প্রসঙ্গ : সিংড়া ইউএনও দর্শন

Spread the love

আব্দুল কুদ্দুস তালুকদার

স্বর্গীয় বন্ধুবর শহরলাল মাহাতোর সুযোগ্য সন্তান নাটোরের সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুশান্ত কুমার মাহাতো ; আমাদের সোনাখাড়া ইউপির অন্যতম বড় গ্রাম পশ্চিম আটঘরিয়ার বাসিন্দা, এলাকার কৃতি সন্তান। গ্রামটি প্রাচীন জনপদ মনে হয়। কারণ, যে কেউ ঐ গাঁয়ের পথ ধরে গেলেই দেখতে পাবেন আশে পাশে পুরাতন ভিটা অনেক যাতে লোকবসতি নেই।এর দ্বারা বোঝা যায় বহু পূর্বে এসব ভিটায় মানুষজন বাস করতো। হয়তো শত্রুর আক্রমনে বা মহামারীর জন্য অথবা বৈরী পরিবেশ হেতু বসতিগণ কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। ভিটেগুলো পড়ে আছে মনুষ্য বসতির নিদর্শন হিসেবে। যদিও বৃটিশ আমলে ইউনিয়নের নাম ছিল ওদের গ্রামের নামেই এবং পঞ্চায়েত ছিলেন আদিবাসী মাহাতো সম্প্রদায়ের।পাকিস্তান-ভারত ভাগ হলে ইউপির নাম বদল হয় এবং সদর দপ্তর হয় সোনাখাড়া হাটখোলায়। বর্তমানে ইউপি অফিস নিমগাছি বাজারে ; বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই। ওর বাবা শহরলাল ও তার সুহৃদ দীলিপ কুমার নিমগাছির কাপড়ের দোকানদার ছিলেন এবং আমি তখন থেকে আজও একজন দোকানী ঐ বাজারেরই। যদিও দোকানদারীর আগে থেকেই জানা শোনা ছিল আমাদের মাঝে পাশের গাঁয়ের অধিবাসী হিসেবে।

ইউএনও বাবু আমাকে বেশ ভালবাসেন স্কুল-কলেজে পড়ার সময় থেকেই। কারণ, তিনি নিমগাছি হাইস্কুল ও কলেজের ছাত্র। আমি স্কুল বা কলেজে গিয়ে সুযোগ পেলেই কুইজের আয়োজন করি ও পুরস্কার দেই শিক্ষার্থীদের, সেই হেতু। গ্রামে আসেন মাঝে মাঝেই তিনি তার মাকে দেখতে বা পরিবারের সবার সাথে মিলিত হতে। তার বাবার নামে কলেজ করেছেন নিমগাছির কড়িতলায় ওটার খোঁজ – খবর নিতেও বটে। তাছাড়া খুবই বন্ধু-বৎসল হওয়ায় বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করাও তার নেশার মত। কাজের চাপের কারণে সন্ধ্যায় এসে রাতেই বা ভোরে ফিরে যায় কর্মস্থলে। গতানুগতিক আমলাদের মত গণ বিচ্ছিন্ন নন তিনি। কিছুটা রাজনৈতিক নেতাদের মত সহজেই মানুষকে কাছে টেনে নেন আপনজন সম। কয়েক মাস আগে তার প্রতিষ্ঠিত কলেজের প্রোগ্রামে প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক আসেন। তার কাছে আবেদন দিলে নিমগাছির টেলিটক সংযোগ চালু হয় কয়দিন পরেই। এতে ইউএনও বাবু খুশী হয় আমার আচরণে আরও। গত শারদীয় উৎসব দূর্গাপূজোয় তিনি তার বোনাসের পাওয়া সব টাকা খরচ করে  রায়গঞ্জ উপজেলার অসহায় মানুষের মাঝে বস্ত্র বিতরণ করেন বিভিন্ন মন্ডপে ঘুরে গভীর রাত অবধি। আমাকে বাড়ী থেকে গাড়ী পাঠিয়ে তুলে আনেন এবং রাত দূটোয় বাড়ীতে পৌঁছে দেন নিজে ; এর দ্বারা প্রমাণ হয় আমার প্রতি তার ভালবাসার গভীরতা। যদিও তার প্রতিষ্ঠিত মাহাতো ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর হলো বস্ত্র বিতরণ পর্ব চলছে। আমাকে তার সিংড়ার অফিসে চায়ের আমন্ত্রন জানায় সে কারণে। তাড়াশ-বারুহাস-পেট্রোবাংলা হয়ে সিংড়ায় কোনো দিন যাই নি। সেই পথ দিয়ে চলার লোভ সংবরণ না করতে পারার জন্যেও বটে । গত ৭ নভেম্বর যাই তার অফিসে। যাওয়ার আগে তাড়াশ চলনবিল বার্তার অফিসে যাই। ওখানে গেলে কয়েক কপি পত্রিকা দিলেন শ্রদ্ধেয় সম্পাদক আমার বন্ধুবর  আবদুর রাজ্জাক রাজু পত্রিকার সিংড়া প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম সুইটকে দেবার জন্য ; কিন্ত ওখানে গিয়ে তার দেখা পেলাম না। ফোনে জানালেন, গ্রামের বাড়ী তিনি। কপিগুলো দিতে বললেন সিংড়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি জনাব এমরান রানাকে। যদিও তার আগেই রানা ভাইয়ের সাথে দেখা উপজেলা অফিসের পুকুর পাড়ে। তিনি চা খাওয়ালেন। তাড়াশ থেকে বারুহাস এর আগে অনেকবার গিয়েছি মেলায় বা জনসভা ইত্যাদি উপলক্ষে। আর একবার গিয়েছিলাম বারুহাস থেকে সিংড়ার আয়াস গাঁয় ২০১৪ সালে, কল্যাণীয়ু কবি দিলরুবা দীনার বাড়ী সৌজন্য সাক্ষাতে। তখন বারুহাসের পশ্চিমের ভাদাই নদীতে ব্রীজ হয়নি, নির্মানকাজ চলছে।

যদিও চলনবিলের জল কমে গেছে তবুও বিলে বেশ পানি, রাস্তা জেগে গেছে। শুধুমাত্র তিশিখালি মাজারের উত্তর-পশ্চিমের ক্যানেলের ব্রীজের ধারে একটু জল গড়িয়ে যাচ্ছে পাকা রাস্তার উপর দিয়ে। রিক্সা-ভ্যান যেতে পারে কোন মতে। ওদিকের ভ্যানগুলোতে আমাদের এলাকার মত বসার সিট নেই তুলতুলে। শুধু তক্তা বিছানো উঁচু করে, তাতে পা ঝুলিয়ে বসে  থাকে যাত্রীরা চারদিকে। ডাহিয়ার বিলে দেখলাম জেলেরা সারা রাত মাছ ধরে নৌকায়, ড্রামে ভরে এনে রাস্তার উপরে আড়তে বিক্রয় করছে সকালে। বিলের মাঝেই সব। কোনো ঘর দুয়ার দোকান -পাট কিছু নেই। স্থানীয়রা জানায়, বারটার পর সব উধাও হয় ; একজন লোক বা একটা নৌকার চিহ্নও থাকে না ওখানে। আবার পরদিন সকাল থেকে মাছের নৌকা আসে। ব্যাপারীদের সাথে আগেই জেলেরা চুক্তি করে রাখে বা ফোনে কথা বলে। মাছ ধরে রাতভর বিলে জাল টেনে বা অন্য উপায়ে, মাছ বেচে দূপুরে বাসায় গিয়ে স্নান সেরে ঘুমায়। এরপর বিকেলে জেগে জাল ইত্যাদি গুছিয়ে সন্ধ্যায় বা তারপরে জলে নামে। এটাই ওদের বিলে পানি থাকাকালীন দৈনন্দিন জীবনযাত্রার স্বাভাবিক চিত্র। দেখলাম বিলের মাঝে ধান কাটছে কৃষক। কেটে নৌকায় ভরে আনছে বাড়ীতে বা বিলের রাস্তায় এনে মাড়াই করছে মেশিনে। আমাদের এলাকার কৃষক ধান কেটে মাথায় বা ভারায় কাঁধে করে আনে মাঠ থেকে। যার জমিতে ভ্যান যাওয়ার সুবিধা সে বাহনে আনে, কেউবা মোষের গাড়ীতে। তবে বিলে আমন ধান হয় বিঘায় ৫/৬ মন যা খুবই হতাশার বিষয় কৃষকদের জন্য। যদিও রোপা আমনের চেয়ে বোনা আমন ধানে খরচ কম আবাদ করতে তবুও লোকেরা তা করে থাকে।বারুহাসের এদিকে বা তিসিখালী মাজারের উত্তরে রাস্তার ধারে চোখে পড়লো জাল দিয়ে ঘিরে অনেকগুলো হাঁসের খামার। ওভাবে খোলা আকাশের নীচে লক্ষ টাকার খামার কল্পনাতীত, যা পড়ে আছে নিতান্ত অবহেলায়। কোথাও পাশে ঝুপড়ীতে থাকে পাহারাদার, কোনো খামারে তাও নেই। হয়তো থাকে দূরে কোথাও ; সময় মত এসে তত্বাবধান করে চলে যায় নিজ আশ্রয়ে। আমার গাড়ীর সঙ্গীরা জানায়, কয়েক হাজার হাঁসের মালিক যে লোকটি সে হয়তো কয়েকজন কর্মচারী রেখেছে প্রাণিগুলোর যতœ নেবার জন্য। ওরা নৌকা নিয়ে বিলে হাঁস ছেড়ে দিয়ে পাহারা দেয়। সাঁঝের বেলা জাল ঘেরা টোপে ফিরিয়ে আনে ওগুলিকে। ডিম পাড়ে জলের ধারের রাস্তায়, জালের বেষ্টনিতে ওগুলি। সিংড়ার মত বলা চলে ছোট শহরের শহরতলীতে টুরিস্ট স্পট নির্মাণ করে সত্যিকার শিল্পমনা মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন পেট্রোবাংলার পাশেই এক উদ্যোক্তা। ধন্যবাদ পাবেন সর্বস্তরের মানুষের নিঃসন্দেহে এজন্য তিনি। বিশেষ করে বর্ষার সময় যখন বিলে নৌকা চলে প্রধান বাহন হিসেবে তখন সেখানে টুরিস্ট আগমন ঘটে উল্লেখযোগ্য হারে। ইউএনও বাবুর অফিসে দেখলাম এমপিদের বাসায় যেমন ভীড় থাকে তার ওখানেও তেমন বিভিন্ন সাক্ষাত প্রার্থীদের প্রতীক্ষা করতে। তবে বেশীর ভাগ সরকারী দপ্তরের কর্তাগণ উপজেলা পর্যায়ের। ওরা এসেছেন তাদের ফাইলে সই নেবার জন্য। এছাড়া নানা ধরনের সাহায্য প্রার্থী তো আছেই। উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যানদের কেউবা এসেছেন তদবির নিয়ে। তাদের বিদায় দিয়ে তাড়াহুড়া করে বের হলেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার মইনুল হাসানের সাথে যার বাড়ী আমাদের রায়গঞ্জের গ্রাম পাঙ্গাসী। তাদের নিয়ে পিআইও সহকারে সিংড়া পৌর এলাকার সোলাকুড়া দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে জেডিসি পরীক্ষা পরিদর্শনে। আমাকেও সঙ্গী হিসেবে নিলেন এবং ফিরে এসে দুপুরে তার বাসায় খাবার নেমন্তন্নও জানালেন। কেন্দ্রে একজন পরীক্ষার্থী দেখা গেল পা দিয়ে পরীক্ষা দিতেছে। তার দুই হাত ও এক পা নেই। নাম তার রাসেল মৃধা, পিতা সোলেমান মৃধা। মাদ্রাসার পাশেই বাড়ী। কেন্দ্র সচিব জানালেন, ৪ শতাধিক পরীক্ষার্থী অংশ নেবার কথা, কিন্ত ঐদিন হাজির ৩৩১। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে ইউএনও ২০০০ টাকা নগদ সহায়তা দিলেন। তার পুরাতন হুইল চেয়ারের বদলে নুতন আর একটা দেবার নির্দেশ দিলেন পিআইওকে।

এছাড়া নাটোরের ডিসি ঐ শিক্ষার্থীকে আরও ২৫ হাজার টাকা দেবেন এমন ঘোষণা দিলেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের জানালেন তার পরিকল্পনার কথা। তিনি এইরকম প্রতিবন্ধিদের জন্য একটা ফান্ড(তহবিল) গঠনের চেষ্টা করছেন যা থেকে তাদের সাহায্য করা যায়। তার অবর্তমানে যিনি আসবেন ইউএনও হিসেবে তিনি এই ফান্ড চালাবেন। চা-পর্ব শেষে দ্রুত বিদায় নিয়ে গেলেন কলম ইউপির কলম গোলা প্রাইমারী স্কুলে। তবে সার্বক্ষনিক ফোন আসছে সিংড়ার বিলে ও আত্রাই নদীতে ভ্রাম্যমান আদালতের অপারেশন চলছে সেই সব পয়েন্ট হতে। ইউএনও নির্দেশ দিলেন কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটকে তিনি যেন পৌর এলাকার নদীতে অপারেশন চালান। কারণ পৌর এলাকায় সব ভিআইপিগন থাকেন । সেখানে নদীতে অপারেশন চালাতে গেলে মন্ত্রীর ফোন আসে। পদে পদে সমস্যা হয়। তাই জেলা থেকে ডিসির নিজস্ব স্টাফ আনা। ওরা বহিরাগত অফিসার, চোখ ব্ুঁজে কাজ করে চলে যায়, ফলে প্রশাসনের ইমেজ ভাল থাকে। আর ইউনিয়ন এলাকা তথা গ্রামের দিকটা তিনি নিজে দেখবেন, ওদিকে অত ভিআইপিদের উৎপাত নেই । তাছাড়া গ্রাম এলাকার মানুষজন মোটামুটি অফিসারদের সন্মান রক্ষা করে চলে এবং তুলনামূলক সহজ-সরল প্রকৃতির ; শহরের লোকদের মত কূটিল স্বভাবের নয়। কলম গোলা স্কুলে ঐ ইউনিয়নের সব স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা এসেছে। বিষয় হলো- “বঙ্গবন্ধুকে জানো মুক্তিযুদ্ধকে জানো” – শীর্ষক আলোচনা। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখলেন ইউএনও। গ্রুপ ছবি তোলা হলো সবার সাথে। সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠান হবার কথা, কিন্ত চীফ গেস্ট গেলেন ২ টার দিকে। কোমলমতি শিশুরা ক্ষূধায় কাতর। বিদায় নিয়ে তিনি গেলেন চামারী ইউনিয়নের সোনাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একই ধরনের প্রোগ্রামে। সেখানেও বক্তব্য দিলেন। তবে ঐ স্কুলে ছিল পুরস্কার বিতরণী সভা। স্কুল কমিটি নিজস্ব উদ্যোগে ফান্ড জোগাড় করে শিক্ষা উপকরণ কিনেছে বিজয়ীদের মাঝে বিতরণের জন্য। ইউনিয়নের ১৮টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীগনের মাঝে তা বিতরণ করা হয়। বিতরণ করেন ইউএনও, শিক্ষা অফিসার ছাড়াও চেয়ারম্যান রশিদুল ইসলাম মৃধা। তবে কেঁদেই পুরস্কার জিতে নেয় এক প্রতিযোগি ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ভাষনের আবৃত্তি শোনাতে এসে ২/৩টা বাক্য বলার পরে সে আর মনে করতে পারে না। ফলে রাগে, দুঃখে কেঁদে ফেলে। তারপরেও একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে ভাষন শোনায় বটে। তবে আয়োজকদের বিশেষ নেকনজর থাকার কারণে কান্নার জোরেই পুরস্কার পেলেন মিনি ডিকসনারী, ঐ ছেলেটি ; যদিও ভাল হয় মেয়েটির আবৃত্তি। শেষে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মাহফুজা খানমের বিশেষ আন্তরিকতায় মিষ্টিমুখ করে বিদায় নেয়া হল। তার আগে মহিলা তার স্কুলের মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার, বঙ্গবন্ধু কর্ণার, পিছনের শহীদ মিনার ঘুরে দেখালেন। আবেদন জানালেন শহীদ মিনারে বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণের, যেহেতু তা স্কুল ঘরের পিছনে অনেক আগেই নির্মাণ করা এবং বেশ অরক্ষিত। তবে তাকে ডিজিটাল টিচার মনে হল, খুবই ফ্রি ও ইজি মাইন্ডেড। জানা গেল, পাশের এক কলেজের প্রিন্সিপালের মিসেস তিনি এবং উপজেলার সেরা টিচারদের একজন। ফেরার পথে গাড়ীতে বসে ফোন পেলেন ইউএনও যে, সোলাকুড়ায় নবম শ্রেণির এক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। সংগে সংগে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে ফোন করলেন তা বন্ধ করতে। সোজা তিনিও গেলেন ঘটনাস্থলে। পাকা রাস্তার ধারে আত্রাই নদীর তীরে বিয়ে বাড়ী, ডেকোরেটেড। যদিও এপথ দিয়ে দূপূরে যাবার কালেও মাইক বাজানো শোনা যায়, তবে বেখেয়ালে তা ওভারলুক হয়। ইউএনও আসার আগেই প্যান্ডেল খুলে ফেলা হয়। মেয়ের পরিবারকে বুঝিয়ে মুচলেকা নিয়ে বন্ধ করেন ইউএনও বাবু বিয়েটি । বরের বাড়ী নন্দীগ্রাম। তাদের নিষেধ করা হয় আসতে।

এর আগে একই গ্রামে অন্য পাড়া মাইক বাজতে দেখে গাড়ী থামিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে গেলেন সেই বাড়ী একাই, কোনো সিকিউরিটি ছাড়াই। গাড়ীর অন্যান্য অফিসারগন জানালেন খুব সাহসী তাদের ইউএনও স্যার। একাই ঝ্ুঁকি নিয়ে ওইভাবে যাওয়া বিপজ্জনকও বটে। অফিসারদের জানালাম, সে আদিবাসী সমাজের সন্তান। ওদের জাতের লোকেরা জন্মেই সাহসী হয়ে। ওদের পূর্ব পূরুষেরা এদেশে আসে বিহার, ঝাড়খন্ড, ছোটনাগপুরের পাহাড় – জঙ্গলে ঘেরা এলাকা হতে বৃটিশ আমলে। তখন আমাদের এলাকা ছিল অরণ্য ভূমি, বাঘ-ভালুকের রাজ্য। হিংস্র পশুদের তাড়িয়ে ঐ সব জঙ্গল সাফ করে জমিদারগনের নিকট থেকে পত্তনী নিয়ে বসবাস করছে বহু যুগ ধরে ওরা বংশ পরম্পরা। কিন্ত রক্ত ওদের সাহসে ভরা। গাড়ী থেকে নেমে ওরাও গেল পিছু পিছু। এখানেও বাল্য বিয়েই বটে। তবে পাত্রের আর দুমাস পরেই বিয়ের বয়স হবে, তাই তাদের বুঝিয়ে চলে এলেন। পথে আসতে এক রিক্সা চালক ইউএনওর গাড়ীর হেডলাইট ভেঙ্গে ফেলে। পরে জানা গেল ঐ রিক্সার ব্রেক খুব দুর্বল। রিক্সাটি জব্দ করে সহকারীর জিম্মায় দিয়ে ফিরে এলেন অফিসে তিনি। বিকেল গড়িয়ে বেলা তখন চারটে পার। তখনও ভিজিটর বসে অনেক। এর মাঝে ঐ রিক্সাচালক এসে পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার চেস্টা করে। কিন্ত ইউএনও বাবু ধমক দিয়ে ভাগায় তারে। শেষে রায় দিলেন ভাঙ্গা হেডলাইট মেরামত করে দিলে রিক্সা ফেরত। রিক্সা রাখা হলো অফিস পিয়নের বাসায়। যদিও রায় দেয়া হয় প্রথমেই বিয়ে বাড়ীর সামনে ভ্যান গাড়ী আটকের সময়। সাক্ষাত প্রার্থীদের বিদায় দিয়ে আমাকে নিয়ে যখন তিনি তার সরকারী বাসায় ফিরলেন তখন প্রায় ৫টা। বাবুর্চি দোতলার ডাইনিং রুমের টেবিলে খাবার দিল। দূপুরের খাবার খাওয়া হলো বেলা ডোবার একটু আগে। একদম বাঙ্গালীয়ানা সাধারণ খাবার, ক্ষুধার পেটে যা ছিল অমৃতসম। খেতে বসে কথা প্রসঙ্গে জানালেন, রান্নার জন্য তার শ্বশুর বাড়ী থেকে একজন কাজের মেয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। যেহেতু তার শিশুপুত্র ও স্ত্রী ডাঃ শাপলা থাকে বগুড়ায়। তাই স্বামী পরিত্যক্ত এই দুঃখী মেয়েটিই ভরসা। সরকারী দোতলা বাড়ীটি বেশ ছিমছাম। সব উপজেলায় একই রকম প্রায়। বারান্দার কোনায় তার মিনি ব্যায়ামাগার। বয়স অনুপাতে তার ওজন একটু বেশী, তাই এক্সারসাইজ করে বডি ফিট রাখার জন্য নানা প্রকার সরঞ্জামের সাহায্যে।

খাওয়া শেষে তার মাকে দেখার জন্য আমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ীর পথ ধরে। পথে আসতে চৌগ্রাম থেকে একজন আদিবাসী নেতাকে গাড়ীতে তুলে নেন তার নির্মিতব্য কম্যুনিটি সেন্টার পরিদর্শন করার উদ্দেশ্যে যা নির্মিত হচ্ছে বামিহালের পাশের বাজারে। আদিবাসীদের জন্য সরকার এমন কম্যুনিটি সেন্টার নির্মাণ করে থাকে। রায়গঞ্জের ঘুড়কা, ক্ষিরতলা, পশ্চিম আটঘরিয়া, খৈচালা সহ দেশের নানা স্থানে এমনটি রয়েছে। সন্ধ্যার পর আধো অন্ধকারে সাইট ভিজিট করেন ইউএনও বাবু। সরকারী দায়িত্ব কি তা বুঝিয়ে দিলেন হাড়ে হাড়ে। সারাদিন দৌড়ের উপর থাকার কারণে সময় মত ভিজিট করতে পারেন নাই, এজন্য সন্ধ্যার পর সেই কর্তব্য পালন। কিন্ত বিপত্তি বাধে ওখান থেকে বিদায় নিয়ে একটু আসার পর। দূর্গাপুরের পশ্চিমে রাস্তা ভাংঙ্গায় ট্রাকের চাকা আটকে পথ বন্ধ। জ্যাম লেগেছে। অনেক পরে সব আটকে পড়া গাড়ীর চালক মিলে ঠেলে তুলে ভাঙ্গায় পতিত গাড়ী। ক্লীয়ার হয় পথ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সবাই। রানীরহাট, কাঁটাগাড়ী, শালিয়াগাড়ী হয়ে জীপটা যখন নিমগাছি পৌঁছে তখন বেশ রাত। গাড়ী থেকে নেমে শুভ কামনা জানিয়ে বিদায় নিলাম বটে তবে হৃদয়ে গাঁথা রইল একটা এমন দিনের ছবি যা আমরণ মনে থাকার মত। বাইরে থেকে দেখে অফিসারদের চাকুরী কি আরামের মনে হয় কিন্ত আসলে তা নয়। তাই লোকে কয় – যার যেমন মাথা, তার তেমন মাথার ব্যথা..

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD