গাজী সৈয়দ শুকুর মাহ্মুদ
ওলি আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হচ্ছে বন্ধু। আল্লাহ’র ওলির অর্থ আল্লাহ’র বন্ধু। যিনি আল্লাহ’র বন্ধুত্ব অর্জন করতে পেরেছেন তার দুনিয়া ও আখিরাতে কোন অভাব নেই। দুনিয়ায় যার অর্থ আর সম্পদের সাথে ভাব হয়েছে দুনিয়ার জীবনে তার অর্থ সম্পদের অভাব হয় না। আল্লাহ’র সাথে যার ভাব হয়েছে তার দুনিয়া ও আখিরাতে কোন কিছুর’ই অভাব নেই। যার সাথে হয় ভাব, তাকে দিয়েই মিটে তার অভাব। আর পীর শব্দের অর্থ শিক্ষক। যিনি সঠিক পথ প্রদর্শন করে সে অনুযায়ী তালীম দেন তিনিই পীর। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে , “ আমি আপনার পূর্বে শুধু মানুষকেই রাসুলরূপে প্রেরণ করেছি, যাদের প্রতি আমি ওহী পাঠাতাম। যদি তোমাদের জানা না থাকে, তবে যাদের কিতাবের জ্ঞান আছে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও”(সূরা আম্বিয়া,রুকু-১,আয়াত-৭) । এছাড়া আরো এরশাদ হয়েছে,“ তিনি এমন সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে আসমান, জমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যস্থিত সব কিছুকে, তারপর তিনি সমাসীন হন আরশে। তিনিই পরম দয়াময় রহমান। তাঁর সম্বন্ধে যে খবর রাখে , তাকে জিজ্ঞেস কর” (সূরা ফুরকান,রুকু-৫,আয়াত-৫৯)। তাই কোরআনের এসব সুস্পষ্ট আভাষ-ইঙ্গিত থেকে আমরা শিক্ষা ও দীক্ষা নিয়ে প্রকৃত পীর মুর্শিদ কিংবা ওলি অনুসন্ধান করতে পারি।
আমরা যাদের’কে ওলি বলে জানি তারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের ধনী। তাদের কোন কিছুর’ই অভাব নেই। তাই তাদের জন্য দুনিয়ার মানুষের কাছে একমাত্র দোয়া ব্যতিত আর কিছুই চাওয়ার নেই। তাদের মাজার উন্নতির নামে মানুষের নিকট হতে যে সকল দয়া ভিক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে এগুলো ওলিদের কোন কল্যাণেই আসবে না। পার্থিব জগতে তাদের কবর উন্নয়ন, মুল্যবান পাথর দিয়ে দশ তলা ভবন গড়ে তোলার কোন দরকার নেই। এগুলো দিয়ে তাদের কিছুই আসে যায় না। আবার কবর মাটিতে মিশিয়ে দিলেও ঐ ওলির কোন লাভ ক্ষতি নেই। কেউ কোন ওলির মাজারে দশ কোটি টাকা দান করলেও দানকারীর আমল নামায় এক বিন্দু সওয়াবও জমা হবে না। বরং মাজার যত উন্নত হবে তত শিরক এ জড়িয়ে পরবে মানুষ। যারা মাজারে ভক্তি করবে, মাজার ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করবে, মাজারে সিজদা করবে তারা শিরক এর মত গুণাহে জড়িয়ে পরবে। এতে দানকারীর আমল নামায়ও গুনাহ লেখা হবে। হে মাজার লালনকারীগণ তোমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করোÑ তোমার কাছে দুনিয়াই বড়? না আখিরাত ? মানুষ’কে ধোকা দিয়ে শিরক করাইও না। শিরকের গুণাহ তোমাদের আমলনামায়ও জমা হবে। আমাদের দৃষ্টিতে যাদের’কে ওলি ভাবছি তারা কত নাম্বারের ওলি, কেউ কেউ আদৌ ওলি কি না তারও কোন দলিল আমাদের কাছে নেই। তাছাড়া প্রকৃত হেদায়াতপ্রাপ্ত হক্কানী পীর-আউলিয়া যাচাই বাছাইয়ের জ্ঞানই বা আমাদের কয় জনের আছে।
জন্ম সুত্রে মানুষের রয়েছে শ্রেণী বিন্যাস। এক শ্রেণীর মানুষ আম্বিয়াগণ, অন্য শ্রেণীর মানুষ নবী করিম (স.) এর সাহাবীগণ। পরবর্তী সকল মানুষ’ই এক (সাধারণ মানুষ)। সাধারণ মানুষের মধ্য হতে যারা ওলিত্ব তথা কামলিয়াত অর্জন করতে পেরেছ তারাই ওলি। এসকল ওলির মধ্যেও রয়েছে শ্রেণী ভেদ। যিনি আল্লাহ’র যত প্রিয় হতে পেরেছেন তিনি ততবড় ওলি। তবে যত বড় ওলি’ই হোক না কেন মৃত্যুর পর তাঁর দুনিয়ার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। তিনি আর দুনিয়ার ভালো-মন্দ কোন কিছুই করার ক্ষমতা রাখেন না এবং আমাদের জন্য কোন দোয়া-দয়া কিছুই করতে পারেন না বরং আমরা তার জন্য দোয়া করলে তারও কল্যাণ হয়, আমাদেরও আমল নামায় বরকত হয়। ওলির মাজারে এলেই মনস্কামনা পুরণ হয়, ওলির নিকট সব কিছু পাওয়া যায় এই ধোকায় না ফেলে আহ্বান করুন ওলির জন্য দোয়া করতে। প্রার্থনা করুন তাঁর কাছে যার হাতে রয়েছে আমার আপনার জীবন ও মরন, সাজা ও জাযা, শাস্তি ও মুক্তি, তিনি আমাদের প্রতিপালক। এছাড়া কোন মানত বা নিয়ত পূরণের উদ্দেশ্যে যে কোনো পীরের মাজারে গমন সম্পূর্ণ বিদায়াত। তিনটি জায়গা ব্যতিত মুসলিমদের খায়েশ পূরণের অথবা প্রার্থনার লক্ষ্যে সফর করা নিষেধ। সে ৩টি পবিত্র স্থান হল- মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী এবং এবং জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা ।
বর্তমানে সারা দেশব্যাপি স্থাপন করা হয়েছে দান বাক্স। লেখা হয়েছেÑ পবিত্র মাজার শরিফে মুক্ত হস্তে দান করুন, দুনিয়া ও আখিরাতে মুনাফা হাসিল করুন। অমুক ওলির মাজারের উন্নতিকল্পে মুক্ত হস্তে দান করুন। মানুষের দান দিয়ে ঐ ওলি কি করবেন ? বউয়ের শাড়ি, নাকি নিজের ঔষুধ কিনবেন? তার কবরের উপর বেশি সুন্দর করে ভবন তৈরি হলে কি তিনি বসবাস করে আনন্দিত হবেন? অভিনব কৌশলে আল্লাহ’র ওলিগণের নামে চলছে ভিক্ষাবৃত্তি। এ সকল ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে হালাল রুজি করতে শিখুন। এই দান-খয়রাতের আড়ালে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে মাজারের টাকা নিয়ে হরেক রকম কেলেংকারী যা ইসলামে বেমালুম গর্হিত এবং অবশ্য পরিত্যাজ্য।
ভারত উপ-মহাদেশের ছোট বড় শহরগুলোতে বা রাস্তার মোড়ে মোড়ে দান বাক্স স্থাপন করা হয়েছে মানুষের দয়া ভিক্ষা চেয়ে। যেমন সিলেটে রয়েছে হযরত শাহ জালাল (র.) এর মাজার, হযরত শাহ পরান, চট্টগ্রামে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.), খুলনার বাঘেরহাটে খান জাহান আলি, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে হযরত শাহ মখদুম ইয়ামেনী, হযরত শাহ হাবিবুল্লাহ ও ওস্তাদজি শামসউদ্দিন তাবরেজী, তাড়াশের নওগায়ে শরিফ জিন্দানী এর মাজার, ভারতের আজমিরে খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র:) সহ আরও অনেক ওলি-আউলিয়া ছাড়াও কথিত কিছু পীর বাবার করবও মাজার করা হয়েছে। জানাগেছে, জাতীয় আদমশুমারীতে তিন লাখ পীরের নাম এসেছে যা উদ্বেগজনত। ঐ সকল মাজারের নামে দান বাক্স স্থাপন করে চলছে ভিক্ষা বৃত্তির অপকৌশল। সেই সাথে কিছু ধোকাবাজ ও ফেরকাবাজরা চষে খাচ্ছে মাজারগুলো। সেখানে যাচ্ছে অজ্ঞ ও সরলপ্রাণ মানুষ, বিপদগামী হচ্ছে তারা। দেশের সরকার বাহাদুররাও ঐ ধোকায় পড়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কমিটি গঠন করে দিয়েছে মাজারগুলোতে। এগুলো এখন প্রকাশ্য ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এমনকি পীর ভজন যে সাধারণ মানুষ করে থাকে তা নয়, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও পীরের বন্দনা করে যাচ্ছে নিজেদের ফন্দিফিকির হাসিলের লক্ষ্যে। প্রায় সব পীরের মাজারেই ওরসকালে মেলা বসে আর সেখানে পণ্য কেনাবেচা ছাড়াও নাচগান , ক্রীড়াকৌতুক ও মদগাঁজাসহ নারী-পুরুষের মিলন মেলায় অনৈসলামিক ধারা অনুসৃত হয়। এটা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম তথা নিষিদ্ধ। অনেকদিন আগে একবার রেডিও তেহরানে এ সম্পর্কিত আলোচনা শুনেছিলাম। ষেখানে বলা হয়, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে মনীষীদের মাজারগুলোকে শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রগতিশীল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। সে দেশের বড় বড় পন্ডিত, গবেষক, আলেম ও বিজ্ঞানীদের এসব মাজার ব্যবস্থাপনা কমিটিতে স্থান দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষনায় পরিচালিত এগুলোকে ইসলামী সংস্কৃতির পাশাপাশি আধূনিক জ্ঞানার্জনের তীর্থভূমি রুপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশে পীর র্চ্চার নামে যে অবক্ষয় ও অপসংস্কৃতি চলছে দীর্ঘকাল যাবৎ , সেটাকে এখুনি থামাতে হবে। এবং ইসলামের উৎকর্ষ এবং জাতীয় কল্যাণকর চিন্তা চেতনার সংমিশ্রন ঘটাতে হবে পীর মাজার সংস্কৃতিতে।
ওলিদের মাজার তৈরি, মাজারের উন্নতি, মাজারে বাৎসরিক ওরশ করা এগুলো ইসলামী আইনের পরিপন্থি যা নবীজীর সময়ে, ছাহাবীদের সময়ে, তাবেইন- তাবে তাবেইনদের সময়ও হয়নি। এগুলো ইসলামে নতুন সংযোজন যা বিদআত। আসুন আমরা বাতিল ও বিদআত ত্যাগ করে হক্ক পথে আল্লাহ’র গোলামী করি।
লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট, কবি ও কথা সাহিত্যিক ,শাহজাদপুর,সিরাজগঞ্জ ।