ধানের দাম না থাকলেও থেমে নেই কৃষিচাষ

Spread the love

বিশেষ প্রতিনিধি ঃ চলনবিলের কৃষকের ঘরে ঘরে নেই কোন আনন্দ। এ বছর কৃষক যে মূল্যে ধান উৎপাদন করেছেন তার থেকে অনেক কম মূল্যে তাদের ধান বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে বিঘা প্রতি তাদের ৪,০০০ থেকে ৫০০০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে যখন চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছি, কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছি তখন তারা অভিমানের সঙ্গে জানিয়েছেন যে, তারা আর ধান চাষ করবেন না, অন্য ফসল চাষ করবেন কিংবা চাষাবাদই ছেড়ে দিবেন; অথবা কল-কারখানায় কুলি-মজুরের কাজ করবেন, তবুও ধান চাষ করবেন না। কারণ, একজন দিনমজুরের দাম ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা, অথচ এক মন ধানের দাম তার চেয়ে কম। এখন কথা হলো সত্যিই যদি আমাদের কৃষকরা অভিমান করেন, তবে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা কি আর এখনকার মতো থাকবে? আসুন দেখা যাক চলনবিলের কিছু উপজেলার কৃষকের অবস্থা।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা ধান চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন এবং অন্যান্য ফসল, যেগুলো চাষে কম পরিশ্রম ও খরচ কম হয় কিন্তু দাম ভালো পাওয়া যায়, সেগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।

ভাঙ্গুড়া উপজেলার ধান চাষীরা ধানের পরিবর্তে মাছ, গম, ভুট্টা, ডাউল, কালোজিরা চাষে ঝুকে পড়েছেন! চাটমোহর উপজেলার কৃষকরা ধানের পরিবর্তে অগ্রিম শাক-সবজি, রসুন, পিয়াজ, শরিষা, আলু, মাছ চাষ, কিংবা ভুট্টা চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন। গুরুদাসপুর উপজেলার কৃষকরা ধানের পরিবর্তে মাছ, লিচু, আম, কাঠাল, রসুন, পিয়াজ, ভুট্টা, পাট চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন। সিংড়া উপজেলার কৃষকরা ধানের পরিবর্তে ভুট্টা, খিরা, তরমুজ, রসুন, শরিষা, কালাই, শাক সবজির চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাড়াশ উপজেলার কৃষকরা ধানের পরিবর্তে মাছ চাষ, শরিষা, খিরা, ভুট্টা, রসুন, পাট, তিল শাক সবজির চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন।

চলনবিলে পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ায় পানির সংকট এখন নিত্য দিনের সমস্যা তবুও কৃষকরা এতোদিন ধান চাষ করে আসছিলেন। ধান চাষে লাভ না হওয়ায় এই অঞ্চলের কৃষকরা ফসলী জমি খনন করে মাছ চাষ শুরু করেছেন। গত আগষ্ট মাসে কয়েকটি উপজেলা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে শত শত শিক্ষিত তরুণ এখন মাছ চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।

কৃষি-সম্প্রসারণের তথ্য মতে, চলনবিলে কয়েক উপজেলায় গত ৮-১০ বছরে ধানী জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর। আগে এসব জমিতে ধান হতো এখন ভালো দামের আশায় কৃষক বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি (বিশেষ করে অগ্রিম) এবং উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদ করছেন। অন্যদিকে এবার চলনবিলের বিভিন্ন উপজেলায় আমন ধানের চাষ হয়েছে ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে। ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষক হতাশ থাকলেও থেমে নেই আমন ধানের চাষাবাদ। নতুন স্বপ্ন দেখছেন হাজার হাজার কৃষক। ধানের ন্যায্যমুল্য পেলেই কেবমমাত্র কৃষক তাদের ক্ষতির পরিমান পুষিয়ে নিতে পারবে। বাংলাদেশে বছরে চালের চাহিদা হলো সাড়ে ৩ কোটি টনের কিছু কমবেশি এবং গত অর্থবছরে আমাদের চালের উদপাদন ছিলো প্রায় ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০ লাখ টন চালের উদ্বৃত্ত উদপাদন হয়। (তথ্যসুত্র– বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাসকিং মিল ওনার্স এসোসিয়েশন)।অন্যদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর তথ্য মতে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ২১ কোটি এবং চালের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ মেট্রিক টন।

দেশের ধানের ফলন বর্তমানের মতো অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে বছরে উদপাদন হবে প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখ টনের কিছু বেশি।তার মানে হলো, ২০৫০ সালের আগেই হয়ত আমাদের আবার দেশের বাইরে থেকে বড় অংকের চাল আমদানি করতে হবে। কিন্তু, দেশে সরকার যে দরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে পারে, বিদেশ থেকে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দরে চাল আমদানি করতে হয়। তবে দেশের কৃষকদের ধানের নায্য মূল্য নিশ্চিত করতে পারলে হয়ত বাংলাদেশের ‘খাদ্যে  স্বয়ংসম্পূর্ণ’ সুনামটা ধরে রাখতে পারবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কা বা আতঙ্ক তৈরি হবে না। বরং উদ্বৃত্ত খাদ্য বিদেশে রপ্তানী করার যেেেত পারে।

তাই পরিশেষে বলা যায়, যে কৃষকের পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো তাদের প্রতি উদাসীনতা দেখালে তো আর সেই স্ট্যাটাসটি থাকবে না। সরকারের এ বিষয়টিতে বিশেষ নজর দিতে হবে।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD