হারিয়ে যাচ্ছে নৌকা-অপেক্ষা করছে মছিবত

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু

 

গত ক’দিন আগে আমার নাতি ‘নীলের’ (রোবায়েত) চলনবিল ভ্রমণের বায়না রক্ষার্থে চলনবিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তার পূর্বের দিন বিকেলে তাড়াশের পশ্চিম ওয়াপদা বাঁধে যাই আগাম নৌকা ভাড়া করতে। শান বাঁধা নৌকা ঘাটে বসা লোকেরা জানালো, এখানে কোন নৌকা পাবেন না। শুনে প্রথমে আমি হকচকিয়ে উঠি। তখনো বুঝে উঠতে পারি নি ব্যাপারটা। কেন ? জিজ্ঞাসা করতেই ওরা বলল, বন্যার পানি এলেও কোন ধরনের নৌকা এখানে তথা এই এলাকায় ঢুকতে পারছে না। কারণ, রাস্তার পাশের খাল ভরাট করে বাড়িঘরসহ নানা রকম স্থাপনা নির্মাণ ও অসংখ্য পুকুর তৈরীর ফলে একদিকে জলাবদ্ধতা অন্যদিকে তাড়াশের সাথে নৌযান চলাচলের সব পথ ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে তাড়াশ-কুন্দইল সড়কের উভয় পাশে দখল-ভরাট করার ফলে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাই ভরা বর্ষায়ও ছোট-বড় কোন নৌকাই এবার তাড়াশ ওয়াপদা বাঁধে এসে লাগাতে পারছে না। গত বছরও সমস্যা এতটা প্রকট ছিল না। তাড়াশে নৌকা ভিড়তো এবং লোকজন ওয়াপদাবাঁধের ঘাট থেকে উঠানামা করতে পারত। এবার পুরো বর্ষা মওসুমেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এই যে চিরচেনা পরিস্থিতি পাল্টে গেল তা আর কখনো ফিরে আসবে তেমনটি ভাবা দুরাশা মাত্র। আর এটা একদিনেও হয়নি; যুগের পর যুগ ধরে এই নৈরাজ্য চলছে নির্বাধায়। ভবিষ্যতে  সেদিন আর দূরে নয় যেদিন দীঘি থেকে নয়, হয়তো পর্যায়ক্রমে মাকোড়শোন অতপর কুন্দইল গিয়ে নৌকায় উঠে চলনবিল ভ্রমণ করতে হবে। মোট কথা, তাড়াশকে তখন আর চলনবিল মনে হবে না। তবে এটা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে কেবলমাত্র ঘটে নাই, মানুষের লোভ, আগ্রাসী এবং অপরিণামদর্শীতার পরিণতি মাত্র। এর ভয়াবহতার সীমা বর্তমানে অনুমিত ক্ষতির মাত্রাকে  পরবর্তীতে বহুগুনে অতিক্রম করবে। মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের সাথে সাথে দেখা দেবে দীর্ঘস্থায়ী দুর্যোগ ও দুর্ভোগ যার কোন পরিসীমা থাকবে না। তখন ঢাকার বুড়িগঙ্গা-তুরাগ নদে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর মত এখানেও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে অবৈধ সবকিছু অপসারণের। তানাহলে এলাকার জনজীবন দীর্ঘমেয়াদে দুর্বিসহ হয়ে ঊঠবে।

 

বর্তমানে তাড়াশ থেকে চলনবিলে যেতে হচ্ছে প্রথমে অটোভ্যান, ইজিবাইক, সিএনজি কিংবা যে কোন যান্ত্রিক যানবাহনে দিঘী গ্রামে। দিঘী বাজারের পশ্চিম পার্শ্বে যেখান থেকে তাড়াশ-গুরুদাসপুর ডুবো রাস্তা শুরু হয়েছে সেখানে ভাড়া নৌকাগুলো নোঙর ফেলে আছে। ওখানে গিয়ে আগ্রহীরা নৌকা ভাড়া করতে পারেন চলনবিলের যে কোন জায়গায় বেড়াতে বা কাজের উদ্দেশ্যে যেতে। সেখানেও আছে বিরম্বনা। ডুবো রাস্তা বরাবর একই ধরনের প্রতিবন্ধকতা দু’ধারে থাকার দরুন নৌকাগুলো সোজা খাল দিয়ে  না গিয়ে কামারশোন গ্রামের উত্তর বা দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে। এই অবস্থা তাড়াশসহ চলনবিলের প্রায় সর্বত্র। তার মানে ভরাট-দখল, দূষণ ও খননের মহোৎসব চলছে বিগত প্রায় দু’দশক ধরে। এই অদূরদর্শীতা ও স্বেচ্ছাচারিতা দেখার কেই নেই।

 

উপজেলার রাস্তাগুলোর দু’ধারে খালের মধ্যে যেমন অসংখ্য বাড়ীঘর, খামার , দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, কল- কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। অনুরূপ শত শত পুকুর খনন করা হয়েছে কৃষি ফসলী জমি কেটে। বহু পুকুর রাস্তা সংলগ্ন খালের অংশ দখল করে তৈরী করা হয়েছে। আবার অনেক জায়গায় ব্রীজ-কালভার্টের উভয়মুখ বন্ধ করা হয়েছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। একারণে খাল নালার অস্তিত্ব প্রায় সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়ে পানি নিস্কাশনের পথ ও একই সাথে নৌচলাচলের রুটগুলো বেমালুম বন্ধ হয়ে গেছে। খোলা আছে কেবল কাঁচা-পাকা রাস্তা আর বসবাস কিংবা ব্যবসা বাণিজ্যের নানা স্থাপনা। অর্থাৎ নদী-নালা খাল-বিল সব মেরে ফেলা হচ্ছে নির্মমরুপে। মনে হচ্ছে সবাই ভেবে নিয়েছে আমাদের জলপথ, জল প্রবাহের চ্যানেলসমূহ ও প্রাকৃতিক জলাধার এসব সর্বৈব নিস্প্রয়োজন। আমরা গ্রামীণ প্রতিবেশ  অগ্রাহ্য করে শহরায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছি। আজকাল অনেককেই বলতে শোনা যায়, চলনবিল আর বিল থাকছে না। এখন থেকে ২০/৩০ বছর পর চলনবিলকে তেমনটি বোঝাই যাবে না যে এটা এক সময় ঐতিহাসিক বিখ্যাত জলাধার ছিল যা উপমহাদেশের প্রখ্যাত  ও বৃহত্তম চলনবিল নামে আখ্যায়িত হতো। মাছ ,পাখী, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীজ সম্পদে ভরপুর জীব বৈচিত্রের এক অপরুপ লীলাভূমি চলনবিল শুধু ইতিহাসের পাতায় হয়তো ঠাঁই পাবে আর কিছু কাল পর। কেননা, আমরা শৈশবে চলনবিলের যে ভয়ংকর ও যুগপৎ সৌন্দর্যমন্ডিত রূপ পরিলক্ষিত করেছি সেই সমুদ্রের পাহাড়ের মত ঢেউ, অসীম জলরাশি, যতদুর দৃষ্টি যায় শুধু পানি আর পানি, বিরাট আকারের কৈ মাছ, দেশী মাছের বিশাল ভান্ডার, ডোঙ্গা-নৌকা তথা পাল তোলা নৌকা ও বজরা নৌকার বহর, প্রবল পানির স্রােত ,বছরের অধিকাংশ সময় বিলে পানি থাকা, আজকের ন্যায় কোন পাকা রাস্তাঘাটের চিহ্নমাত্র নেই, শুধু ধুধু জলরাশি, শাপলা পদ্মসহ নানা জলজ ফুলের মনমুগ্ধকর দৃশ্য, অথবা শুকনো মওসুমে দিগন্তজোরা শূন্য মাঠ – এসব কাহিনী ও দৃশ্য এ প্রজেন্মের নিকট কেবলি রুপ কথার মত মনে হবে। অথচ আজকে পুরোনো সেই দৃশ্য পটের পরিবর্তন হয়ে চলনবিল নামে মাত্র বিল হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছে। কার্যত বিলের সকল আদি ও মূল বৈশিষ্ট্য, অতীত প্রকৃতি, দৃশ্য ও চেহারা সব পাল্টে মানুষের লোভ লালসা ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এটা এখন মরা বিলে পরিণত হচ্ছে ক্রমশ।

আবারো পূর্বে কথনে ফিরে আসি। তাড়াশের পশ্চিম পার্শ্বে ওয়াপদা বাঁধেই যে নৌকা আর লাগবে না বা আসবে না তাই নয়- তাড়াশের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ কোন গ্রামাঞ্চলের মাঠেই আর নৌকা, নৌযান বা দেশী ডিঙি,ডোঙা যাই বলি না কেন স্বাভাবিক চলাচল আর থাকছে না। একসময় তাড়াশে প্রধান যানবহনই ছিল নৌকা। নৌকা ছিল জীবন জীবিকার অবিচ্ছেদ্য উপকরণ। জলপথ ছিল চলাচলের মূল পথ। দূর অতীতে এখানে এক সময় প্রায় বারো মাস, তারপর বছরের অধিকাংশ সময়,পরবর্তীতে ৬ মাস এবং এরপর আজকে আর তিন মাসও তাড়াশ এলাকায় নৌকা চলে না। অর্থাৎ নৌকা চলার ও চালাবার জন্য যে জলাভূমি আবশ্যক তা অবশিষ্ট নেই। অবশেষে আজ চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র যে তাড়াশ সেখানে নৌকার আনাগোনা, নৌকার চলাচল এবং নৌযানের অস্তিত্বই বিলিন হওয়ার পথে। জল আছে আবদ্ধ হয়ে। চার পাশে বাঁধ ও প্রতিবন্ধকতা। একবার এলাকায় পানি প্রবেশ করলে নামার পথ রুদ্ধ থাকায় জলাবদ্ধতার দরূন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ফসল ও আবাদ বসত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অবৈধ খাল খনন, খাল ভরাট, পুকুর খনন, কৃষি জমি বিনাশ করা ও রাস্তা পথের ধারে ঘরবাড়ীসহ নানা রকম স্থাপনা নির্মাণের ফলে একটা মহা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সমগ্র পরিবেশকে। মানুষ ঘরবাড়ি  এবং দোকানপাট করার জন্য রাস্তা, সড়ক ও খাল বেছে নিয়েছে উপযুক্ত স্থান হিসেবে। অথচ দেশে আইন, প্রশাসন ও বিচার থাকলেও এই ভয়াবহ অবনতির দিকে কারো নজর আছে বলে মনে হয় না, সবাই নির্বিকার। এর পরিণতি সমগ্র এলাবাসীর জন্য, সমাজের জন্য সর্বোপরি দেশের জন্য বিভৎস পরিণতি ডেকে আনবে। যে দিন সে মহা দুর্দিন মোকাবেলার –উপায় ও পদ্ধতি খুঁজে পাওয়া মুসকিল হবে। পরিশেষে এই মারাত্মক বিধ্বংসী কর্মকান্ড থেকে এখনও বিরত হওয়ার সময় আছে সামান্যই। তবুও সেদিকে সবারই সচেতন ও সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া আশু প্রয়োজন। অন্যথায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে অবর্ণনীয় গজব ও মছিবত যা আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ বিরুদ্ধ কাজের বিনিময় হিসেবে আবির্ভূত হবে, জীবন ও জীবিকাকে করবে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD