উন্নয়নের ধাক্কায় চলনবিলএখন মরা বিলে পরিনত

Spread the love

আবুল কালাম আজাদ :

*চারঘাট এবং আটঘড়িয়ায় বড়াল নদীর মৃত্যুদানব তিনটি স্লুইসগেট সম্পুর্ণ অপসারণ করতে হবে।

*চলনবিলের সকল নদ-নদী, জোলা-খালের সীমানা নির্ধারণ ও পুনঃখনন করে নাব্যতা ফিরে আনতে হবে।

*চলনবিলে পানি প্রবেশে বাধাহীন সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

পাকভারত উপমহাদেশের একসময়ের প্রমত্তা ঐতিহাসিক চলনবিল মানুষের প্রয়োজনে উন্নয়নের ধাক্কায় চলনবিলের চলন থেমে গেছে। খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়ে এখন মরাবিলে পরিনত হয়েছে। চলনবিলের প্রাণ সঞ্চালনকারী  নদী, খাল, জোলা খাড়ি দখল, দুষন আর অপরিকল্পিতভাবে সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা নির্মাণে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার প্রসব যন্ত্রনায় পানির  স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় এখন আষাঢ় মাসেও সমুদ্রসম চলনবিল পানি শুন্য। ফলে হারিয়ে গেছে চলনবিলের  ঐতিহ্য সুস্বাদু নানা প্রজাতির মাছ, পাখিসহ পরিবেশ বান্ধব জলজ প্রানি আর উদ্ভিদ। জীববৈচিত্রের ঘটেছে অপমৃত্যু।

চলনবিলের কথা লিখতে হলে বর্তমান প্রজন্মকে  চলনবিলের অতীত ঐতিহ্য জানা খুবই প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি। কারণ অতীত ঐতিহ্য না জানলে  ঐতিহাসিক চলনবিলের  বিশালতা সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারবে না। অতীতকে জেনে বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষন করে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম  চলনবিলের ঐতিহ্য রক্ষায় উপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।

আমার শৈশব, কৈশর, যৌবন, বার্ধক্য, জন্ম-মৃত্যু, আমার অস্তিত্ব আমার বিল, আমার পরিচিতি, আমার ইতিহাসের নাম চলনবিল। চলনবিল শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র পাকভারত উপমহাদেশে চলনবিলের ন্যায় আয়তনবিশিষ্ট আর কোন বিল আছে বলে জানা যায় না। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অঞ্চল হচ্ছে ঐতিহাসিক চলনবিল। নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া ও বড়াইগ্রাম, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়ার আংশিক এবং পাবনা জেলার চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলাসহ আটটি থানাব্যাপী চলনবিলের অবস্থান। চলনবিলের আয়তন বর্তমানে প্রায় ৮০০ বর্গমাইল। পুর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ৩২ মাইল এবং উত্তর-দক্ষিনে প্রস্থ সাড়ে ২৪ মাইল। বিলটি বিষুব রেখার ২৪ ডিগ্রী ২৭ মিটার হতে ২৮ ডিগ্রী ৩৫ মিটার উত্তর অক্ষাংশে এবং ১৯ ডিগ্রী ১০ মিটার হতে ৮৯ ডিগ্রী ৩৫ মিটার  পুর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। চলনবিলের উত্তরে বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম ও শেরপুর থানা, দক্ষিনে পাবনা জেলার আটঘড়িয়া ও ঈশ্বরদী থানা, পুর্বে সারা-সিরাজগঞ্জ রেললাইন, পশ্চিমে নাটোর সদর থানা এবং নওগাঁ জেলার আত্রাই ও রানীনগর থানা।

একসময়ে চলনবিল ছিল বৃহত্তর রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার তিন চতুর্থাংশ, নওগাঁ মহকুমার মান্দা, রানীনগর ও আত্রাই থানা ও  পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমা ও সদরের চাটমোহর, বনারীনগর ফরিদপুর, বেড়া ও ভাঙ্গুড়া থানা বিস্তৃত। বগুড়া জেলার দক্ষিন প্রান্তের আদমদীঘি ও নন্দীগ্রাম থানা চলনবিলের মধ্যে ছিল। এই চলনবিলে বর্ষাকালে বছরের পর বছর ধরে পদ্মা ও আত্রাই বিধৌত পলি জমে বিলের উত্তরাঞ্চল ভরাটের ফলে উচুঁ হওয়ায় চলনবিল ক্রমে দক্ষিনে সরে পড়েছে।

‘ইম্পেরিয়ার গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া হতে জানা যায়- পদ্মা তীরস্থ লালপুর বাদে নাটোর মহকুমার সমগ্র অংশ বিলময় জনাকীর্ন নি¤œ জলাভূমি ছিল। তন্মধ্যে সর্ব বৃহৎ চলনবিল।’ কখন চলনবিল উৎপত্তি হয় এবং কেন এর নাম চলনবিল হয় তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। দুই হাজার বছর পূর্বে চলনবিল নামে কোন বিলের অস্তিত্ব ছিলনা। কোন ইতিহাসে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইতিহাস বলে তখন বিলটি ছিল সমুদ্রে গর্ভে। কেননা তখন বগুড়ার মহাস্থানগড় পর্যন্ত বঙ্গপসাগর বিস্তৃত ছিল বলে জানা যায়। কিছুকাল পরেও সমুদ্র চলনবিলকে জন্ম দিয়ে দক্ষিন দিকে সরে পড়ে। তখন পদ্মা ও যমুনা নদী শিশু চলনবিলকে অঙ্গে ধারন করে। গঙ্গা নদীর যে স্থান হতে ভাগিরথি প্রবাহিত, তার নি¤œাংশের পুর্বগামী শাখা পদ্মা এবং ব্রম্মপুত্রের দক্ষিন-পশ্চিমগামী শাখা যমুনা  চলনবিলের বুকের উপড় দিয়ে প্রবাহমান ছিল। চলনবিলের জলরাশি বদ্ধ বিলের ন্যায় স্থির না হয়ে নদীর ¯্রােতের ন্যায়  চলন্ত বা গতিশীল ছিল। হয়তবা এ কারণেই এ বিলের নামকরন করা হয় ‘চলনবিল’ অর্থাৎ চলন্ত বিল। মতান্তরে ‘চোল সমুদ্র’ হতে চলনবিলে উৎপত্তির কথা অনুমান করা হয়। কিন্তÍু প্রকৃতপক্ষে কোন গ্রন্থে ‘চোল সমুদ্র’ নামে  কোন সমুদ্রের নাম বা পরিচয় পাওয়া যায়না ।

১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত মি. ই. বেলফোর সঙ্কলিম  সাইক্লোপেডিয়া অব ইন্ডিয়া ভলিউম  তিন, পাতা ৩৫৫ এর বিবরণে বলা হয়েছে, প্রকৃত পক্ষে চলনবিল ও তার চতুর্পার্শ্বস্থ অঞ্চলসমূহের অতিরিক্ত জলরাশি সংরক্ষণের জলাধার বিশেষ। এর সঙ্গে বহু নদী ও জলাধারার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে এবং চলনবিলের বুকে মিশে তারা নিজ স্বাতন্ত্র হারিয়ে ফেলেছে। বর্ষাকালে বিলটি স্ফীত হয়ে ১২০ বর্গমাইল এলাকায় ব্যাপ্তীলাভ করে। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ারের রাজশাহী অংশে বলা হয়েছে, চলনবিল রাজশাহী জেলার একটি বিশাল জলাভুমির দৈর্ঘ্য ২১ মাইল প্রস্থ ১০ মাইল। সেক্ষেত্রে  রাজশাহী বর্তমান নাটোর জেলা অংশের বিলের ক্ষেত্রফল ১২০ বর্গমাইল এবং পাবনা জেলা অংশের ৩৪০ বর্গমাইল। সর্বমোট বিল অংশের মোট আয়তন দাঁড়াচ্ছে ৫৬০ বর্গমাইল। এর সঙ্গে স্থলভাগের গ্রামসমূহের আয়তন প্রায় ২৫০ বর্গমাইল যোগ করলে চলনবিল অঞ্চলের মোট আয়তন প্রায় ৮০০ বর্গমাইল। অতীতে চলনবিল অত্যন্ত গভীর ¯্রােতস্বিনী এবং বিপদসংকুল ছিল।  এর বিরাটত্ব ও ভয়ঙ্কর রূপ মানুষের প্রাণে স্বভাবতই ভীতির উদ্রেক করতো।চলনবিলের বুকচিড়ে আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং স্থানীয় অনেক নদ-নদী, জোলা খাল, খাড়ি প্রবাহিত হচ্ছে। এইসব নদ-নদী জোলা খাল দিয়ে উজান থেকে বিপুল জলরাশি প্রবাহিত হয়ে চলনবিলের প্রাণ সঞ্চালন করে আসছে। নদ-নদীগুলি হচ্ছে,  আত্রাই, বড়াল, নন্দকুঁজা, নারোদ নদ, গুমানী, মরা আত্রাই, বেশানী, ভাদাই (ভাষানী), করতোয়া, ফুলজোড়, তুলশী, চেঁচুয়া, চিকনাই, বানগঙ্গা, গুড়, বারনই, মির্জামামুদ, গোহাল, বিলসূর্য, কুমারডাঙ্গা। চলনবিলের প্রাণদায়িনী এইসব গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদী খাল, জোলার উপর অপরিকল্পিতভাবে স্লুইসগেট রাবারড্যা¤প, ব্রীজ, কালভার্ট, বাঁধ, পাকাসড়ক গুচ্ছগ্রাম, আদর্শগ্রাম, আশ্রায়ন প্রকল্প, আবাসনসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ এবং সরকারী ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ অফিসার, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ভূমি খেকোদের অবৈধ দখলদারদের অপরিনামদর্শী নির্যাতনে ৮০% ভাগ নাব্যতা হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে চলনবিল। প্রমত্তা বড়াল, তুলসিগঙ্গা, মির্জামামুদ, বোয়ালীয়াসহ অনেক নদী খাল ভূমিগ্রাসীদের দাপটে নিজ অস্তিতই  বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অদুরদর্শীতায় মৃত্যুর প্রহর গুনছে চলনবিলের জীবনদাত্রী  বড়াল, আত্রাই, নন্দকুঁজা নারোদ আর গুমানী নদী।

চলনবিলের বুকের ওপর দিয়ে  জাতীয় ও আন্তযোগাযোগ বৃদ্ধি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সড়ক-মহাসড়ক, রেলপথ এবং বাঁধ নির্মাণ করে চলমান চলনবিলকে বহু খন্ডে বিভক্ত করেছে। আর এজন্যে সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক জনপথ শতভাগ দায়ী। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ১৯১৪ সালে পাকশীর সারার ব্রীজ থেকে সিরাজগঞ্জ এবং ঈশ্বরদী-শান্তাহার দুইটি রেললাইন নির্মিত হওয়ার পর একীভূত চলনবিল বিভক্ত হওয়া শুরু হয়। ফলে চলনবিলের মরন যাত্রা শুরু হলো। এরপর মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নির্মাণ করা হয় চাঁচকৈড় খলিফাপাড়া থেকে আত্রাই-মান্দা পর্যন্ত আত্রাই নদীর পাড় বরাবর দীর্ঘ বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ, নাটোর-সিংড়া-বগুড়া মহাসড়ক, বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক, বওসার হিজলতলা ঘাট থেকে তাড়াশ-বিনসারা-নিমাইচড়া নামের বন্যনিয়ন্ত্রন বাঁধ, তাড়াশ-বারুহাস সড়ক, তাড়াশ-সগুনা সড়ক, খুবজিপুর-বিলশা সড়ক এবং ছাইকোলা-চাটমোহর বাঁধ  চলনবিলকে খন্ড বিখন্ডিত করে চলনবিলের নিজ সত্বা ও অস্তিÍত্ব বিলীন করে ফেলেছে। চারঘাটে বড়ালের মুখে. আটঘড়িয়া বড়াল ও নন্দকুঁজা নদীর ওপড় ৩টি স্লুইসগেট নির্মাণ করে নদী দুইটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হযেছে। নদীর প্রস্বস্ততা ৮০ ভাগ সঙ্কুচিত করে স্লুইসগেট তিনটি নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বর্ষাকালেও পদ্মার পানি বড়ালে ঢুকে না। পানির প্রবাহ না থাকায় প্রবাহমান চলনবিল এখন মরাবিলে পরিণত হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম অতীত চলনবিলের সেই রূপ, যৌবন, উচ্ছাস থেকে নির্মমভাবে আজ বঞ্চিত। এজন্যে মূলতঃ দায়ী উন্নয়নের অগ্রযাত্রার অপরিকল্পিত প্রকল্পগুলি এবং ভুমি খেকোদের বেপরোয়া দখলদারিত্ব। আসলে মানুষের  উগ্র ভোগবিলাসিতাই পরিবেশ ধ্বংস ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী।

চলনবিলের অতীত ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোরন করে আসছে। তাদের দাবি চলনবিলকে রক্ষা করতে হলে চারঘাটের বড়ালের মুখে এবং আটঘড়িয়ার বড়াল এবং নন্দকুঁজা নদীর উপর নির্মিত অপ্রস্বস্ত স্লুইসগেট তিনটি অপসারন করতে হবে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। নদীর সীমানা নির্ধারন করে সীমানা খুঁটি স্তাপন করতে হবে। বড়াল, নন্দকুঁজা, আত্রাই, গুমানীসহ চলনবিলের বুকচিড়ে প্রবাহিত সকল নদ-নদী, খাল-জোলা পূনঃখনন করে নাব্যতা ফিরে এনে অবাধ পানির ¯া^ভাবিক প্রবাহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। চলনবিলে যাতে বাধাহীনভাবে  পানি প্রবেশ করতে পারে সে বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে যাচাই করে সরকারী উন্নয়নমূলক সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

 

লেখক ঃ সভাপতি, চলনবিল প্রেসক্লাব ও কলামিষ্ট। গুরুদাসপুর, নাটোর।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD