স্মৃতির মণিকোঠায় নিমগাছি হাইস্কুল

Spread the love

আব্দুল কুদ্দুস তালুকদার

(২য় পর্ব)

এরকম ঘটনা এনাতুল্লহা সরকারের বাপ দাদাগনের ক্ষেত্রেও ঘটতো। ওরাও চিঠিপত্র পড়া বা লেখার যোগ্যতা রাখতেন বিশেষ করে ফারসী ভাষায়। কারণ বৃটিশ আমলে সরকারী ফরমান হতো ওদের ক্ষমতা দখলের  প্রথম বা মাঝামাঝি সময়ের দিকে, ফারসী ভাষায়। যেহেতু ওরা ক্ষমতা নিয়েছিল মুসলমানদের নিকট হতে, তাই রাতারাতি সবকিছু একসাথে বদল করা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। অবশ্য বৃটিশ যুগের শেষ দিকে ওরা ইংরেজীর পাশাপাশি ভারতীয় স্থানীয় নানা ভাষা চর্চাকেও উৎসাহিত করতো।  বাংলা বা দেব ভাষা সংস্কৃত চর্চার জন্য  টোল বা গুরুগৃহ সোনাখাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম প্রান্তে কলিয়া-আটঘরিয়া-তালতলায় ছিল মর্মে জানা যায় যা পরে রূপলাভ করে কলিয়া প্রাইমারী স্কুল হিসেবে। অবশ্য তখন সোনাখাড়া ইউনিয়নের নাম ছিল পশ্চিম আটঘরিয়া, যার বর্তমান নাম হয় ১৯৫০ সনে এবং হেড কোয়ার্টার হয় সোনাখাড়ায় ; স্বাধীনতার পর নিমগাছিতে। যেহেতু পরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বেশীর ভাগ নিমগাছি তথা ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চল হতে ফলে ওরা কেউ আর ইউপির শেষ মাথা সোনাখাড়া যেতে রাজী হন নি। কারো কারো ধারণা, নিমগাছির উত্তরে উটরা হাজিপুর মৌজায় যে অর্জুনগড় নামক টিলা বিদ্যমান যা আজ দেবোত্তর সম্পদ ঐ খানে নওগাঁর পাহাড়পুরের মত বিহার ছিল ; যেখানে দেশ বিদেশের শিক্ষার্থীরা এসে পড়াশোনা করতো। যাই হোক,  পরবর্তী সময়ে নতুন উদ্দ্যমে পূরাতন শিক্ষানুরাগী সহ নবীনরা এগিয়ে আসেন  নিমগাছি হাইস্কুলটির শিক্ষা কার্যক্রম জোরালোভাবে চালু করতে। যদিও একই সময়ে ইউনিয়নের হেড কোয়ার্টার সোনাখাড়া গ্রামেও হাইস্কুল স্থাপনের উদ্দ্যোগ নেন তৎকালীন পঞ্চায়েত আব্দুল গফুর তালুকদারসহ তার অনুসারীগন তথা ইউপির পূর্বাঞ্চলের রুপাখাড়া, হাজীপুর, আঁকড়া, শ্রীরামপুরের শিক্ষানুরাগীরা এবং পার্শ্ববর্তী ধুবিল ইউপির কাটারমহল, মালতিনগরসহ সন্নিহিত গ্রামের উৎসাহী মানুষেরা। স্কুলের নামে জমিও দান করা হয় যা বিশাল খেলার মাঠ হিসেবে দীর্ঘদিন কাজে লাগায় এলাকাবাসী। বড় বড় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন হতো এই মাঠে। এছাড়া প্রতিনিয়ত খেলা চলতো স্থানীয় ক্রীড়ানুরাগী তথা খেলোয়াড়দের। কিন্তু স্কুলের জন্য মূল যা দরকার সেই স্কুলঘর না থাকায় অনুমোদন পায়নি  উচ্চ বিদ্যালয়। ফলে বহুদিন পর সেই জমি বা খেলার মাঠ আবাদী ক্ষেতে পরিণত হয় যারা জমিদাতা তাদের ওয়ারীসান কর্তৃক বেদখল হয়। আজো সোনাখাড়া হাইস্কুল স্বপ্ন হয়েই রইল গ্রামবাসী তথা এলাকাবাসীর জন্য। পাশে রুপাখাড়ায় জুনিয়র হাইস্কুল স্থাপিত হলেও এমপিও তালিকাভূক্ত না হওয়ায় তা অচল প্রায় এবং রোদ-বাদলে গবাদি পশুর আশ্রয়স্থল বলতে গেলে এখন। যদিও অদূরে ধুবিল কাটারমহল এবং মেহমানশাহীতে দুটো উচ্চ বিদ্যালয় চালু হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তীতে, চলছে বেশ সুনামের সাথে স্কুল দুটো। নিমগাছি হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক পিয়ার আলী সরকার জানান, ১৯৬৪ সনে নিমগাছি হাইস্কুল ভিজিট করতে আসেন ডাকসাইটে সিএসপি অফিসার যিনি স্বাধীনতা পরবর্তীতে সচিব হিসেবে অবসর নেন এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হন তৎকালীন সিরাজগঞ্জের এসডিও জনাব ইনাম আহমেদ চৌধূরী। তিনি আসেন জীপে চড়ে যা ধূলায় একবারে ঢেকে যায় যখন গাড়ীটি স্কুল মাঠে পৌঁছে। কারণ, পুরো রাস্তা ছিল কাঁচা সিরাজগঞ্জ থেকে পাঙ্গাসী হয়ে নিমগাছি পর্যন্ত। তার আগের রাতে আহম্মদ আলী সরকারের বড় ভাই সেরাত আলী সরকারের গোয়াল ঘর ভেঙ্গে এনে রাতারাতি স্কুলঘর তোলা হয় এবং সেই ঘর ভিজিট করেন এসডিও সাব আর অনুমোদনও দিয়ে দেন। পরে ঘর আরও বড় করা হয় গ্রামে গ্রামে গিয়ে বাঁশ-কাঠ সংগ্রহ করে। তাছাড়া বাড়ী বাড়ী থেকে মুস্টি হিসাবে  চালও সংগ্রহ করা হয় স্কুলের খরচ নির্বাহের জন্য এবং অঘ্রান মাসে ধান । এছাড়া পরে মোরাল হেল্প বা নৈতিক সহযোগিতা করে স্কুল কমিটিকে কিংবা শিক্ষা বিস্তারে এলাকাবাসী যা দিয়ে, তাহলো জায়গীর রাখার বিষয়ে। হাতের কাছে তো সব জায়গায় স্কুল ছিল না। তাই দূরের ছাত্ররা নব প্রতিষ্ঠিত নিমগাছি  হাইস্কুলে ভর্তি হলে আশে পাশের গ্রামের সম্পন্ন গেরস্থের বাড়ী তাদের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হতো কমিটির উদ্যোগে। কমিটির লোকেরা যেহেতু প্রভাবশালী ছিলেন এলাকায় তাই অনেক সময় জোর করেও তাদের চেনা-জানা বা আত্মীয়  স্বজনদের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিতেন জায়গীর। অনেক সময় জায়গীরগন হতেন জায়গীরদারদের স্বজন। এতে ঐ ছাত্রটা মানুষ হলো আর জায়গীরদার বাড়ীতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো ঐ জায়গীরের মাধ্যমে লেখাপড়া শিখলো অর্থাৎ প্রাইভেট টিউটর পাওয়া গেল একজন দূ’মুঠো ভাতের বিনিময়ে।

আমাদের শ্রীরামপুরে বিশেষ করে  তালুকদার বাড়ী সব পরিবারে জায়গীর দেখেছি। কারণ, আমার দাদারা ছিলেন হাজী আহম্মদ আলীর বেয়াই আর আমার বড় চাচা ছিলেন চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, ছোট চাচা হেডমাস্টার আব্দুর রহমান তালুকদার হাইস্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং কমিটির লীডার। ফলে স্কুলের যে চাপ  তা ওদের ঘাড়ে পড়তো এবং সেই চাপ সামাল দিতে সব বাড়ীতেই জায়গীর রেখে দিতেন ওরা নিজ বংশের মাঝে । যেমন – বড় দাদা হাজী ইব্রাহিম হোসেন, যিনি ছিলেন চেয়ারম্যান এর বাবা। তার বাড়ী ছিলেন আট ঘরিয়ার আব্দূর রহমান, পরে ছিলেন দেশিগ্রাম ইউপির বলদী পাড়ার আব্দূল গফুর তার দাদা ছিলেন দেশীগ্রাম ইউপির পঞ্চায়েত চুবান্দী সরকার, আমার দাদার বাড়ী ছিলেন সিরাজগঞ্জ সদরের বহুলী ইউপির মাছিয়াকান্দীর ফরিদুল যার সাথে আমি জীবনের প্রথম হেঁটে যাই সিরাজগঞ্জ শহরে নিমগাছি থেকে দু’দিন ভর। প্রথম দিন সকালে যাই ওর দুলাভাই দরাপ আলী এর বাড়ী রায়গঞ্জের পাশের গ্রাম নিশ্চিন্তপুর। ওখান থেকে বিকেলে সিরাজগঞ্জ রোড হয়ে নলকায় নৌকার ফেরী পার হয়ে রাতে চন্ডিদাসগাঁতী যাত্রা দেখে শেষ রাতে ফরিদুলের গ্রামের বাড়ী পৌঁছি। পরদিন সকাল দশটায় ওর সাথে হেঁটে শিয়ালকোল হয়ে শহরে যাই এবং লক্ষী সিনেমা হলে দুপুরের শো দেখে বিকেলে ওদের বাড়ী আসি। পরদিন বাড়ী আসি চৌধূরী বাসে। বাসের মালিক ছিলেন আবুল চৌধূরী, শহরের খেদন সর্দারের মোড়ে বাসা, এখনও বাসার সামনে গেলে মনে হয় কোনো বিদেশী স্পট। একমাত্র বাস চলতো রোড হয়ে শহরে। ব্রীজ হয়নি নলকায় তখন এবং রাস্তা ছিল হেরিংবন্ড। দূই নৌকা জোড়া দিয়ে ফেরী, তাতে বাস পারাপার। ঘটনা ১৯৭৪ সনের। একমাত্র বাস ফেল করাতে হেঁটে যেতে হয়। জীবনে একবারই যাই এমনভাবে। একদিন ফরিদুল ২০/২৫ জন তাগড়া চেহারার লোক নিয়ে আসে আমাদের বাড়ী, সবার সাথে বিশেষ ধরনের ব্যাগ। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ওরা গেল নিমগাছি গফুর মন্ডলের বাড়ী। মন্ডল বাড়ী থাকতো আর এক জায়গীর নাম আমজাদ। ওর বাড়ীও বহুলী ইউপিতে, গ্রামের নাম খাগা। আমাদের বাড়ীর লোকজন ভয়ে কাঁপে। এলাকা তথা দেশে জাসদের লোকজনের উৎপাত। কেউ কেউ কয় ওরাই পরে সর্বহারা পার্টির সদস্য রুপে আবির্ভূত হয় দেশে; এরশাদ আমলে যাদের জন্য মানুষের ঘুম চলে যায়। একই সময়ে পিয়ার আলী স্যারের বাড়ী এক জায়গীর ছিল নাম সোরহাব। সে পড়াশোনা করতো না, গায়ে চাদর লাগিয়ে ঘুরতো। ওর জন্যই নাকি পিয়ার স্যারের হাজতবাস। কারণ আমাদের বাড়ী থেকে ঐ সব তাগড়া জোয়ানদের বিদায় হবার কিছুদিন পর সোনাখাড়ার সাজাহান তালুকদার খুন হন যিনি ছিলেন ইউপি মেম্বর ও হাইস্কুল কমিটির সদস্য। এর আগেই ফরিদুল আমাদের বাড়ী ছেড়ে চলে যায়। তবে মন্ডল বাড়ীর আমজাদ ও ছারের বাড়ীর সোরহাব ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। মেঝো দাদা বেলায়েত তালুকদারের বাড়ী থাকতেন রয়হাটি গ্রামের জেলহক যিনি পরে ঘুড়কা এলাকার বিশিষ্ট সার ব্যাবসায়ী, ছোট দাদা ছোলায়মান হোসেন তালুকদারের বাড়ীতে ছিলেন তার শ্যালীকার পুত্র ধূবিল ইউপির বেতুয়ার সোনাউল্লাহর ছেলে ছাদেক আলী, চাচা আব্দুল হাই তালুকদারের বাড়ী থাকতেন রয়হাটির আব্দুল মান্নান যিনি জেলহকের ভাতিজা। আব্দুল মান্নান পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকুরী করতেন। আরেক চাচা ফজলার রহমান তালুকদার যিনি ছিলেন আমার বাবার দাদা আমরা বুড়া বাপ ডাকতাম তাকে এবং তার ছোট ভাই আব্দুল হাই তালুকদারকেও। তার বাড়ীতে থাকতেন উল্লাপাড়ার হাটিকুমরুল ইউপির বাগধা গ্রামের ফজলু মাস্টারের ছেলে স্বপন যিনি পরে বিয়ে করেন জায়গীরদারের মেয়ে ফরিদাকে। ফজলু মাস্টার চাকুরী হারিয়ে গরুর ব্যাপারী হন এবং বগুড়া নন্দীগ্রামের রনবাঘা, ওমরপুর, মহাস্থানগড় হাট থেকে গরু কিনে পায়ে হেঁটে ঐ গরু এনে সলংগা হাটে  বিক্রয় করতেন। কি কস্টকর জীবন ছিল তার চিন্তা করলে মাথা নুইয়ে আসে। এভাবে ছেলেকে পড়ান তিনি। (চলবে)

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD