মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ

Spread the love

মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ছিলেন ঐতিহাসিক সলংগা বিদ্রোহের মহানায়ক

[মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগিশের ১২১ তম জন্ম দিবসে বিন¤্র শ্রদ্ধাঞ্জলী]

।। মোঃ আবুল কালাম আজাদ।।

আজ ২৭ শে নভেম্বর। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে ১৩০৭ বঙ্গাব্দ ১১ অগ্রায়হন ১২১ বছর আগে আজকের এই দিনে বৃটিশ শোষনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কন্ঠ প্রতিবাদি যোদ্ধা উত্তর বঙ্গের ক্ষনজন্মা প্রান পুরুষ মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ঐতিহাসিক চলনবিল অধ্যুসিত সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার তারুটিয়া গ্রামের এক প্রখ্যাত পীর পরিবারে জন্মগ্রহন করেন । তারুটিয়াকে পরবর্তীতে তারই নামানুসারে‘ রশীদাবাদ’ নামকরন করা হয়েছে । তাঁর পিতার নাম হযরত মাওলানা আবু ইসহাক (রঃ) । তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত বুজুর্গ আলেম । ‘পীরবাবা ’ নামে ছিল তঁর ব্যাপক খ্যাতি । মাতার নাম বেগম আজিজুন্নেছা । মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের পুর্বপুরুষ সৈয়দ শাহ্ দেওয়ান মাহমুদ ( বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)র বংশধর ) ১৩০৩ সালে স¤্রাট আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে বাংলাদেশে আগমন করেন । মাওলানা তর্কবগীশ ১২ বছর বয়সে পিতৃহারা হন । অভিভাকহীন হয়েও তিনি লেখাপড়ায় কখনো অমনোযোগী হননি । বরং লেখাপড়ার সাথে সাথে তিনি বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ ও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ।

ঐতিহ্যবাহী রক্ষনশীল পরিবারের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে চিরশোষিত হিন্দু-মুসলমান সাধারন মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাঁর সংগ্রামী জীবন শুরু হয়েছিল। ১৯১৪ সাল । মাওলাানা আব্দুর রশীদ তখন বগুড়া জেলার শেরপুর ডায়মন্ড জুবলী ইংলিশ হাইস্কুলের ৭ম শ্রেনির মেধাবী ছাত্র । সর্বস্তরের কৃষক-শ্রমিকের প্রতি স্থানীয় দোর্দন্ড প্রতাপশালী জমিদারের অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদে তিনি শেরপুরের নিগৃহীত দুধ বিক্রেতা আর কৃষকদের সংগঠিত করে আন্দোলনের ঝড় তুলে জমিদারের নির্যাতন থেকে অত্যাচরিত মানুষের সাময়িক হলেও মুক্তির প্রেরনা দেখান । সেই সংগ্রামই ছিল তাঁর আজীবনব্যাপী অনির্বান । সমাজের অত্যাচার নোংরামী আর পৈশাচিকতাকে উৎপাটনের সংকল্পে অনমনীয় হয়ে উঠলো তাঁর মন-প্রান ।

১৯১৫ সালে চির বিদ্রোহী আব্দুর রশীদ অসাধারন সাংগঠনিক ক্ষমতা ও অসম সাহসিকতার সাথে অনাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে শেরপুরের কেলাকুশি মেলা থেকে দুইটি পতিতালয় উচ্ছেদ করেন । তঁরই প্রচেষ্টায় দেহ ব্যবসা দুইটি উৎপাটিত হওয়ায় সমগ্র অঞ্চলে তাঁর নামে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয় । এসময় আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তৎকালীন বাঙালী মুসলমান সমাজের মুসলিম পূনর্জাগরনের নকিব অন্যতম বিখ্যাত বাগ্মী নেতা রেনেসাঁ কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সহযোগী হিসেবে তিনি সমাজসেবা মূলক প্রতিষ্ঠান‘ খাদেমুল ইসলাম’ নামক সংগঠনে যোগ দেন । সারা বাংলায় সন্ত্রসবাদী আন্দোলন ছিল সম্পুর্ন গোপন রাজনৈতিক দল । মাওলানা তর্কবাগীশ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর অনুপ্রেরনায় এই বিপ্লবী দলে যোগ দেন ।

১৯১৯ সালে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে তিনি যোগ দেন । আন্দোলনের কারনে তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়া হলোনা । সেসময় খেলাফত আন্দোলন আর অসহযোগ আন্দোলন একই সাথে চলছিল । তরুন টগবগে যুবক মাওলানা তর্কবাগীশ বৃটিশের কবল থেকে বারতীয় উপমহাদেমের মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । অহিংস মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বিদেশী পন্য বর্জনের আন্দোলন সর্বত্র ব্যাপক সাড়া জাগায় । তিনি আপন প্রতিভা বলে এবং সাংগঠনিক শক্তিবলে সিরাজগঞ্জ কংগ্রেসের স্বেচ্ছসেবক বাহিনীর সুপারিনটেন্ডেন্ট এবং মহকুমা কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচীত হন ।বৃটিশ শোষন- নির্যাতন বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সলংগা বিদ্রোহের মূল মহানায়ক ছিলেন চলনবিলের বাগ্মীনেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ।

১৯২২সালের ২৭ জানুয়ারী শুক্রবার সলংগা হাটের দিন উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সলংগা হত্যাকান্ডের ঘটনা যেমন সবচেয়ে নৃশংস ও পাশবিক, তেমনি নিহত – আহতের সংখ্যা সর্বাধিক । বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সলংগা হত্যাকান্ডের তথ্যাবলী জানা একান্ত প্রয়োজন সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার সলঙ্গা হাট ছিল অত্র এলাকার বিখ্যাত হাট । ১৯২২সাল, তখন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে চলছিল অসহযোগ এবং বিলেতী পন্য বর্জন অভিযান। ২৭ জানুয়ারী শুক্রবার সলঙ্গার হাট খুব জমজমাট অবস্থানে থাকার প্রক্কালে তর্কবাগীশ তিন শতাধিক স্বেচ্ছসেবক কর্মীবাহিনী নিয়ে‘ বিলেতী দ্রব্য বর্জন কর, এ দেশ থেকে বৃটিশ খেদাও’শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করেন । সলঙ্গার মাটিতে যখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে , ঠিক তখনই এই আন্দোলন রুখতে ছুটে আসে পাবনা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. আর এন সাহা, পাবনার পুলিশ সুপার এবং সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক মি. এস কে সিনহা ৪০ জন স্বশস্ত্র পুলিশ নিয়ে সলঙ্গা হাটে উপস্থিত হয়ে কংগ্রেস অফিস থেকে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে গ্রেফতার করে। পুলিশ সুপার তা্রঁ উপর বর্বরোচিত নির্যাতন করে। নির্যাতনে তর্কবাগীশের নাক, কান ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। দেহের নানা স্থানে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সলঙ্গার মাটি রক্তে ভিজে যায় । সঙ্গে সঙ্গে হাটের জনতার মধ্যে অগ্নীস্ফুলীঙের ন্যায় বারুদ জ্বলে উঠে । বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের প্রিয় নেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে ছাড়িয়ে নিতে পুলিশ সুপার, ম্যাজিষ্ট্রেট এবং মহকুমা প্রশাসককে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ঘিরে ধরে । উত্তেজিত জনতার ঢল আর আক্রোশ থেেেক বাঁচার জন্য জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশকে গুলি চালাতে নির্দেশ দেন । নির্দেশ পেয়ে পুলিশ সাথে সাথে ৩৯ টি রাইফের থেকে উত্তেজিত জনতার উপর নির্মমভাবে গুলি চালালে হাটে আসা বহু নিরিহ লোক নিহত এবং আহত হয় । যার প্রকৃত কোন হিসাব কেউ দিতে পারেনাই । সরকারী হিসেবে ৩৭৯ জন কিন্তু বেসরকারী হিসেবে ১৫-২০ হাজারেরও অধিক বলে কথিত আছে।সিরাজগঞ্জ শহরের উপকন্ঠে রহমতগঞ্জে একটা গনকবর আছে। এই গনকবরে কতজন মানুষকে কবর দেওয়া হযেছিল আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারে নাই ।

ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পুলিশ সুপারের নির্মম নির্যাতনে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন । সাথে সাথে তর্কবাগীশ মারা গেছেন মর্মে খবর ছড়িয়ে পড়ে । যুবক তর্কবাগীশের দাদা ও পিতার মুরিদ এবং জনতা একত্রিত হয়ে পুলিশ, মহকুমা প্রশাসক, ্এসপি ্এবং ম্যাজিষ্ট্রেটদের ওপর চরাও হয়ে রাইফেল কেড়ে নিয়ে ফুলজোড় নদীতে ফেলে দেয় । অবস্থা বেগতিক দেখে তারা মাওলানাকে আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহার করে । তারা তর্কবাগীশকে ছেড়ে দিয়ে মারমুখী জনতার কবল থেকে রক্ষার জন্য আবেদন জানায় ।অহিংস নেতা মাওলানা তর্কবাগীশ সেদিন অহিংস আন্দোলনের নেতা হিসেবে জনতার কবল থেকে বৃটিশের এসপি, ম্যাজিষ্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক , পুলিশসহ সকলের প্রনরক্ষার বিরাট ভ’মিকা রেখেছিলেন । তানাহলে ঘটনা আরো ভয়ঙ্কর হতে পারতো । বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের উপমহাদেশের ইতিহাসে সলঙ্গার ভয়াবহ ঘটনার সাথে তুলনা করা হয় ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ান বাগের হত্যাকান্ডের ।ঐ হত্যাকান্ডের নিহতের সংখ্যা সরকাররি হিসেবে ৩৭৯ জন কিন্ত বেসরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার ।

গনহত্যার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে খেলাফত আন্দোলন এবং কংগ্রেসের বহু নেতা-কর্মী , মেডিক্যাল টিম, সাংবাদিক এবং স্বেচ্ছাসেবক টিম ঘটনাস্থলে যান । স্বেচ্ছসেবকেরা বহু আহতকে সিরাজগঞ্জ বা আশেপাশে চিৎিসা করার উপায় না দেখে কোলকাতায় নিয়ে যায়। ঘটনার ভয়াবহতার বিবরন দিয়ে সাংবাদিকরা বিষÍারিত খবর পাঠালে দেশ- বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে খবর ছাপা হলে চারিদিক থেকে তদন্তের জোড় দাবী উঠে । যদিও দাবির প্রেক্ষিতে তদন্ত হলেও তদন্তের রিপোর্ট আজও বিস্তারিত ও নিরপেক্ষভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ পায়নি। পরবর্তীতে এবছরই বৃটিশ বাহীনি এই বাগ্মী চলনবিলের গনমানুষের নেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে গ্রেফতার করে। ১৯২৩ সালের শেষের দিকে প্রায় এক বছর পর তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন ।

উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রক্তাক্ত সলঙ্গা বিদ্রোহ তিনটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কিন্তু বৃটিশ-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুর্ববাঙলার তীর্থভুমি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা বিদ্রোহের রক্তাক্ত ইতিহাস আজো লেখা হয়নি।

প্রথমতঃ এদেশের মাটিতে স¦াধীনতা সংগ্রামীদের গনকবর রচিত হয়। দ্বীতিয়তঃ সিপাহী বিদ্রোহের পরে এই বিদ্রোহে সর্বাধিক পরিমান স্বধীনতাকামী বুকের তাজা রক্ত দিয়ে গর্বিত শহীদ হন । তৃতীয়তঃ অসহযোগ আন্দোলনের মূলমন্ত্র অহিংসার এক অসামান্য ত্যাগ স্বীকার উপমহাদেশের একমাত্র সলঙ্গাতেই রক্ষা করা হয়েছে ।

আজ যে স্বাধীনতা সার্বভৌম বাংলার বুকে স্বাধীন নাগরিকদের অবাধ বিচরন তার পেছনে রয়েছে অনেক রক্তাক্ত ইতিহাস । সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের যাঁরা মহা নায়ক তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন চলনবিলের কৃতি সন্তান মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ । তাঁর দীর্ঘ জীবনের শেষমুহর্ত পর্যন্ত এই মহান নেতা জাতির কল্যানে সুচিন্তা করেছেন । জাতির বৃটিশ শোষনের হাত থেকে মুক্তির ভীষন কান্ডারী হিসেবে দেশ ও জাতিকে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন এসব ক্ষনজন্মা প্রানপুরুষেরা ।মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তাঁর মেধা, মনন,দক্ষতা ,যোগ্যতা, সততা, নিষ্ঠা ও কঠোর পারিশ্রম দিয়ে এ দেশের বিপদসংকুল রাজনৈতিক অঙ্গনকে করে গেছেন মসৃন ।

মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ দু‘দুটি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সম্মুখ পানে এগিয়ে গেছেন। পরাজয়কে তিনি কঠোর হসেÍ জয় করেছেন ।তিনি কখনো হতাশ হননি । আর হতাশ হননি বলেই তিনি উপমহাদের ঐতিহাসিক দলিলে গুরুত্বপুর্ন স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছেন । সেই অবস্থান থেকে তাঁকে কেউ অদ্যাবধি সরাতে পারে নাই , পারবেনা । বৃটিশ হটাও আন্দোলনে তিনি চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবেন ।##

# আবুল কালাম আজাদ, সভাপতি, চলনবিল প্রেসক্লাব, গুরুদাসপুর, নাটোর,-০১৭২৪ ০৮৪৯৭৩ # ২৭/১১/২১ #

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD