চলনবিলের নদ-নদীর ইতিবৃত্ত (শেষ পর্ব)

Spread the love

মো. আবুল কালাম আজাদ

মির্জামামুদ নদী :
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার কাছুটিয়া বড়াল নদী থেকে মির্জামামুদ নদীর উৎপত্তি। কাছুটিয়ার বড়াল নদী থেকে মির্জামামুদ নদীর প্রবাহ গুরুদাসপুর উপজেলার কান্দাইল, ধানুড়া, পুরুলিয়া, তুলাধুনা চন্দ্রপুর, চকআদালত খাঁ, গোপিনাথপুর হয়ে চাকলের বিলের ভিতর দিয়ে সোনাবাজু ঝাঁকড়া উত্তর-পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বড়াল নদীর আর এক শাখা তুলসিগঙ্গা নদীতে মিশেছে। কথিত আছে একসময়ে এই মির্জমামুদ নদী দিয়ে বড় বড় বাণিজ্যিক নৌকা ,বজরা , লঞ্চ চলাচল করতো।বর্তমানে এই ¯্রােতস্বিনী নদী সম্পুর্ণ মৃত। নদী খেকোরা নদীর উৎসমুখ থেকে ধানুড়া পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে।পুরুলিয়া থেকে গোপিনাথপুর হয়ে চাকলের বিলের ভিতর দিয়ে সোনাবাজু পর্যন্ত এখনও নদীর ধারা থাকলেও দখলদাররা চন্দ্রপুর এলাকায় নদীর মধ্যে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে।বর্ষা মওসুমে এই নদী দিয়ে ধানুড়া , হালসা, রানিনগর , চন্দ্রপুর , গোপিনাথপুর, বৃকাশো ও চাকলের বিলের পানি নিস্কাশিত হয়। মির্জামামুদ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার।
তুলসিগঙ্গা নদী মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত :
নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়ারি বড়াল নদী থেকে উৎপত্তি। জোয়ারি বড়াল থেকে উত্তর-পুর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে নওদা জোয়ারি, গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা, খামারপাথুরিয়া, নওপাড়া, ইদিলপুর , তেলটুপি, মকিমপুর ,রওশনপুর , ঝাঁকড়া, সোনাবাজু, পোয়লশুরা পাটপাড়া, শিধুলি,ধারাবারিষা, বড়াইগ্রাম উপজেলার ভিটাকাজিপুর হয়ে দক্ষিন চলনবিলের চেঁচুয়ার বিলের মধ্য দিয়ে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার কাটেঙ্গা কিনুর ধর গিয়ে গুমানি নদীতে মিশেছে। তুলসিগঙ্গা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। দখলদারদের দৌড়াত্ম্যে একসময়ের প্রমত্তা তুলসি নদীর উপর জোয়ারি উৎসমুখ থেকে রওশনপুর পর্যন্ত পুকুর খনন করে মাছ চাষ , বসতবাড়ি,মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মান করেছে। এমনকি এই নদী প্রভাবশালীদের মদদে মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে। তুলসিগঙ্গা নদী দিয়ে মির্জামামুদ নদীর সংশ্লিষ্ট বিলের পানি ছাড়াও দক্ষিন চলনবিলের বিশাল অঞ্চলের সব কয়টি বিলের পানি নিস্কাশিত হয়।
বোয়ালিয়া নদী মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে :
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুরের মামুদপুর নন্দকুঁজা নদী শাখা বোয়ালিয়া নদী। । বোয়ালিয়া নদীর প্রবাহ উৎপত্তিস্থল নন্দকুঁজা থেকে মামুদপুর , জুমাই নগর, বিন্যাবাড়ি, দক্ষিন নারিবাড়ি, শিধুলি, উদবাড়িয়া, দাদুয়া, খাঁকড়াদহ এবং বড়াইগ্রাম উপজেলার কচুগাড়ি হয়ে ভিটাকাজিপুর তুলসিগঙ্গা নদীর সাথে মিশেছে। দখলদারদের দৌড়াত্বে নদীটির অস্তিত্ব মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে। উপজেলার নদীর তালিকায় বোয়ালিয়া নদীর কোন নাম-গন্ধই নাই। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার।
নন্দকুজা নদী পৌরসভা ও হাট-বাজারের বর্জ্যরে ভাগারে পরিনত :
নাটোর জেলার বড়াইগ্রামের আটঘড়িয়া বড়ালের শাখা নদী নন্দকঁজা নদীর উৎপত্তি হয়ে উত্তর দিকে বড়াইগ্রাম উপজেলার আহমেদপুর,নাটোর সদর উপজেলার হালসা,সিংড়া উপজেলার বাহাদুরপুর, হেলাইগাড়ি এবং গুরুদাসপুর উপজেলার চন্দ্রপুর,নাজিরপুর ,গুরুদাসপুর পৌরসভার উপড় দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রি-মোহনায় এসে আত্রাই ও গুমানি নদীতে মিশেছে। আটঘড়িয়া থেকে চাঁচকৈড় ত্রি মোহনা পর্যন্ত নন্দকুঁজা নদীর দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার। বাগাতিপাড়া উপজেলার আটঘড়িয়া নামক স্থানে নন্দকুঁজার শাখা নদী নারোদ নদের তৃতীয় প্রবাহের উৎপত্তি হয়েছে।
১৯৮৯ সালে আটঘড়িয়ায় বড়াল নদী থেকে উৎপত্তি নন্দকুঁজা নদীর মুখে দুইপাড় সংকুচিত করে স্লুইসগেট নির্মাণ করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করায় মরা নদীতে পরিনত হয়েছে।নন্দকুঁজা নদী বড়ালের শাখা নদী বিধায় পদ্মার পানির প্রবাহ নন্দকুঁজা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রি মোহনায় গুমানি নদীতে পড়ে। আটঘড়িয়ায় অপ্রস্বস্থ স্লুইস গেটের কারনে বড়ালের মুল ¯্রােত নন্দকঁজা দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্ত নন্দকুঁজার মুখেও স্লুইসগেট নির্মান করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কমে বর্ষা মওসুমে অর্ধেকেরও নীচে প্রবাহিত হচ্ছে। আটঘড়িয়া থেকে চাঁচকৈড় পর্যন্ত আহমেদপুর , হালসা, চন্দ্রপুর, হোলাইগাড়ি, নাজিরপুর , গুরুদাসপুর ও চাঁচকৈড় হাটবাজার ও ব্যবসায়িক বানিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।নাটোর সুগারমিল এবং যমুনা ডিষ্টিলারিজের বিষাক্ত বর্জ্য নারোদ নদ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নন্দকুঁজা নদীতে পড়ে পানি দুষিত হচ্ছে। ফলে নারোদসহ নন্দকুঁজা নদীর মাছ ও জলজসম্পদ মরে- পচে নদী এলাকার পরিবেশ মারাতœকভাবে দুষিত করছে। এছাড়াও নন্দকুঁজা নদীতে বেশীরভাগ সময় পানি না থাকায় এবং পলি জমে দুই পাড় ভরাট হওয়ায় প্রভাবশালী ভুমি খেকোরা দখল করে প্রমত্তা নদীকে নির্মমভাবে হত্যায় মেতে উঠেছে। বড়ালসহ এই নন্দকুঁজা নদীকে সকলপ্রকার দখল-দুষন থেকে রক্ষা এবং চারঘাট ও আটঘড়িয়ার স্লুইসগেট অপসারনের দাবীতে গুরুদাসপুরের নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি মানব বন্ধন, নদীপথে ৪০ কিলোমিটার নৌ র‌্যালীসহ বহু কর্মসুচি পালন করে আসছে।
নারোদ নদ সুগারমিল ও ডিষ্টিলারিজের রাসায়নিক বর্জ্যরে প্রবাহে দুষিত :
রাজশাহী মহানগর থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিন-পুর্বদিকে সাহাপুর গ্রামে পদ্মা নদী থেকে নারোদ নদের উৎপত্তি।নারোদ নদের তিনটি প্রবাহ। প্রথম প্রবাহ রাজশাহীর সাহাপুর থেকে,দ্বিতীয় প্রবাহ নাটোরের পিরগাছা থেকে এবং তৃতীয় প্রবাহ বাগাতিপাড়ার আটঘড়িয়ায় নন্দকুঁজা নদী থেকে উৎপত্তি।
প্রথম প্রবাহ :
রাজশাহীর সাহাপুর পদ্মা থেকে উৎপত্তি হয়ে কাটাখালি, কাপাসিয়া, জামিরা চারঘাট উপজেলার হলিদাগাছি ,মৌগাছী, পুঠিয়া উপজেলার তাতারপুর, বিড়ালদহ ভারড়া হয়ে কান্দ্রা পর্যন্ত প্রবাহিত। প্রথম প্রবাহের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫ কিলেিিমটার।নারোদ নদেও প্রথম প্রবাহের এপর্যন্ত ৫টি নীলকুঠি আছে।
দ্বিতীয় প্রবাহ :
রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার কান্দ্রা যেখানে প্রথম প্রবাহ শেষ হয়েছে সেখান থেকে শুরু হয়ে নাটোর সদর উপজেলার পিরগাছা, নাটোর সুগারমিল, তেবাড়িয়া হাট হয়ে নাটোর শহরের ভিতর দিয়ে দত্তপাড়া, গোকুলনগর, ধরাইল জমিদারবাড়ি হয়ে গুরুদাসপুর উপজেলার চন্দ্রপুর নীলকুঠির সামনে এসে নন্দকুুঁজা নদীতে মিশেছে। কান্দ্রা থেকে চন্দ্রপুর পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য ২৫ কিলোমিটার।
তৃতীয় প্রবাহ :
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার আটঘড়িয়া নন্দকুঁজা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে লক্ষ্মিপুর , খোলাবাড়িয়া , হয়বতপুরের ভিতর ািদয়ে গোকুল নগর(ধরাইল) নারোদ নদের সাথে মিশেছে ।নারোদ নদের তৃতীয় প্রবাহের দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার।বর্তমানে নারোদ নদের উৎসমুখ সহ প্রয় ৩০ কিলোমিটার সম্পুর্ন ভুমিখেকোদের দদখলে চলে গেছে। বড়াল এবং নারোদ নদের তিন প্রবাহের মাধ্যমে বড়াল ও নন্দকুঁজা নদী দিয়ে পদ্মার পানি প্রবাহ বৃহত্তর চলনবিলে পড়ে চলনবিলকে সচল রাখতো।বর্তমানে বড়ালের উৎসমুখ চারঘাটে এবং আটঘড়িয়ায় তিনটি স্লুইস গেট নির্মান করে এবং নারোদ নদের উৎসমুখ পদ্মা থেকে ভাটিতে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সম্পুর্ন বেদখলে থাকায় পানির প্রবাহ সম্পুর্ন বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া নাটোরের সুগারমিল ,যমুনা ডিষ্ঠিলারিজ , প্রান কোম্পানি এবং নাটোর শহরের বর্জ্য নারোদ নদ দিয়ে নন্দকুঁজা নদীতে প্রবাহিত হয়ে নারোদ নদ সহ ভাটির চলনবিলের বিশাল অঞ্চলের ও নন্দকুঁজা-গুমানি নদীর পানি দুষন হচ্ছে। এতে নদীর জলজ প্রানি-উদ্ভিদ ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।সন্ধ্যা নদী :
সন্ধ্যা নদী নারোদ নদের একটি শাখা নদী। এ নদীর উৎসমুখ রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার রঘুরামপুর হতে নরোদ নদ প্রবাহিত হয়ে বাগিচা পাড়ার শিবরামপুর বাজারের পাড় দিয়ে বাঁচাপুকুড়িয়া, নন্দনপুর হয়ে চলনবিলের কান্দ্রার বিলে পড়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার।
মুসা খাঁ নদী :
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপেেজলার হাঁপানিয়া গ্রামের বড়াল নদী থেকে মুসা খাঁ নদীর উৎপত্তি।হাঁপানিয়া বড়াল থেকে উৎপত্তি হয়ে মুসা খাঁ নদীর প্রবাহ রাজশাহী জেলার পুঠিয়া, ঝলমলিয়া,কানাইপাড়া, নাটোর জেলার আগদিঘা, ছাতনি হয়ে ত্রি মোহনী নামক স্থানে গদাই নাম ধারন করে আত্রাই নদীর সাথে মিশে চলনবিলে পড়েছে।
নদী গবেষকরা ধারনা করছেন,মুসা খাঁ নদী প্রকৃতির কোন প্রবাহ নয়। ষোড়শ শতাব্দির শেষে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দির শুরুতে ইসা খাঁ ও পুত্র মুসা খাঁ বড়াল থেকে নারোদ নদের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সামরিক প্রয়োজনে এটি খনন করেছিলেন। পরে ১৮৩৮ সালের প্লাবনে এটি পুর্ন নদীতে রূপ নেয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মুসা খাঁর উৎসমুখে হাঁপানিয়া ও বাকসোর ঘাটে দুইটি স্লুইসগেট স্থাপন করে এই নদী পানির প্রবাহ এবং নৌ চলাচলের বিঘœ ঘটিয়েছে। ফলে নদীটি সম্পুর্ন মৃত। মাননীয় আদালতের নির্দেশনা মেনে সি এস রেকর্ড ধরে জরিপ করে নদীগুলির সকলপ্রকার স্লুইসগেট অপসারনসহ অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে পুনঃখননের মাধমে পানির প্রবাহ সচল করা হলে মৃতপ্রায় চলনবিলে জীবন ও যৌবন আবারো ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে পরিবেশবিদদের অভিমত।

লেখক:চলনবিল প্রেসক্লাবের সভাপতি, গুরুদাসপুর , নাটোর। মোবাইল: ০১৭২৪ ০৮৪৯৭৩

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD