিনি বাংলাদেশ আমলে অত্র ইউনিয়নের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।পরে তিনি তাড়াশ উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি, সম্পাদক এবং সবশেষে তাড়াশ-রায়গঞ্জ এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের নিষ্ঠাবান ভক্ত-অনুসারী ছিলেন।
৯। স ম আব্দুল জলিল: পিতা মরহুম কাজেম সরদার, গ্রাম দোবিলা । তিনি অত্র ইউনিয়নের এবং পরবর্তীতে তাড়াশ উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে অত্র এলাকায় অনেক স্কুল ,কলেজ, মাদ্রাসা এবং অফিস আদালত এবং উপজেলা পরিষদ ভবন গড়ে তোলেন। তাঁর সৌজন্যেই তাড়াশ পেস ক্লাবের প্রথম ভবন নির্মিত হয়।
হাট ও বাজারের তালিকা : দিঘীসগুনা হাট ও বাজার, ঘরগ্রাম বাজার, দোবিলা হাট ও বাজার, মান্নান নগর হাট ও বাজার, হামকুড়িয়া হাট, নাদোসৈয়দপুর হাট ও বাজার।
ভাষা ও সংস্কৃতিঃ মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের ভাষা প্রায় একই ধরণের । এখানকার সকলেই একই ভাষাভাষি । শুধুমাত্র দোবিলা গ্রামে কয়েকজন আদিবাসি বসবাস করেন । তাদের ভাষা একটু ভিন্ন । এছাড়া সাধারণত এলাকাবাসীর প্রচলিত ভাষায় কোন ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয় না। মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের সংস্কৃতি বলতে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ তথা চলনবিলের গণমানুষের সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, ভোজনরীতি, পোষাক, উৎসব ইত্যাদির মিথষ্ক্রিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে।
সাহিত্য ও সঙ্গীত ঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের বেশি পুরনো। ৭ম শতাব্দীতে লেখা বৌদ্ধ দোহার সঙ্কলন চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় কাব্য, লোকগীতি, ও পালাগানের প্রচলন ঘটে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাংলা কাব্য ও গদ্যসাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ বাংলা ভাষার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলার লোক সাহিত্যও সমৃদ্ধ; ময়মনসিংহ গীতিকায় এর পরিচয় পাওয়া যায়। আধুনিক সাহিত্যিকদের মধ্যে হুমায়ুন আহমেদ খুব বেশি জনপ্রিয়। তাছাড়াও ছোটদের কাছে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, রকিব হাসান খুব জনপ্রিয়। অন্যান্য প্রধান ধারার সাহিত্যিকদের মধ্যে কাজী আনোয়ার হোসেন, কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন।
মাগুড়াবিনোদ এর সঙ্গীতের মধ্যে রয়েছে বাউল গান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, গম্ভীরা, কবিগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই লোকসঙ্গীতের সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে মূলত একতারা, দোতারা, ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
রন্ধনঃ মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের রান্না-বান্নার ঐতিহ্যের সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের রান্নার প্রভাব রয়েছে। ভাত, ডাল ও মাছ বাংলাদেশীদের প্রধান খাবার, যেজন্য বলা হয়ে থাকে মাছে ভাতে বাঙ্গালি।মাগুড়াবিনোদের একটি বিশেষ খাবার রয়েছে পৌষের নানান রকম সু-স্বাদু পিঠা।আম কাঠাল বকুনী, দেশে ছানা ও অন্যান্য প্রকারের মিষ্টান্ন , যেমন রসগোল্লা, চমচম বেশ জনপ্রিয়। ভাতজাতীয় খাবারের মধ্যে বিরিয়ানি, পোলাও জাতীয় উচ্চ ক্যালরির খাবার বেশ সমাদৃত। তাছাড়া তেল-চর্বিজাতীয় মসলাযুক্ত রন্ধন প্রণালী এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্যতালিকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষ শাক-সবজিকে তুলনামূলক গরীবদের খাদ্য মনে করেন। আর মাছ-মাংসকে আভিজাত্য ধরে নেন।
পোষাকঃ মাগুড়াবিনোদের নারীদের প্রধান পোষাক শাড়ি। অল্পবয়স্ক মেয়েদের মধ্যে, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সালোয়ার কামিজেরও চলন রয়েছে। পুরুষদের প্রধান পোষাক লুঙ্গি, তবে গ্রাম অঞ্চলে শহরের পোষাক শার্ট-প্যান্ট প্রচলিত। গ্রামাঞ্চলেও দাপ্তরিক পোশাক হিসেবে শার্ট-প্যান্টকে আভিজাত্যের অংশ মনে করা হয়। বিশেষ অনুষ্ঠানে পুরুষরা পাঞ্জাবী-পায়জামা পরিধান করে থাকেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবি বাংলাদেশী পুরুষদের অন্যতম অনুষঙ্গ।
সামাজিক অনুষ্ঠান ঃ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়ের উত্সব ঈদুল ফিতর , ঈদুল আজহা ও ঈদে মিলাদুন্নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের দূর্গা পূজা ঘটা করে পালিত হয়ে থাকে স্ব স্ব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই দিবসগুলোতে রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে। সার্বজনীন উৎসবের মধ্যে পহেলা বৈশাখ প্রধান। গ্রামাঞ্চলে নবান্ন, পৌষ পার্বণ ইত্যাদি।
খাল বিল ঃ চলনবিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল যা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত। জলায়শটি ২৪.৩৫০ হতে ২৪.৭০০ উত্তর এবং ৮৯.১০০ হতে ৮৯.৩৫০ পূর্ব অক্ষাংশে অবস্থিত যা নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা; নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলা, পাবনার ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তারাশ, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলা জুড়ে অবস্থিত । চলনবিলের আকার বর্তমানে বর্ষাকালে ৩৫০ বর্গ কিলোমিটারের অধিক এবং শুকনো মৌসুমে প্রায় ৯০ কিলোমিটার এবং এই জলাশয়টি দেশের জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মৎস্য উৎপাদনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । ১৯০৯ সালে এই বিলের আয়তন ছিল ১০,৯,০০০ হেক্টর যা বর্তমানে কমে দাড়িয়েছে ৮,৫০০০ হেক্টর মাত্র । চলনবিলের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। তাদের মধ্যে আত্রাই, গুমানী, করতোয়া, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, ভাদাই, চিকনাই, বরোনজা, তেলকুপি ইত্যাদি।
চলনবিলের মাছ: বেশ কয়েকটি গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে, বিগত কয়েক দশকে চলনবিলের মাছের উৎপাদন যেমন কমেছে তেমনি কমেছে দেশী মাছের প্রজাতি। অনেক মাছ স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২০০৬-২০০৭ সালে পরিচালিত এক গবেষণার মাধ্যমে চলনবিলে ৮১ প্রজাতির মাছ রেকর্ড করা হয় যার মধ্যে ৭২টি প্রজাতি দেশীয় এবং ৯টি প্রজাতি বিদেশী মাছ অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮২ সালে চলনবিলে প্রায় ৭৫ প্রজাতির মাছ রেকর্ড করেন।চলনবিলের যে অংশে সারাবছর পানি থাকে সে অংশের উৎপাদন ৬০০০ মেট্রিক টন এবং মৌসুমী অংশের (৪-৬ মাস পানি থাকে) উৎপাদন ৫০০০ মেট্রিক টন ।
চলনবিলে মৎস্য শিকার ঃ চলনবিলে মাছ ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় যন্ত্রপাতি (গিয়ার) ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জাল, বরশি, ফাঁদ, আঘাতকারী গিয়ার ইত্যাদি প্রধান। চলনবিলে ২৭ ধরনের মাছ ধরার গিয়ার এবং ২টি বিশেষ ধরনের মাছ সংগ্রহের পদ্ধতি রেকর্ড করেন।
চলনবিলের মাছ বিক্রির আড়ৎ ও বাজারসমূহ : প্রতি বছরই চলনবিল হতে প্রচুর পরিমাণ মাছ ধরা হয় এবং তা দেশের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে যায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মাধ্যমে। চলনবিল সংলগ্ন বেশ কয়েকটি বড় মাছের আড়ৎ রয়েছে যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বিলের মাছ পাওয়া যায়। এ আড়ৎগুলো হলো নাটোরের সিংড়া উপজেলার সিংড়া ও চৌগ্রাম মাছের আড়ৎ-বাজার; নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার আত্রাই মাছের আড়ৎ-বাজার; পাবনার চাটমোহর উপজেলার চাটমোহর মাছের বাজার-আড়ৎ, ভাঙ্গুড়া উপজেলার ভাঙ্গুড়া মাছের বাজার-আড়ৎ এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি মাছের বাজার-আড়ৎ। এছাড়াও বিলের আশেপাশে অনেক ছোট বড় মাছের বাজার রেয়েছে যেখানে চলনবিলের মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে নাটোর জেলার নাটোর ও নলডাঙ্গা (সদর),কালিগঞ্জ (সিংড়া),বড়াইগ্রাম, জোনাইল ও রাজাপুর বাজার (বড়াইগ্রাম), চাঁচকৈড়, গুরুদাসপুর ও কাছিকাটা (গুরুদাসপুর); বগুড়ার রনবাঘা; সিরাজগঞ্জের তাড়াশের মান্নাননগর , তাড়াশ মাছের বাজার ও হাটিকুমরুল রোড মাছের বাজার।।
চলনবিলের মাছের শুটকি: চলনবিলের আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে বিল হতে ধরা মাছের শুটকি করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে আত্রাই, সিংড়া, তাড়াশ ও ভাঙ্গুড়া উপজেলা প্রধান। মোট ২৬ প্রজাতির মাছ শুটকী তৈরীতে ব্যবহৃত হয় বলে উল্লেখ করেন যার মধ্যে ৫টি প্রজাতির মাছ (পুটি, চান্দা, কাকিলা, টাকি ও বোয়াল) ব্যাপক পরিমানে ব্যবহৃত হয়; এ সকল শুটকীর প্রায় সবটুকুই নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শুটকী আড়তে চলে যায় এবং সেখান থেকে অন্যান্য স্থানে চলে যায় বিক্রির উদ্দেশ্যে।
সমস্যাসমূহ: চলনবিলে অবৈধ মাছ ধরার যন্ত্রপাতির ব্যবহার (যেমন কারেন্ট জাল) এবং নির্বিচারে ছোট-বড় মাছ ধরা খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার ।ফলে কমে আসছে মাছের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্যা। তাছাড়া মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ও সার ব্যবহার মাছের বংশ-প্রজাতি ধ্বংসের বড় কারণ।
বর্তমানে প্রতি বছরই চলনবিলের জমি ভরাট করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন বসতবাড়ি। এছাড়া দখল,দূষণ, ভরাট ও খননে চলনবিল এখন ক্রমেই বিলুপ্তির পথে। শুষ্ক মৌসুমে বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী ও খালের গভীর অংশ ব্যতীত অগভীর অংশ শুকিয়ে যায় এবং সেখানে বোরো ও অন্যান্য উচ্চফলনশীল ধানের পাশাপাশি পেয়াজ, রসুন ইত্যাদিরও চাষ হয়।
নদ নদীঃ মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গুমানী নদী । এটি আত্রাই নদীর একটি শাখা নদী । এটি নাদোসৈয়দপুর গ্রাম ও ১০ নং ব্রিজ হয়ে আত্রাই নাম ধারণ করে বড়াল নদীতে গিয়ে মিশেছে ।ওয়াব্দা বাঁধ থেকে মাগুড়াবিনোদ দিয়ে শ্যামপুর হয়ে বিশ্বরোডের ৮ নং ব্রীজের নিচ দিয়ে সাইট খাল নামে একটি খাল প্রবাহিত হয়ে মির্জাপুর গিয়ে বরাল নদীতে মিশে গিয়েছে।ইহা ছাড়াও আরো অসংখ্য ছোট বড় খাল ও নালা রয়েছে।
লেখক ঃ তরুণ লেখক ও সাংবাদিক। চলন প্রতিনিধি, চলনবিল বার্তা।

 

 

 

 

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD