মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিকথা
৪র্থ পর্ব
আবদুর রাজ্জাক রাজু
এমনিতেই দেশে তখন থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তানী সেনা বাহিনি। সে দিন ছিল বাংলা ৪ জৈষ্ঠ্য। খুব সম্ভবত ইংরেজী ১৮ অথবা ১৯ মে ১৯৭১ সাল। তাড়াশ সদরে একাধিক স্থানীয় জনতার দল দিবারাত্রি পালাক্রমে পাহাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। যাতে বহিগরাগতের অনুপ্রবেশ বা আক্রমণ না ঘটে। তাই এটা ছিল কার্যত মিলিটারি আগমণের সতর্কতা সম্পর্কে নজরদারি। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জানমালের নিরাপত্তাই ছিল এই পাহাড়ার মূল লক্ষ্য। কেননা তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার ও তার সমর্থকদের ক্ষোভ-আক্রোশ ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙ্গালীর ওপর থাকলেও বেশী ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। ওই দিন তাড়াশের স্বপন কুমার মাল ও সন্তোষ কুমার বাবুরা পূর্ব পাড়ায় পাহাড়ার দায়িত্বে ছিলেন। এই স্বপনদের বাড়ীতেই লুকিয়ে ছিলেন তাড়াশে তদান্তীন গণ আন্দোলনের শীর্ষ সংগঠকদের অন্যতম সাবেক সাংসদ গাজী ম.ম আমজাদ হোসেন মিলন ও তাড়াশে কর্মরত তৎকালীন এক পুলিশের ছেলে মি. খোকন প্রমূখ বলে জানা যায়। আরো কিছু গণ-আন্দোলন কর্মী তাড়াশ গ্রামের বিভিন্ন বাড়ীতে যুগপৎ গোপন আশ্রয়ে ছিলেন। তত দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী মিলিটারী বাহিনী বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে। ২৬ মার্চের কালরাতে ঢাকায় গণহত্যা চালাবার পর তারা পাশবিক কামড় হেনে আগ্রাসন চালাচ্ছে সাড়া দেশের জেলা শহর ও গ্রামগঞ্জের জনপদে। সেসব খবর আমরা বিশেষত: বিবিসি বেতার মারফত প্রায় দিনই পাচ্ছিলাম। তাড়াশেও সবাই ছিল ভীত সন্ত্রস্থ। এই যে কখন কোন দিক দিয়ে তাড়াশে ঢুকে পড়ে হানাদাররা সেই ভয়ে তটস্থ সবাই।
ইতোমধ্যেই স্বাধীনতা বিরোধী দালালচক্র রাজাকাররা তৈরী হয়ে গেছে হানাদারবাহিনীকে সহযোগীতা করতে। তাড়াশের মজিবর-মোকছেদ ভ্রাতৃদ্বয় জুটি বেঁধে শান্তি কমিটির নেতা বনে গিয়েছেন। এলাকার খ্যাত-অখ্যাত কিছু তরুণ-যুবকেরা পথ ভ্রষ্টতা, লোভ-লালসা আর নষ্টামিতে মেতে নেমে পড়েছে রাজাকার-আলবদরদের ভূমিকায়। সীমাহীন আতঙ্ক আর আশঙ্কায় কেবলি প্রহর গুনছে প্রতিটি মানুষ। চতুর্দিকে বিভৎস ভীতির ভয়াল পরিবেশ। মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। চরম নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি। সর্বনাশের অশনি সংকেত বাঙ্গালী জীবনের প্রাত্যাহিক নিদ্রা হারাম করে দিয়েছিল। ভয়াবহ অজানা ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে সবার জন্য। যতদূর মনে পড়ে, এর আগে তাড়াশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে অধিকাংশ চলে গেছেন জীবনের ভয়ে। অল্প সংখ্যক সংখ্যালঘু মানুষ তখনো বাড়ীতে বাপ-দাদা-চৌদ্দপুরুষের ভিটে কামড়ে পরে আছেন। জন্মভূমির এই মায়া যে কত বড় মায়া তা মনে হয় মৃত্যুও কেড়ে নিতে দ্বিধা করে। মানুষ অনেক কিছু হারালেও আপনজনদের ভিটে তথা মাতৃভূমির মমতা ত্যাগ করতে বা হারাতে চায় না। এটা যে মায়ের মতই। এর মহব্বত ও আকর্ষণ দুর্বার। মৃত্যুর বিনিময়েও থাকতে চায় মায়ের কোলে আপন ভুবনে নিরবে ঘুমিয়ে। অবশেষে ওই দিন ভোর ৫টার দিকে তাড়াশ-ভূইয়াগাঁতী সড়ক পথে এসে হামলা শুরু করে পাকিস্তানী বাহিনী। কেউ বলছেন, ওরা ভাদাস গ্রামের ভাঙ্গা স্থলে এসে গাড়ী পার করতে না পেরে পায়ে হেঁটে তাড়াশ পূর্ব পাড়ার আয়েজ উদ্দিনের বাড়ীর (আজকের নুরুল ইসলাম ওরফে নূরু) পাশ দিয়ে দুই দলে বিভক্ত হয়ে চুপিসারে ভারী অস্ত্র সজ্জিত হয়ে গ্রামের ভেতরে ও বাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদের মতে জান্তারা এসেছিল তাড়াশ সলংগা সড়ক পথে। এরা অন্তত ২/৩টি গাড়ীতে ২০-৩০জন এসেছিল বলে অনেকের ধারণা।
অবশ্য এর অনেক পূর্বে প্রথমে রায়গঞ্জের সোনাখারা ইউনিয়নে হানাদাররা অপারেশন করে বলে বিশ^স্থ সূত্রে প্রকাশ পায়। পরে ওরা তাড়াশ আক্রমণের উদ্দেশ্যে অভিযান চালায়। সেদিন ভোরের সূর্য কেবল উঠি উঠি করছে। মসজিদে মুয়াজ্জিনের আযান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। অনেকেই তখনো বিছানায় নিদ্রামগ্ন। এরই মধ্যে আরম্ভ হয় গোলাগুলি। তখন অব্দি কোন প্রতিরোধ বা প্রতিপক্ষ ছিল না তাদের। এক তরফা এবং নির্বাধায় তারা প্রধানত: হিন্দুদের বাড়ী ঘরে চড়াও হয়। ওরা ঢুকেছিল তাড়াশের পূর্ব পাড়া অর্থাৎ কোনাই পাড়া দিয়ে। পরে সেখান হতে তাড়াশের মধ্যে পাড়া এবং সবশেষে পশ্চিম পাড়া হিন্দু অধ্যুষিত বসতি এলাকায় নির্বিচারে গুলি ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এদেরকে সহায়তা করে স্বাধীনতা বিরোধূী স্থানীয় রাজাকার ও দালাল দোসররা। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন তাড়াশ পূর্ব পাড়া তথা কোনাই পাড়ার রামকৃষ্ণ দাস, ক্ষিতিশ চন্দ্র দাস ও সত্য রঞ্জন দাস। এছাড়া মধ্য পাড়ার সতীন্দ্রনাথ ঘোষ, মহাদেব সাহা তাড়াশ পশ্চিম পাড়া অর্থাৎ গোঁসাইবাড়ী মহল্লার খুন হন চুনি লাল গোস্বামী, হিরালার গোস্বামী ও দীনেশ চন্দ্র সিংহ। সেসময় দুজন মাত্র মুসলিম তাড়াশ দক্ষিণ পাড়া নিবাসী সেকেন্দার আলীর পিতা আমজাদ হোসেন ও তার চাচা নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। মুসলিম দু’ব্যক্তির গুলি খাওয়ার কারণ হল- তারা মিলিটারী দেখে ভয়ে দৌড়ে গিয়ে পানিতে ডুব মারে। কিছুক্ষণ পর যখন জলের ভেতর থেকে উপরে মাথা তুললে সেনারা আকস্মিক গুলি করে তাদের মেরে ফেলে। এভাবে সর্ব মোট ১০ থেকে ১১জন তাড়াশ অপারেশনের প্রথম নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
এদের মধ্যে মহাদেব সাহা মাষ্টারকে পিশাচেরা পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচরে অবর্ণনীয় কষ্ট-যন্ত্রনা দিয়ে পরে গুলি করে হত্যা করে বলে জানা যায়। ভোর বেলার ওই সময় তিনি নিজ বাসায় তার স্ত্রীর ‘দশা’ (হিন্দুয়ানী পর্ব) উপলক্ষে স্ত্রীর সাথে খইমুড়ি মাখিয়ে প্রসেস করছিলেন পার্বনের জন্য। ওই দিনের এই বিভিষিকাময় ঘটনার পর পরই তাড়াশে প্রায় সব সনাতন ধর্মালম্বী মানুষ ভারত গমনের উদ্দেশ্যে মাতৃভূমি ত্যাগ করে। তাদেরকে সুদীর্ঘ দুর্গম পথে যেতে সহায়তা করে তৎকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী তাড়াশের একদল তরুণ ও যুবক যাদের অনেকে পরবর্তীতে মুক্তিফৌজ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এদের কয়েকজন পরবর্তীতে ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা যুদ্ধেও যোগ দেয়।
সেদিন আমি নিজ গ্রাম আশানবাড়ীতেই অবস্থান করছিলাম। আমাদের গ্রাম তাড়াশের খুব সন্নিকটবর্তী হওয়ায় সকাল বেলা থেকেই আমরা তাড়াশে মিলিটারী অপারেশনের খবর পাচ্ছিলাম। দীর্ঘ সময় ,কখনো থেমে থেমে , কখনো বা একটানা বিভিন্ন প্রকার গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এমনকি কিছু গুলি আমাদের টিনের ঘরের একপাশে পড়লে বিকট শব্দ হয়। এতে আমরা ও প্রতিবেশীরা সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ি। তখন তাড়াশ-বিনসাড়া রাস্তা ছিল মেঠো পথের মতো। আমরা গ্রামের অনেক লোকজন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকি কোন পথচারী এলে তার কাছে তাড়াশের মিলিটারী আগ্রাসনের খবর জানতে। কিন্তু সবগুলো রাস্তাঘাট ছিল জনশূণ্য, হাহাকার। তাছাড়া শুস্ক মওসুমে তাড়াশ-আশানবাড়ী চলাচলের মুখ্য পথ ছিল মাঠের মধ্যে দিয়ে সোজা রুট। অপরদিকে আশানবাড়ী, কহিত ভাদাশের মতো নিকটস্থ গ্রামগুলি হতে বহু মানুষ ইতোমধ্যে সরে গিয়ে পার্শ¦বর্তী গ্রামে সাময়িক অবস্থান করছিল মিলিটারী আসার ভয়ে। কারণ তাদের আশংকা ছিল পাকিস্তানী বাহিনী এসব গ্রামেও চড়াও হয় কিনা। যদিও সে মুহুর্তে বাস্তবে তা ঘটেনি। তবে পরবর্তীতে তাড়াশে পাক-সেনাঘাঁটি গাড়লে পাকিস্তানী বাহিনী স্থানীয় রাজাকার-আলবদর-শান্তি কমিটির লোকদের সহায়তায় তাদের আঁতাত ও মদদে বিভিন্ন গ্রামে ও হাটবাজারে গিয়ে লুটপাটসহ নানা অপকর্ম ও খুন খারাবিতে লিপ্ত হয়েছে। তবে মিলিটারী অপারেশনের পরবর্তী সময়ে তাড়াশে হিন্দুদের বসতবাড়ীতে ব্যাপক লুটপাটের খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পরে। আামি তাড়াশ আসার জন্য বার বার আগ্রহ প্রকাশ করলেও আমার পিতা ওই লুটপাটের সময় সেখানে যেতে প্রবলভাবে বাধা এবং সর্তকভাবে চলাফেরা করতে পরামর্শ দেয়। অবশেষে নিজের ব্যাকুলতা ও কৌতুহল চাপতে না পেরে আছর নামাজের সময় পিতার নামাজে ব্যস্ত থাকার ফুসরতে আমি তাড়াশ চলে আসি কিছুটা লুকোচুরির মাধ্যমে। তাড়াশ গ্রামে প্রবেশের পথে লোকজনকে নানা জিনিষপত্র নিয়ে যেতে দেখলাম কাঁধে ও মাথায় করে। মূলত: এগুলো ছিল হিন্দুদের বাড়ীতে লুটের মালামাল। আমি প্রথমে আসি মধ্যে পাড়ায় আজকে যেখানে রজত ঘোষদের বাসা। সেখানে তার চাচা সতীন্দ্রনাথ ঘোষের মাটিতে পরে থাকা মরদেহ হতে এক পা বিচ্ছিন্ন দেখতে পাই। মনে হয় গুলি করার পর বেওনেটের আঘাতে তার পা কেটে ফেলা হয়েছে। এ পাড়াতে ও পশ্চিম পাড়াতেও তখন অবধি আগুনের ধোয়া উঠছিল বিভিন্ন স্থাপনা ও ঘরবাড়ী পোড়ার। ছিন্নভিন্ন মানুষের লাশ আর পরিবারের অসংখ্য জিনিষপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে যত্রতত্র। মনে হচ্ছিল, গোটা অপারেশন এলাকা একটা জনমানবহীন শশ্মানে পরিণত হয়েছে। কারণ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যে গ্রাম-পাড়া বা লোকালয়েই হামলা চালিয়েছে সেখানেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, লুটপাট করেছে ও নারীদের সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছে। তারা হয়তো শুধু মানুষ মেরেই তুপ্ত হয়নি, তাদের সহায় সম্পদ ও মালামাল ভষ্মীভুত করেও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। আমি যখন গোসাই বাড়ী দেখতে যাই তখন হীরালাল গোস্বামীর বিশাল দেহ রক্তাত্ত অবস্থায় তাদের উঠানে পড়ে ছিল। তার শবদেহের নানা স্থানে জখমের বিভৎস চিহ্ন দেখে গা শিউড়ে উঠে। শুনতে পাই যে , হীরালাল বাবু তার ঘরের দোতালার উপর থেকে জানালা দিয়ে পাক সেনাদের প্রতিরোধ তথা আক্রমণ করে। এসময় পাকবাহিনি কাঁধে পরিচালিত মেশিন গানের সাহায্যে তাকে প্রচন্তভাবে পাল্টা আক্রমণ করে বসে।
এ ঘটনায় হীরালাল বাবুর দোতালার দক্ষিনের জানালার পাশে দেয়াল কিয়দাংশ ভেংগে পরার চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় যা আজো বিদ্যমান। তবে অন্যদের ভাষ্য মতে, আর্মিরা তাড়াশ বাজারে হীরালাল গোসাইকে দেখতে পেলে তিনি তাড়া খেয়ে প্রাণ ভয়ে দৌড়ে গিয়ে নিজবাড়ীর দেয়াল ঘরের দোতালায় উঠে পড়েন। সেসময় দুজন পাক সিপাই মই বেয়ে তাকে ধরতে েেগলে তিনি তাদের কুপিয়ে মেরে ফেলেন। এ ঘটনার পর হীরালাল বাবু আপনা আপনি দিকবিদিক জ্ঞানশুণ্য হয়ে দৌড়ে পালাতে গেলে কহিতের মাঠের মাঝখান মতান্তরে দস্তল হতে তাড়াশের শান্তি কমিটির দালাল ও রাজাকারদের সহায়তায় পাকড়াও করে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। একই আঙ্গিনায় চুনিলাল গোসাইও যুগপৎ নিহত হন। তারা ছিলেন পরস্পরে আপন ভাই। পাশেই প্রতিবেশী দিনেশ চন্দ্র সিং ছিলেন তাড়াশ বাজারে বস্ত্র ব্যবসায়ী। তিনিও হানাদারদের হাতে নিষ্ঠুরভারে মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখিত হীরালাল গোস্বামী ও চুনিলাল বাবু উভয়ই ছিলেন তাড়াশ উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির বর্তমান সভাপতি আজকের তপন গোস্বামীর জেঠা বা চাচা। তৎকালে তারা ছিলেন তাড়াশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয়। বিশেষত: হীরালাল বাবু খুবই সাহসী ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় মানুষের পরিভাষায় তার ব্যক্তিত্ব ছিল কিছুটা বাঘের দাপটের সাথে তুলনীয়। তার শারিরীক চেহারাও ছিল সেনাবাহিনীর লোকদের মতো বিরাট বপু বিশিষ্ট।
পাক বাহিনীর হাতে জীবন উৎসর্গিত তাড়াশের এসব শহীদের ইতিবৃত্ত অদ্যাবধি কেউ লিখেনি। ফলে বর্তমান প্রজন্মের নিকট এসব বীর শহীদানের আত্মবিসর্জনের মর্মান্তিক কাহিনী এক অজানা অধ্যায়। এছাড়া তাড়াশ অপারেশনের প্রথম প্রহরে কত হিন্দু বা মুসলিম পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়; কারা শাহাদত বরণ করেন, কে বা কারা প্রতিরোধ গড়ে তুলে জীবন বিসর্জন দেন এবং লুটপাটের বিবরণসহ স্থানীয় কাদের ভুমিকা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে-বিরুদ্ধে তথা পাকিস্তানী সেনাদের সপক্ষে দালাল-দোসর হিসেবে কাজ করেছে তারও সঠিক বিস্তারিত তথ্য কালের প্রবাহে হারিয়ে যেতে বসেছে। যদিও আমি অত্যন্ত কৌতুহল নিয়ে এই লোমহর্ষক চিত্র দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু স্বচক্ষে সামান্য কয়েকটি দৃশ্য অবলোকনের পর আমি মনের ভেতরে অস্থীরতা তথা নার্ভাসনেস অনুভব করি। সে কারণে তাড়াশ সরকারী প্রাথমিক স্কুলের আমাদের অত্যন্ত পূজনীয় আদর্শবান ও গুণী শিক্ষক মহাদেব সাহার মিলিটারীর হাতে নিহত হওয়ার খবর শুনেও তাকে দেখতে যেতে মানসিক বল এবং সাহস হারিয়ে ফেলি। কারণ তাকে ঘিরে আমার হৃদয়ে ছিল গভীর ভক্তি ও ভালবাসা। স্মর্তব্য, মহাদেব সাহা বর্তমানে জীবিত তাড়াশ বাজারের মুদিখানা ব্যবসায়ী কালা শাহ্র আপন দাদু। সেই পরম শ্রদ্ধার ও ভালবাসার প্রিয় মানুষটির নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে হত্যা করার দৃশ্য কল্পনাও করতে পারি নি অন্যের বেলায় যা পেরেছি। তাই ভগ্ন হৃদয়ে তৎক্ষনাৎ শুধুই তার সোনালী স্মৃতি ও মুখচ্ছবি আপন মনে খুঁজে ফিরছিলাম। তিনি ছিলেন আমার শৈশবের প্রাথমিক বিদ্যাপীঠের প্রথম শিক্ষক। তার এই বিষাদময় পরিণতির কথা শোনামাত্র আমি কত যে কেঁদেছি তা ¯্রষ্টা ছাড়া আর কেউ জানে না। তার মত অমায়িক,সৎ, সরল,ভদ্র,নীরিহ ,নিষ্ঠাবান, খ্যাতি বিমুখ , আপন ভূবনে নিভৃতচারী এক বিজ্ঞ-বিদগ্ধ শিক্ষক আমার জীবনে আজো দেখতে পাই নি। তিনি ছিলেন প্রবাদতুল্য ক্ষণজন্মা পুরুষ যার তুলনা মেলা ভার। এতো উচ্চ মানের মানবিক গুণে গুনান্বিত মানুষ এবং আদর্শবান শিক্ষক ইদানিং আমাদের সমাজে বিরল। তার যেমনি ছিল না শত্রু তেমনি ছিল না নিন্দুক। তার চলা ও বলার রীতিনীতি এবং আদব-আদর্শের ধরন আমাদের স্মৃতির আখরে এক অমূল্য পাথেয়। সে যেন মানুষরুপী এক দেবতা। তাকে যে না দেখেছে, তার পক্ষে তাকে কেবল কল্পনায় উপলব্ধি করা কঠিন।
[নিবন্ধটিতে তথ্যগত কোন ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তা লেখককে জানালে বাধিত হব] মোবাইল: ০১৭১৬-১৮৭৩৯২