বঙ্গবন্ধু হত্যার চুড়ান্ত রায় ও ফাঁসি কার্যকর

Spread the love

এ্যাড. আলহাজ মোঃ আব্দুল ওহাব (বীর মুক্তিযোদ্ধা )

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ভোরে মোয়াজ্জিন যখন আল্লাহু আকবর ধ্বনীতে আযান দিচ্ছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে সেনাবাহিনীর বিপথগামী ও চাকুরীচ্যুত কিছু ব্যক্তি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য ট্যাংক, কামান, অস্ত্র ,গোলাগুলি নিয়ে ভোর ৫ টার সময় ধানমন্ডির ৩২ নং রোডস্থ বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭ নং বাসভবনে সশস্ত্র আক্রমন করে নির্মম, নির্দয় ও অমানবিক হত্যাকান্ড ঘটায়।
নিহত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। দুই পুত্র বধু সুলতানা কামাল ও রোজি কামাল, ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি কৃষিমুন্ত্রি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তসত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার অফিসার কর্ণেল জামিল, এস আই সিদ্দিকুর রহমান, পেট্রোল ডিউটির সৈনিক সামসুল হক সহ ১৬ জন কে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গীপাড়ায় কড়া নিরাপত্তায় দাফন করে। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলেও সেদিন সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী বা বিচার বিভাগ কেহই সাংবিধানিকভাবে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেনি। খুনিরা কেহ প্রত্যক্ষভাবে, কেহ পরোক্ষভাবে ক্ষমতা ভোগ করে। খুনিরা প্রকাশ্যে জনসভায় বলতো, ১৯৭৫ সালে মুজিবকে খুন করেছি। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি মোস্তাক আহমেদ ইনডেমনিটি/দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারী করে এবং হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের দাবীতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে। অতপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিল করে বিচার কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমে খুনি আসামী সৈয়দ ফারুখ রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মহিউদ্দিন গ্রেফতার হন। পরে ব্যাংকক থেকে আসামী বজলুল হুদাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৭ সালে কে এম মহিউদ্দিন আহম্মদকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৯৬ সালে ঢাকা জেলা ও দায়রা জর্জ জনাব কাজী গোলাম রসুল দীর্ঘদিন বিচার পরিচালনার পর গত ১৯৯৮ সালে ৮ নভেম্বর দঃ বিঃ ৩০২/৩৪ ধারা মতে ১৫ জনকে মৃত্যু দন্ড প্রদান করেন। তাদের নাম হলো-১। লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুখ রহমান ২। লেঃ কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার৩। লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহম্মেদ (আটিলারী) ৪। পলাতক লেঃ কর্নেল আব্দুর রশিদ ৫। মেজর বজলুল হুদা ৬। পলাতক লেঃ কর্নেল শরিফুল হক ডালিম ৭। মেজর শরিফুল হোসেন ওরফে শারফুল হোসেন ৮। লেঃ কর্নেল রাশেদ চৌধুরী ৯। লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহম্মেদ লান্ডার ১০। লেঃ কর্নেল এস এইচ এম বি নুর চৌধুরী ১১। লেঃ কর্নেল আজিজ পাশা ১২। ক্যাপ্টেন কিসমত হোসেন ১৩। ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ১৪। ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ ও ১৫। রিসালদার মোসলে উদ্দিন। অপরদিকে আসামী ১। তাহের উদ্দিন ঠাকুর ২। অনারারী ক্যাপ্টেন আব্দুল ওহাব জোয়ারদার ৩। দফাদার মারফত আলী ও ৪। এল ডি আবুল হাশেম মৃধাকে মামলা দায় থেকে মুক্তির আদেশ দেন। খুনিদের মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। অতপর আসামীরা হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্টের রায় বিভক্ত হলে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে রিভিউ নিষ্পত্তি হয়। গত ২৭/০১/২০১০ তারিখে রাতে আসামী সৈয়দ ফারুখ রহমান , এ কে এম মহিউদ্দিন, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও বজলুল হুদার ফাঁসীর রায় কার্যকর করা হয়। আসামীদের লাশ নিজ নিজ গ্রামের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর জাতি কলংক মুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও রায় চুড়ান্তভাবে কার্যকর করা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই বিচার প্রক্রিয়ার সাথে যারা যুক্ত ছিলেন তারাও ইতিহাসের পাাতায় নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছেন। এই ঐতিহাসিক বিচার কাজে যারা মাননীয় বিচারক ছিলেন ঃ
০১। প্রধান বিচারপতি জনাব তোফাজ্জল ইসলাম।
০২। বিচারপতি জনাব মোঃ মোজাম্মেল হোসেন।
০৩। বিচারপতি জনাব বিকে দাস।
০৪। বিচারপতি এস কে সিনহা।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌশলী ছিলেন জনাব আনিসুল হক, এটর্নি জেনারেল জনাব মাহবুবে আলম,আইনজীবী ছিলেন শেখ ফজলে তাপস নুর, আইনজীবী মেজবা উদ্দিন, আইনজীবী তফিক নেওয়াজ, আইনজীবী আব্দুল মতিন খসরু এবং আইনজীবী রেজাউল করিম প্রমুখ।
রায় কার্যকরী করার সময় উপস্থিত ছিলেন কারা মহাপরিদর্শক আই জি প্রিজন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম খান, পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহিদুল হক, ঢাকা জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিষ্ট্রট জনাব জিল্লুর রহমান, ডি আই জি প্রিজন গোলাম হায়দার , কারা তত্বাবধায়ক ছিলেন তৌহিদুল ইসলাম, জল্লাদ ছিলেন যিনি ৪২ বছরের সাজা প্রাপ্ত আসামী শাজাহানসহ ৩ জন, ইমাম ছিলেন কারা মসজিদের ইমাম মনির হোসেন, সিভিল সার্জল ছিলেন মুশফিকুর রহমান। ঐ সময় স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব আব্দুস সোবাহান বলেন, কারা বিধি মেনেই বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় চুড়ান্ত করা হয়েছে। ফাঁসির রায় কায়কর হবার পর ৫ জনের লাশ নিজ নিজ বাড়ীর ঠিকানায় পাঠানো হয়। তাদের ঠিকানা:
১। সৈয়দ ফারুখ রহমান-নওগার মল্লিকপুর।
২। বজলুল হুদা-চুয়াডাঙ্গার আলম ডাঙ্গায়।
৩। এ কে এম মহিউদ্দিন-লান্ডার পটুয়াখালী।
৪। মহিউদ্দিন আহমেদ- আর্টিলারী পটুয়াখালীর গলাচিপায় কাজিকান্দা।
৫। সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান- ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

পলাতক মৃত্যু দন্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামীদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার জন্য সরকার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের ফাঁসীর রায় কার্যকর করার পর ঢাকাসহ জাতীয় সংসদে রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন, সামাজিক সংস্থা, মসজিদে, মন্দিরে ও গির্জায় বিশেষ দোয়া মাহফিল ও প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছিল। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু নাই , তাঁর নির্মিত রাষ্ট্র বাংলাদেশ আছে। বঙ্গবন্ধকেু এদেশের শিশু-কিশোর তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে চিরদিন গভীরভাবে স্মরণ করবে। দেশপ্রেম শিক্ষা নিবে। বাঙ্গালী জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবি, কবি, প্রাবন্ধিক, রাজনীতিক ও সমাজসেবক।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD