করোনা রোগীর প্রতি এতটা অমানবিক হওয়ার কারণ কি?

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু

বাংলাদেশে গত মার্চ মাস থেকে করোনা ভাইরাসের আক্রমন শুরু হয়। এর তিন মাসের মধ্যেই এই সংক্রামক ব্যাধি দেশের প্রায় সব জেলায় বিস্তার লাভ করেছে। দেশে বর্তমানে এটার সংক্রমন এবং মৃত্যুর হার ক্রমশ উর্দ্ধমুখী। এই প্রেক্ষাপটে অতি সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলায়ও প্রথমবারের মত প্রাদুর্ভাব ঘটল এই প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ ভাইরাসের। আক্রান্ত ব্যক্তিদের একজন উপজেলার তালম ইউনিয়নের চৌড়া এবং অপরজন দেশীগ্রাম ইউনিয়নের কাস্তা গ্রামের বাসিন্দা। তারা দুজন ঢাকায় বহুজাতিক কোম্পানী ইউনিলিভার ও গার্মেন্টস কারখানায় কর্মরত ছিলেন। তাদের মধ্যে চৌড়া গ্রামের করোনা আক্রান্ত রাসেল আহমেদ (২৬) এ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়ীতে ফেরার পথে সম্প্রতি গ্রামবাসীর অপ্রত্যাশিত হামলা ও বাধার মুখে পড়ে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, লাঠিসোটা ও দেশী অস্ত্র হাতে গ্রাম্য ’কাজ্যার’ ভঙ্গিতে তারা রাসেলকে রুখতে চলেছে যাতে সে গ্রামে প্রবেশ করতে এবং তার নিজ বাড়ীতে ঢুকতে না পারে।তাদের ধারণা, সে গ্রামে থাকলে আরো রোগ ছড়াতে পারে। অথচ করোনা রোগীর ক্ষেত্রে আইসোলেশন, হোম কোয়ারেন্টিন ইত্যাকার পদ্ধতিগুলো আজ প্রায় সবারই জানা থাকার কথা। অবশেষে রাসেল সেই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির ফলে বাড়ীতে যেতে না পেরে বাধ্য হয়ে প্রথমে তাড়াশ উপজেলা সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি এবং পরে তাকে সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের কোভিড-১৯ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাড়াশের ইতিহাসে এ এক নির্মম চিত্র, বিরল স্মরণীয় মর্মান্তিক ঘটনা।

এটা যেন যুদ্ধংদেহী নগ্ন আক্রমনের একটা অমানবিক নোংরা চিত্র। এই আগ্রাসী সংঘর্ষে কোন প্রতিপক্ষ নেই। কেউ গ্রামবাসীকে মারতে বা তাদের উপর চড়াও হতে আসেনি। তাদের কোন ক্ষতিও করেনি রাসেল। তার দোষ হল- সে করোনা রোগের শিকার। যে রোগের উপর কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সে নিজেও ইচ্ছে করে এ রোগের ফাঁদে পা দেয়নি। এ মরণব্যাধি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ^ব্যাপী অপ্রতিরোধ্য তান্ডব চালাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। আমাদের দেশেও প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে করোনার থাবা। দেশে চার শতাধিক মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছে এবং প্রতিদিন বাড়ছে সংক্রমন সহ মৃত্যুর মিছিল। এ ব্যাধি হওয়া কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। কোথাও বা এর লক্ষণ কিংবা উপসর্গ পর্যন্ত থাকে না। এ হেন অবস্থায় করোনা আক্রান্ত অসহায় রাসেলের প্রতি তারই নিজ গ্রামের আত্মীয় প্রতিবেশী লোকদের এতটা মারমুখী নিষ্ঠুর অথবা অমানবিক আচরণের কারণ কি? আমাদের বাঙ্গালী সমাজ কি এতটাই নির্দয় আর নিষ্ঠুর হয়ে গেছে যে, মহামারীর মত দুর্যোগপূর্ণ সময়ে একজন নির্দোষ করোনা রোগ পীড়িত ব্যক্তিকে শারীরিক নির্যাতন বা হামলা-হুমকির ভয়-ভীতি দেখিয়ে তার জীবন ও অধিকার হরনের নির্লজ্জ পাঁয়তারা করতে হবে। তার নিজ বাড়িতে যেতে ও থাকায় প্রতিবন্ধকতার ব্যারিকেড দিতে হবে। অবশ্য স্থানীয়ভাবে ফেসবুকে কেউ কেউ এটাকে সন্ত্রাসী কাজ বলে প্রতিকার স্বরুপ আইনী পদক্ষেপের আহবান জানিয়েছেন। তবে বিষয়টা কেবল আইন ও শাস্তি দিয়ে না মিটিয়ে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ মানসের যে দৈন্য ও বৈকল্য প্রতিফলিত হয়েছে,তাকে যথাযথ উপায়ে নিরসনের কথা চিন্তা করতে হবে। আমাদের সমাজ শিক্ষা, সভ্যতা ও চেতনার দিক থেকে এখনো কতটা পেছনে এটা তার প্রকৃষ্ট নজির।

তাদের এই আগ্রাসন আদিম বর্বর যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন মানব সমাজে জ্ঞানবিজ্ঞানের অস্তিত্ব ছিল না। অপরদিকে যারা রাসেলকে গ্রাম থেকে দূরে ব্যবধানে রাখতে চেয়েছে তারা নিজেরাও জটলা পাকিয়ে সামাজিক দূরত্বের ধার ধারেননি যা নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কিন্তু কেন এই পাশবিক চেতনা – পরিবর্তে কেন নেই মানবিক প্রেমের দৃষ্টান্ত। কিছুদিন আগে খবরে উঠেছে, করোনায় মৃত আপনজনকে জঙ্গলে ফেলে এসেছে কে বা কারা। কোন্ মনুষ্যত্বের দৃষ্টিতে এটা সম্ভব, কীভাবে মানুষ তার স্বভাবজাত সহানুভূতি ও মানবিক গুণাবলী বিসর্জন দিয়ে এমনটি করতে পারে। করোনা যে কোন মহুর্তে যে কাউকে আক্রমন করলেই কি তাকে এই দুর্ভাগ্য বরণ করে নিতে হবে। তাহলে এটা মানব সমাজ হল কেমন করে। একজন করোনা রোগীর প্রতি উল্লেখিত চৌড়া গ্রামবাসীর অনভিপ্রেত আচরণ কোনভাবেই মানবিক বিবেচনায় মেনে নেয়া যায় না। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি কোন প্রকার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী পোষন, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা , কুসংস্কার হেতু তাকে বয়কট বা বর্জন করার মানসিকতা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের অহেতুক ভয়, আতংকের বহিপ্রকাশ বশত অসুস্থ করোনা রোগীর প্রতি বিরুপ ও বিদ্বেষমূলক আচরণ মূলত অযৌক্তিক এবং ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। তাহলে মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য- আমরা বলে থাকি কেন? এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লংঘন। উপরোক্ত ঘটনায় হয়তো চৌড়া গ্রামের সবাই অংশ নেয়নি। সকলেই তাই দায়ী নয় । কিন্তু সেজন্য বিবেকের বিচারে ওই গ্রামের সবাই অভিযুক্ত হওয়ার দায় এড়াতে পারে না। কেননা, যারা নিরবে এ অন্যায্য গর্হিত দৃশ্য দেখে চুপ করে বসেছিল তারাও সঠিক কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেটা তাদের নৈতিক দুর্বলতা। বরঞ্চ এই অসুস্থ, অস্থীর এবং অশান্ত পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের এগিয়ে আসা ছিল একান্ত প্রয়োজন, কর্তব্য।

যারা এই অন্যায় তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে তাদেরকে বুঝানো, শেষে না পারলে তাদেরকে বিরত রাখার জন্য গ্রামবাসীকে আইনানুগ পন্থায় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবা উচিৎ ছিল। এমনকি অন্যদিকে রাসেলকে সম্প্রীতিসহ শান্তিপূর্ণ উপায়ে বলে-বুঝিয়ে গ্রামে থাকা না থাকা ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া যেত। কেননা রাসেল তো অন্যদের মত ওই গ্রামেরই সন্তান। এই গ্রাম তারও জন্ম স্থান। করোনার কারণে তাকে মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। বরং সমাজ ও রাষ্ট্রকে এই দু:সময়ে তার প্রতি আরো দায়িত্বশীল, অধিক ভালবাসা ও সহমর্মীতার হাত বাড়াতে হবে। এ মুহুর্তে করোনায় আক্রান্তদের প্রতি আরো যত্নশীল ও মর্যাদাপূর্ণ সহায়তা করা সময়ের দাবি যা অস্বীকার করার নয়। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি ও যাবতীয় সুরক্ষা নিয়মনীতি মেনেই তা করার বিষয়টি স্বীকৃত। মানুষ হয়ে মানুষকে ঘৃনা, হিংসা ও বৈষম্য করা পাপ। তাছাড়া সব ধর্মেই তো আর্তপীড়িতের সেবার কথাই বলা আছে, দূরে ঠেলে দেবার নীতি তো পাওয়া যায় না। করোনাকালে মানুষের প্রতি আরো বেশী মানবিক ও সহযোগী হতে হবে সবাইকে, সে করোনা আক্রান্ত হোক বা না হোক। মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই এই করাল গ্রাসের ঝুঁকিতে আছি, কখন কার কী হবে বলা মুশকিল। দুর্যোগের ক্রান্তিকালে মানুষ, প্রাণী নির্বিশেষে কারো প্রতি উপেক্ষা, অবহেলা ও আত্মস্বার্থপরতার সংকীর্ণ দৃষ্টিকোন অনুসরণ করা অধর্মের কাজ বলে সর্বদাই গন্য । কাজেই করোনার ভয়ে ভীত হয়ে করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে চৌড়ার মতো নির্মমতা আমরা আর দেখতে চাই না। অতি সংক্রামক করোনা ব্যাধিকে ঘৃনা করলেও ব্যক্তি রোগীকে ঘৃনা প্রদর্শনের কোন যুক্তি নেই। কারণ, করোনার দ্বারা কারো জীবন নিস্পেষিত হয়ে একই কারণে যুগপৎ আবার মানুষের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হওয়া অপরিসীম বেদনাদায়ক। এতে মানুষের দুর্ভোগ আরো দ্বিগুন বেড়ে যায়। আধুনিক সভ্য সমাজে এটা কল্পনা করা কষ্টকর। প্রয়োজনে সরকার ও সমাজ নেতৃত্ব এ ধরনের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিপক্ষে অবস্থান নিলে এই দুর্গতি ও দুর্দশার অবসান সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ^াস করি। এর বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত সামাজিক সচেতনতা তৈরী করাও অত্যন্ত জরুরী।

লেখক : কবি ও সম্পাদক।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD