চলনবিলকে ডেল্টা প্রকল্পের অন্তর্ভূক্ত করা সময়ের দাবি

Spread the love
মো. আবুল কালাম আজাদ

গত ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ সারা বিশে^ পালিত হলো ‘বিশ^ জলাভুমি’ দিবস। এবারের বিশ^ জলাভুমি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল‘ টেকসই জলাভুমি ব্যবস্থাপনা: সমৃদ্ধ জীবন’। তথ্যে জানা যায়, গত চার দশকে অসংখ্য জলাভুমি হারিয়ে গেছে। এক দশকেই জলাভুমি হারিয়েছ ২২ শতাংশ। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনষ্টিটিউটের তথ্যমতে,  এধারা অব্যাহত থাকলে আগামি ২০৭০ সাল নাগাদ দেশে কোন কৃষি জমিই থাকবে না। বৃহত্তর জলাভুমি  চলনবিলও হুমকির মুখে পড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় প্রাকৃতিক জলাভুমি রক্ষার কোন বিকল্প নাই। জলাভুমি রক্ষায় আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নাই। জলাভুমি রক্ষায় সচেতনতা তৈরীর পাশাপাশি আইনের কঠোর বাস্তবায়ন চান বিশেষজ্ঞরা।

অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন,সড়ক,বাঁধ,রেলপথ,স্লুইসগেট,ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ এবং দখল-দুষনের কারণে গত চার দশকে ঐতিহাসিক চলনবিলের নদনদী জোলা,খালসহ বিশাল আয়তনের প্রাকৃতিক জলাভুমি হারিয়ে গেছে। উন্নয়নের নামে নানা অযুহাতে অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে ভরাট করা হচ্ছে জলাভুমির আধার।

পাকভারত উপমহাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ প্রকৃতিক জলাভুমি হচ্ছে চলনবিল। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা জেলার ৮ টি উপজেলার ওপড় দিয়ে বর্তমানে চলনবিল প্রবাহিত হচ্ছে।

১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত  মি. ই. বেলফোর সংকলিত সাইক্লোপেডিয়া অব ইন্ডিয়া ভলিউম ৩য় খন্ডে বলা হয়েছে ‘ প্রকৃতপক্ষে চলনবিল ও তার চতুর্পাশস্থ অঞ্চলসমুহের অতিরিক্ত জলরাশি সংরক্ষণের জলাধারবিশেষ। এর সঙ্গে বহু নদী ও জলাধারার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে এবং চলনবিলের বুকে মিশে তারা নিজ নিজ স্বাতন্ত্র হারিয়ে ফেলেছে। বর্ষাকালে বিলটি স্ফীত হয়ে ১২০ বর্গমাইল এলাকায় ব্যপ্তি লাভ করে। এখানে শুধু রাজশাহি জেলা অংশের কথা বলা হয়েছে’।

১৯১৯ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে চলনবিল সম্পর্কে পাবনা অংশে বলা হয়েছে-“ চলনবিল এমন একটি জলময় ভূ-ভাগ যাকে হ্রদ বলা যেতে পারে, যা রায়গঞ্জ ও চাটমোহর থানার বিরাট এলাকা জুড়ে বিদ্যমান। তৎকালে পাবনা জেলায় তাড়াশ ও ভাঙ্গুড়া থানার অস্তিত্ব ছিল না।পরবর্তীতে রায়গঞ্জ থানা হতে তাড়াশ থানা এবং  চাটমোহর থানা ভেঙ্গে ভাঙ্গুড়া থানা গঠিত হয়”। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ারের রাজশাহি অংশে বলা হয়েছে-“ চলনবিল রাজশাহি জেলার একটি বিশাল জলাভুমি যার দৈর্ঘ্য ২২ মাইল, প্রস্থ্য ১০ মাইল।

অতএব রাজশাহি বর্তমান নাটোর জেলা অংশের চলনবিলের ক্ষেত্রফল ২২০ বর্গমাইল এবং পাবনা জেলা অংশের ক্ষেত্রফল ৩৪০ বর্গমাইলসহ চলনবিলের মোট আয়তন দাঁড়াচ্ছে ৫৬০ বর্গমাইল। এর সঙ্গে স্থলভাগের গ্রামসমুহের আয়তন প্রায় ২৫০ বর্গমাইল যোগ করলে চলনবিল অঞ্চলের  মোট আয়তন প্রায় ৯০০ বর্গমাইল। অতীতকাওে চলনবিল অত্যন্ত গভির, স্রোতস্বিনী ,বিপদসংকুল ছিল।এর বিরাটত্ব ও ভয়ঙ্কর রূপ  মানুষের প্রাণে স্বভাবতই ভীতির উদ্রেক করতো।

চলনবিল অঞ্চলের খ্যাতনামা সাহিত্যিক  প্রমথনাথ বিশি লিখেছেন- “অনুমান করিলে অন্যায় হবেনা যে, চারশত বছর পুর্বে এই বিলটি রাজশাহি, পাবনা ও বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়িয়া বিরাজ করিত। ব্রম্মপুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলের পশ্চিমোত্তর অংশে চলনবিল বিরাজিত। অবস্থান, আকৃতি-প্রকৃতি দেখিয়া চলনবিলকে উত্তরবাংলার নদনদী স্নায়ুজলের নাভিকেন্দ্র বলিলে অত্যুক্তি হইবেনা।”

ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া হতে জানা যায়, এককালে নাটোরের লালপুর থানা ব্যতীত প্রায় সমগ্র মহকুমা বিলময় ছিল। অর্থাৎ পদ্মা তীরস্থ লালপুর থানা বাদে নাটোর মহকুমার প্রায় সমগ্র অংশ বিলময় জলাকীর্ণ  নিম্নভুমি ছিল, তন্মধ্যে সর্ববৃহৎ ‘ চলনবিল’।

চলনবিলের পানি পরিবাহক নদীগুলির মধ্যে- পদ্মা,বড়াল,নন্দকুঁজা, নারোদ,আত্রাই,গুমানি, বারনই,চিকনাই,নাগর,খলিশাডিঙ্গি, বেশানি অন্যতম। এছাড়া অসংখ্য জোলা,খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। চলনবিলের বুক চিড়ে প্রবাহিত এসব নদী,খাল ও জোলা দখল এবং অপরিকল্পিত অবকাঠামোর উন্নয়নের কারণে চলনবিলের বিশাল জলাভুমির আয়তন কমতে কমতে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।

চলনবিলের হারানো জলাভুমি পুনরুদ্ধার এবং পুনর্জীবন ফিরিয়ে আনতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প ১ শত বছর মেয়াদী বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ (ডেল্টা প্ল্যান) পরিকল্পনায় চলনবিলকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রকল্পভুক্ত করার জন্য গত ২৮/১/২০২০ তারিখে পাবনার চাটমোহরে পানিসম্পদ মন্ত্রনালয়ের আয়োজনে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় চলনবিল ও বড়াল রক্ষা আন্দোলনের নেতা মিজানুর রহমানসহ উপস্থিত চলনবিল অঞ্চলের প্রতিনিধি সরকারি-বেসরকারি সকল অংশগ্রহণকারিই জোর দাবি জানান। এটা আসলে এখন সময়ের দাবি বটে।

বাংলাদেশ হাওর ও জলাভুমি উন্নয়ন অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়,বিশে^র জলাভুমির আয়তন কমতে থাকায় এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি জলাভুমির উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের আবাসস্থান সংরক্ষণে জাতিসংঘের আয়োজনে ইরানের রামসার শহরে ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি একটি কনভেনশন অনুিষ্ঠত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সাল থেকে ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘বিশ^ জলাভুমি দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭২ সালের মে মাসে রামসার কনভেনশনে বাংলাদেশ যোগ দিয়ে দেশের জলাভুমি সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়।সেই থেকে সরকারি দপ্তর,বেসরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন শ্রেনিপেশার মানুষ জলাভুমির উপযোগিতা ও সুবিধার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে অংশগ্রহণ করে আসছে। রামসার আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী জলাভূমি বলতে বোঝায় নিচু জমি; যার পানির উৎস প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম। এর পানির স্থায়িত্বকাল সারাবছর অথবা মৌসুমভিত্তিক। সামুদ্রিক এলাকার জলাভূমি বলতে ছয় মিটারের কম গভিরতা সম্পন্ন  ভূমিকে বোঝায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী নদনদীর বাইরে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৬ থেকে ৭ শতাংশ জলাভূমি অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি,জলবায়ু পরিবর্তন,জলা বা কৃষিজমির অপব্যবহার, দখল, ভরাটসহ নানা কারণে জলাভূমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে।

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কোন পুকুর, জলাশয়, নদী,খাল ভরাট করা বেআইনি। আবার বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি এমনকি স্বায়াত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। এমনকি ফসলী জমির প্রকৃতি পরিবর্তনও বেআইনী। কিন্তু আইন অমান্য করে জলাভূমিগুলো ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছেন প্রভাবশালীরা।

চলনবিলের প্রাকৃতিক জলাভূমি রক্ষা করতে হলে জলাভূমি আইনের কঠোর বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নাই বলে চলনবিল ও নদীরক্ষা আন্দোলন কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং পরিবেশবিদরা মত দেন। তাই চলনবিলকে প্রধানমন্ত্রীর গৃহিত ডেল্টা প্ল্যানের অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে বিশাল চলনবিলের হারানো জলাভূমি উদ্ধার ও পুনর্জীবন ফিরিয়ে আনার জোর দাবী জানাচ্ছেন বিল এলাকার আন্দোলনকারিরা যা সম্পূর্ণ যৌক্তিক ও যুগোপযোগী।

 

লেখক : বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, কবি ও সাংবাদিক।

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD