(১৫ নভেম্বর সাংবাদিক রুহুল আমীনের ৫ম মৃত্যু দিবস স্মরণে প্রকাশিত হল)
আবদুর রাজ্জাক রাজু
সেদিন চলনবিলের প্রবীণ ও জেষ্ঠ্য সাংবাদিক কাজী রুহুল আমীন হঠাৎ করেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাড়াশের নিজ বাসভবনে স্ট্রোক করার মাত্র তিন দিনের মাথায় তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি—- রাজেউন) গত ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর। তাড়াশের কীর্তিমান লেখক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের মধ্যে তিনি সর্ব সাম্প্রতিক যিনি পরপারে পাড়ি জমালেন। তার আগে তাড়াশের শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গন থেকে যারা ওপারে চলে গেছেন তাদের মধ্যে শাফাতুল্লাহ মুন্সি, এম সেরাজুল হক, ফজলুর রহমান খাঁ,তোফায়েল হোসেন সিদ্দিকী, মিজানুর রহমান তালুকদার, ফসিউল আলম, ফজলুর রহমান ও আজাহার আলী প্রমুখ প্রতিথযশা সাহিত্য-সংবাদসেবী ব্যক্তিত্ব। আর তাদের কর্ম ও জীবনাদর্শের আধুনিক কালের অনুসারী কাজী রুহুল আমীনের বিদায়ের মধ্য দিয়ে তাড়াশের সমকালীন প্রবীণ লেখকদের একটা অংশের ইতিহাসের আপাতত যবনিকাপাত ঘটল। শেষ হল সিনিয়র সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের পদচারণার অধ্যায়।
রুহুল আমীনের এমনভাবে চলে যাওয়া খুব একটা প্রত্যাশিত ছিল না অন্তত বয়সের দিক থেকে। কেননা মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ষাটোর্ধ মাত্র।তাছাড়া বাহ্যত তার শরীর স্বাস্থ্য তেমনটি খারাপ বোঝা যেত না। কারণ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সংবাদ সংগ্রহ ও লেখালেখির কাজে ঠিকই ছুটে বেড়াচ্ছিলেন স্বাভাবিক গতিতে। অবশ্য তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন আগে থেকেই। মোটর সাইকেল চালানো আর কম্পিউটারে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না হেতু তার হাটাহাটি ও খাটাখাটির পরিমাণ ছিল আমাদের চেয়ে একটু বেশী। তবে সাংবাদিকতার জীবনে ক্যামেরা ব্যবহারে তিনি ছিলেন দক্ষ এবং পারদর্শী। সংবাদ লেখায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আজকের মামুন ভাইরা রিপোর্ট তৈরীর ক্ষেত্রে তার তালিম ছাড়া অসহায় বোধ করতেন – তা নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করেছি।
পাকিস্তান আমলে রুহুলের পরিবার সিংড়া উপজেলার চলনবিল মধ্যস্থ গাড়াবাড়ী গ্রাম থেকে হিজরত করে প্রথমে আমাদের নিজ গ্রাম তাড়াশের আশানবাড়ী গ্রামে নানার বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে তারা তাড়াশ সদর বাজারে বসতি গড়ে তোলে। তার পিতা মরহুম হুরমুজ আলী প্রথমে মাদ্রাসা শিক্ষকতায় ও পরে তাড়াশে দর্জী পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তারা ৪ ভাই ও ৪ বোন। ভাইবোনদের মধ্যে রুহুল আমীন সবার বড়। রুহুল আমীন মাদ্রাসা লাইনে ফাজিল পাশ করেন। তরুণ বয়স থেকেই সৃজনশীল ও মননশীল লেখায় তার অনুশীলনের হাত ছিল।এভাবে তিনি হয়ে ওঠেন সাহিত্যানুরাগী। তিনি ছিলেন বয়সে আমার বড়। আর গ্রাম্য আত্মীয়তার সম্পর্ক সূত্রে তিনি আমার ভাগ্নে হতেন। কিন্তু পরিচয়ের প্রথম থেকেই তাকে আমি মামা বলে ডাকতাম। জবাবে তিনিও আমাকে মামু বলে সম্বোধন করতেন।
স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে তাকে চিনলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সত্তুর দশকের প্রথম থেকেই তার সাথে আমার হৃদ্যতা ও ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এর মূলে ছিল লেখালেখি। আর একটি উপলক্ষ ছিল, সে সময় আমি বিনসাড়ার লেখক-সাংবাদিক সাইদুর রহমান সাজু ও রুহুল আমীন তিনজনই প্রায়শ চাঁচকৈড় যেতাম। উদ্দেশ্য, ওখানকার শিক্ষা সংঘে বই পড়া, বই সংগ্রহ এবং সেখানে অবস্থিত চলনবিল প্রেসক্লাবের লেখক-সাংবাদিকদের সাথে আড্ডা দেওয়া। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে চলনবিল প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় যার সাথে সূচনালগ্নে আমরা জড়িত ছিলাম। তখনকার দিনে তাড়াশ হতে সোজা চলনবিলের মাঝ দিয়ে আমরা বর্ষায় নৌকায় ও শুস্ক মওসুমে পায়ে হেঁটে গুরুদাসপুর-চাঁচকৈড় বেড়াতে গিয়েছি।আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বটে।
সেই থেকে রুহুল মামার সাথে আমার সখ্যতা ও সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হতে থাকে। তাড়াশে সত্তুর দশকে সাংবাদিকতার দিগন্তে প্রথম বিচরণকারী তিনি আমাদের সবার ্েমন্টর অর্থাৎ গুরু। বয়সের দিক থেকে এবং সাংবাদিকতার গুণেমানেও। শুরুতে তিনি বগুড়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক আমানুল্লাহ খানের দৈনিক বাংলাদেশ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। পরে দৈনিক ইত্তেফাক এর সাথে যুক্ত হন । আমিও বগুড়ার সাপ্তাহিক কাঁকন পত্রিকায় অনেক দিন লিখেছি। ১৯৮০ সালে তারই উদ্যোগে ও নেতৃত্বে স্থাপিত হয় তাড়াশ প্রেসক্লাব। অধ্যাপক সামছুর রহমান, জাকির হোসেন (গুরুদাসপুর),আমি, সাইদুর রহমান সাজু , সাইদুর রহমান সাইদ, আব্দুল কুদ্দুস, আব্দুর রহমান, শংকর দাশ প্রমুখ তাড়াশ প্রেসক্লাব গঠনে তার সহযোগী ও সহযোদ্ধা ছিলাম। তিনি তাড়াশ প্রেসক্লাবের প্রথমে আহবায়ক ও পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। তার সম্পাদনায় ১৯৮৩ সালে তাড়াশ প্রেসক্লাবের স্মরণিকা “মাছ পাখীর দেশ” প্রকাশিত হয়।
জীবনের অনেকটা সময় তাড়াশ ইসলামিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে কলোনী হাইস্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেছেন।পাশাপাশি তার সাংবাদিকতা, সাহিত্য, কাব্য ইত্যাদি র্চ্চাও চলতো।একই সাথে তাড়াশ প্রেসক্লাবের দায়িত্ব পালন এবং কাজিগীরি পেশাও। এসব তাল সামলাতে কখনো তিনি হাপিয়ে উঠতেন। কারণ তখনো সবক্ষেত্রে এত যান্ত্রিকতার সুবিধা তৈরী হয়নি। ডিজিটালকরণের ছোঁয়াও তেমন লাগেনি আজকের মত। এক্ষেত্রে তার একটা প্রাসঙ্গিক বিষয় বলি। তার নিজস্ব ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপ কম্পিউটার ছিল না। বিভিন্ন সাংবাদিকদের কাছে বসে তিনি কাজ করতেন। এ নিয়ে আমাকে প্রায়ই বলতেন, দেখো রাজু, এবার পুকুরের মাছ বেচে অবশ্যই ল্যাপটপ কিনে ফেলবো। অবশ্য তার সে আশা অপূর্ণ রেখেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
তো একবার আমি, সাজু, সাইদ, কুদ্দুস ভাই ক’জনা মিলে তাকে অভিযোগ দিলাম।“আপনি সিরাজগঞ্জে দীর্ঘ সময় থাকার ফলে প্রেসক্লাবের বৈঠক হয় না অনেক দিন যাবত। আমরা এটা হতে দিতে চাই না”। মামা আস্তে করে বললেন, তোমরা নিয়মিত চালাতে চাইলে আমাকে সভাপতির পদ থেকে বাদ দাও, আমি অখুশী হব না। যাহোক, আরেকবার তাড়াশে এক সূধী সমাবেশের আলোচনা সভায় প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেছিলেন, সাংবাদিকতা আমার পেশা নয়, আদর্শিক নেশা। সাংবাদিকতার আয়-উপার্জনে আমার সংসার চলে না। আমার পরিবার চলে আমার কাজি পেশার রোজগার দিয়ে। বাস্তবেই রুহুল মামা সংবাদ লেখার বিনিময়ে মানুষের নিকট থেকে কোন টাকা পয়সা নিতেন না। এ ধরণের লেনদেনকে তিনি অবৈধ মনে করতেন। সে কারণেই তার সাংবাদিকতায় ছিল সততা, সচ্ছতা, নৈতিকতা ও আদর্শের প্রতিচ্ছাপ। তাছাড়া সরাসরি দল বা স্থানীয় নোংরা রাজনীতি করতেন না হেতু তিনি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ নিউজে বিশ^াসী ছিলেন।সেজন্যই তৎকালীন তাড়াশের সাংবাদিকতার জগতে তার ভাবমূর্তিতে কেউ কালিমা লেপন করতে পারে নি। বরং তার সময়ে তাড়াশে তিনি ছিলেন জাতীয় বড় পত্রিকার একমাত্র সাংবাদিক। সে কারণেও তার সামাজিক মর্যাদা ও খ্যাতি ছিল উচুঁতে। বর্তমান সময়ের বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতার তিনি ছিলেন উর্দ্ধে। এক কথায় সুশিক্ষিত এবং নিবেদিত কলম সৈনিক হিসেবে তিনি ছিলেন মূল্যবোধ আর আদর্শের পূজারী, পরিচ্ছন্নতার প্রতীক।
সম্ভবত প্রথমে শিক্ষকতা ও পরে কাজী পেশার নিয়মনীতির সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি দ্বান্দ্বিক, প্রতিবাদী ও চ্যালেঞ্জিং ক্রাইম রিপোর্টিং এড়িয়ে চলতেন। এটা সর্বদাই ঠিক যে, সরকারী-বেসরকারী চাকরী করে স্বতস্ফুর্ত, নির্ভিক , সাহসী এবং ঝুঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতা করা নানা কারণেই সম্ভব হয় না,কঠিন হয়ে দাঁড়ায় সে ধরণের অবস্থান নিতে। তবে এটা প্রমাণিত, তারা প্রসিদ্ধ লেখক ও কলামিস্ট হতে পারেন তাতে সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে সুক্ষ্মভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, সাংবাদিকতার জীবনে রুহুল মামা সবচেয়ে বেশী লিখেছেন চলনবিলের কৃষি ও কৃষকের কথা। সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও তার রিপোর্ট ছিল প্রচুর। যুগপৎ প্রবন্ধ, কবিতা,ছড়া,গল্প ইত্যাদি লেখায়ও তার পারদর্শীতা লক্ষ্যণীয়। তিনি এক টার্ম তাড়াশ উপজেলা পাবলিক লাইব্রেরীর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংবাদ লেখায় প্রতিবাদী ধারা অনুসরণ করতে না পারলেও তার কাব্য-সাহিত্যে সমাজের অসঙ্গতি ও অবক্ষয় ফুটে উঠেছে।
তাড়াশ প্রেসক্লাব তার নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান হলেও তার জীবিতকালে এই ক্লাব তাকে এক পর্যায়ে চরম অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে। শুধু তাকেই নয়, সব প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদেরকেই অনুরুপ অশ্রদ্ধা করার ইতিহাস সেখানে আজো বিদ্যমান। ফলশ্রুতিতে ওই প্রেসক্লাবের আরেক বিদ্রোহী সদস্য সাংবাদিক মামুন হুসাইনকে নিয়ে এক পর্যায়ে তিনি তাড়াশ রিপোর্টার্স ইউনিটি গড়ে তুলেন। মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এর উপদেষ্টা। তবে গভীর ক্ষোভে ও দু:খে মৃত্যুর পূর্বেই তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর আমার শবদেহ বা লাশ তাড়াশ প্রেসক্লাব চত্তরে যেন না নেয়া হয়। এসত্বেও আমিই প্রস্তাব দিয়ে তার মৃত্যুর পর তার কফিন জরানো লাশ তাড়াশ প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে আনা হলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।আমাদের সাথে তাড়াশ প্রেসক্লাবের দায়িত্ব পালন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় তার মান অভিমানের ঘটনা ঘটলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের ইস্যুতে আমরা সর্বদাই এক কাতারে ছিলাম। প্রসঙ্গত তার পরামর্শেই আমি তাড়াশ প্রেসক্লাবের বর্তমান জায়গার কাগজপত্র খুঁজে বের করে লিজ নেওয়ার ব্যবস্থা করি এবং আমি সভাপতি থাকাকালে তৎকালীন তাড়াশ উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার আব্দুল জলিলকে রাজি করিয়ে উপজেলা পরিষদের অনুদানে তাড়াশ প্রেসক্লাবের বর্তমান ভবন নির্মিত হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে রুহুল মামা অভাবী বা দরিদ্র ছিলেন না। তার তাড়াশের বাসভবন তারই নিজস্ব বিশাল পুকুরের পাড়ে আবস্থিত। তাছাড়া তাড়াশ বাজারে তাদের নিজস্ব মোটামুটি একটি বড় মার্কেট রয়েছে। কিন্তু তার জীবন যাপনের ধরণ ছিল বেশটা সাদামাটা। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী ও টুপি পরিহিত সফেদ শশ্রুমন্ডিত ফর্সা চেহারার মানুষটিকে সহজেই চেনা যেত ইনি সেই রুহুল আমীন, ইত্তেফাকের সাংবাদিক। অত্যন্ত মিতব্যয়ীতা ও কৃচ্ছতা তার জীবনযাপনে প্রতিফলিত হতো। তাড়াশের নতুন প্রজন্মের অনেক সাংবাদিকই তার কাছে সংবাদ লেখার স্টাইল শিখেছে ও অনুকরণ করেছে। তিনি সাংবাদিকতাকে পূঁজি করে ব্যক্তিগত কামাই রোজগার থেকে দুরে ছিলেন। ইত্তেফাক থেকে তেমন একটা বেশী ভাতা বা সম্মানী পেতেন না। দুর্ভাগ্যজনক হল সেই পত্রিকা যেখানে তিনি প্রায় জীবন কাটিয়ে দিলেন মৃত্যুর পর তারা তার তিন বছরের প্রাপ্য পারিশ্রমিক পরিশোধ করেনি বলে জানা যায়। মৃত্যুর বেশ কিছু কাল আগেই তিনি আমাদের ইত্তেফাক ছেড়ে দেওয়ার আভাষ দিয়েছিলেন। অন্যান্য অনলাইন কাগজেও তিনি শেষ জীবনে নিউজ করেছেন। তিনি আদর্শের প্রশ্নে কোথাও আপোষ করেন নি। তার বংশে ও পরিবারে তার মতো মননশীল ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব কেউ উদিত হয় নি। মরহুমের ছেলেমেয়েদের মধ্য থেকে সাহিত্য সমাজসেবায়ও কেউ এগিয়ে আসেনি। যদিও তার প্রকাশিত কোন বই নেই। তবুও বহু পত্র-পত্রিকায় তার প্রকাশিত বিভিন্ন লেখাসমূহ সংকলিত করে বই প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারে তার পরিবার। আর তাড়াশ রিপোর্টার্স ইউনিটি তার নামে কোন দৃষ্টান্তমূলক তথা দর্শনীয় কিছু করে তার স্মৃতি ও কীর্তি উজ্জল করে ধরে রাখতে পারে- সেটাই হবে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ নজির।
জীবিতকালে তিনি আমাদের পরিবর্তনে এসেছেন অসংখ্যবার। এলেই আমরা সাধ্যমত তাকে আদর আপ্যায়ন করতাম। আমার সাথে তার সাহিত্য সাংবাদিকতা ছাড়াও ধর্ম প্রসঙ্গে আলোচনা হতো। বিশেষ করে কোরআন বিষয়ে আলোকপাত করতাম তার সাথে। কেননা তাফসিরুল কোরআনে তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ। আমাদের মুসলিম সমাজে শুধু পূণ্য লাভের বিশ^াসে কোরআনের প্রতি আকর্ষণ পরিলক্ষিত হয়। বাস্তবে এটাকে বোঝা, জানা বা ব্যাখা বিশ্লেষণ করার দিকটি বরাবরই পাশকাটিয়ে যায়- তা আমাদের আলোচনায় ঠাঁই পেত। কোরআনের তাফসির সম্পর্কে তার ছাত্র জীবনের পড়াশোনার সূত্রে এ ব্যাপারে তার জ্ঞান প্রজ্ঞা ছিল নিবিড় ও গভীর। তিনি ধর্মানুরাগী হলেও ধর্মান্ধ ছিলেন না। কোরআনের মাহাত্ম্য এবং তাৎপর্য সংক্রান্ত ওয়াজ-নসিহতের তেমন প্রচলন আমাদের সমাজে না থাকায় তিনি বক্তা হিসেবে গতানুগতিক ইসলামী জালছায় খুব একটা যেতেন না। তিনি বলতেন, কবরস্থান আর মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নতিকল্পে জালছা হওয়া যদি প্রধান লক্ষ্য হয়, তবে সেখানে কোরআনের গবেষণাধর্মী কী আলোচনা হতে পারে । তাছাড়া একদা তাড়াশের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের তদানীন্তন ইমামের ভাষনে ব্যত্যয় দেখে পরে তিনি উক্ত মসজিদ ছেড়ে উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদে শুক্রবারের নামাজ পড়ে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা আমি দেখেছি ও তার নিকট শুনেছি। তিনি আমাদের সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তার প্রায় সব সংখ্যাই নিয়ে পড়তেন আর বলতেন, লেখা দেবো; যদিও তার আর তা দেয়া হয়ে উঠেনি।
আরবী লাইনে লেখাপড়া করেও আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তা চেতনা ও মুক্ত মন মানসিকতা ধারণ ও লালন করতেন এই ক্ষণজন্মা মানুষটি। সবশেষে দেখেছি ও তার মুখেও শুনেছি, তিনি এম সেরাজুল হকের শিষ্যরুপে নিজেকে তুলে ধরতে চাইতেন। মূলত: তার কর্মে ও জীবনাচারনে কিঞ্চিৎ হলেও হক সাহেবের ছাপ প্রতিফলিত হয়েছে। সেজন্যই তিনি ধর্মভিত্তিক পড়াশোনা করেও জীবনের ক্যারিয়ার হিসেবে সাহিত্য সাংবাদিকতার পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি তাড়াশের সাংবাদিকতা অঙ্গণের এযুগের পথিকৃৎ ও পূর্বসূরী। তাই আমার চির বিন¤্র শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদিত প্রাণ সৎ সাংবাদিক ও লেখক কাজী রুহুল আমীনের প্রতি। তার আত্মা মুক্তি ও শান্তি লাভ করুক এটাই একান্ত প্রার্থনা।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা, তাড়াশ সিরাজগঞ্জ।