অধ্যক্ষ আমিন-উল-আলম চৌধুরী এক মানবপ্রেমী জ্ঞান তাপসের বিদায়       

Spread the love

অধ্যাপক ফজলুর রহমান

অধ্যক্ষ আমিন-উল-আলম চৌধুরী আজ আর আমাদের মাঝে নেই। গত  ১৪ মে ২০১৯খ্রিঃ রোজ মঙ্গলবার বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল ২টা ৩০ মিনিটে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান (ইন্না লিল্লাহি — রাজেউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি  তার সহধর্মিনী চৌধুরী এলিজা আমিন, দুই মেয়ে আসমা উল হুসনা মৌসুমী ও জান্নাত উল ফেরদৌস কেয়া এবং শেফা উল আলম চৌধুরী আকাশ নামে এক ছেলেসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, শূভানূধ্যায়ী ও তার ভক্ত-অনুগত ছাত্রছাত্রী রেখে গেছেন।

জš§ ঃ অধ্যক্ষ আমিন উল আলম চৌধুরী ১৯৪১ সালের ৩১ মার্চ সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানার চৌবাড়ী গ্রামে এক  প্রখ্যাত এবং সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে জš§ গ্রহণ করেন। পিতার নাম মরহুম নজাবত আলম চৌধুরী। তাঁর পরিবারের বেশীরভাগ লোকই শিক্ষক ও  পন্ডিত ছিলেন।

লেখাপড়া ঃ ১৯১৩ ইং সনে চাচা আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত কামারখন্দের  চৌবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চৌবাড়ী ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করে ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত হয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।

একজন আদর্শ শিক্ষক ঃ শিক্ষকের অনেক সংজ্ঞা আমরা শুনে থাকি। আমি এবার   রাজশাহীতে  বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের এক পর্যায়ে শিক্ষকের একটা সংজ্ঞা শুনলাম। শিক্ষক শব্দগুলোর মানে- শি=শিক্ষাবিদ, ক্ষ= ক্ষমাশীল, ক= কর্তব্যপরায়ণ। উক্তিটি শোনার পর মনে হলো আমিওতো একজন শিক্ষক। তবে না আমি শিক্ষাবিদ, না আমি ক্ষমাশীল, না আমি কর্তব্যপরায়ণ। কারণ শিক্ষতার ওই পর্যায়ে আমি এখনো পৌছুতে পারি নি। প্রশিক্ষণ শেষে বাড়িতে ফিরে এলাম। অধ্যক্ষ আমিন উল আলম চৌধুরীর পার্শ্বেই আমার বাসা। প্রশিক্ষণ থেকে আসার পর আমার একটা লেখা তাকে দেখালাম। উনি বললেন, এটা উচ্চ মানের লেখা। আমি বললাম, আমি কবিও নই- লেখকও নই। তখন আমি স্যারকে বললাম, স্যার শিক্ষক এর এই সংজ্ঞাটা শুধু আপনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আপনি একজন শিক্ষাবিদ, আপনি ক্ষমাশীল, আপনি কর্তব্যপরায়ণ একজন মানুষ। তিনি জীবনের শুরুটাই শিক্ষকতার পেশা দিয়ে শুরু করেছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, হাইস্কুল লেভেলে শিক্ষকতা করেছেন, কলেজেও শিক্ষকতা শুরু করে ১৯৭৫ সালের মে মাসে  তাড়াশ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মভার গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক হয়ে বাংলার পাশাপাশি তিনি ইংরেজী সাহিত্যও পড়াতেন। একজন শিক্ষকের কতটুকু পান্ডিত্য থাকলে বাংলার শিক্ষক হয়েও ইংরেজী পড়ানো সম্ভব।

তাড়াশ কলেজ প্রতিষ্ঠা ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন ঃ ১৯৭২ ইং সনে সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ এর চৌধুরী বাড়ী থেকে তাড়াশ আগমনের মধ্য দিয়ে তাড়াশের কিছু গুণীজনদের সঙ্গে নিয়ে কলেজ গড়ার এক অনন্য দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ধান- চাউল, অর্থ সংগ্রহ, ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহের মাধ্যমে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ ও কষ্ট সহ্য করে তাড়াশ কলেজ প্রতিষ্ঠা করে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছে ছিলেন। তাড়াশের গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাঘাট এমন এক পর্যায়ে ছিল যে, গাড়ী ঘোড়াতো তো দুরের কথা, পায়ে হেঁটে চলাফেরাই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। শরীরে কাঁদা ঘাম মেখে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে  ঘুরে কঠিন এক দায়িত্ব কাঁদে নিয়ে তাড়াশ কলেজকে অত্র এলাকার বৃহৎ এক  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ দান করেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ আমিন উল আলম চৌধুরীর দিন-বদল নামক একটি প্রবন্ধ থেকে তাড়াশ ও কলেজ গড়ার সময়ের কঠিন চ্যালেঞ্জের কিছু উক্তি তুলে ধরা হলোঃ   ১৯৭২ সাল। সন্ধ্যার পর গা ছমছম করা এক ভুতুরে পরিবেশ। রাস্তাঘাটে লোক নেই, কেরোসিন তেলে জ্বলা টিম টিম দু একটি আলো। বাস নেই, বিকল্প ভ্যান নেই, নেই কোনো দোকানপাট, বাজারঘাট। পশ্চিমের জলাভূমি চলনবিল জলদস্যুদের চারণভূমি। অবারিত জলাধার আর আকাশ ছোঁয়া দিগন্ত ঘেরা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। সভ্যজগতের সংস্পর্শ-বিবর্জিত এ যেন এক ভিন্নজগৎ- তাড়াশ। জঙ্গলাকীর্ণ কলেজ ক্যাম্পাস। রিলিফের টিনের ছাউনি আর উইপোকা-জীর্ণ তালাইয়ের বেড়া বিশিষ্ট একটি মাঝারী ধরনের গৃহ শ্রেণীকক্ষ। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত কক্ষ “কলেজ কার্যালয়”। ছাত্র-ছাত্রী নেই। কলেজের জমা-খরচ খাতার ডানে-বায়ে শূন্য-শূন্য। অথৈ সমুদ্রে জরাজীর্ণ তরণীতে আমি একমাত্র কান্ডারী।

ভাষা ও পান্ডিত্য ঃ ২০০২ সালের কথা তাড়াশের ইউএনও ছিলেন তখন বোরহান উদ্দিন ভুঁইয়া। তিনি অধ্যক্ষ আমিন উল আলম চৌধুরীকে একটু বেশী সমীহ করতেন। তখন তাড়াশ মহিলা ডিগ্রী কলেজের প্রিন্সিপাল মোঃ জাফর ইকবাল তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, অধ্যক্ষ স্যারকে এতো সমীহ করার কারণ কী ? তখন বোরাহান উদ্দিন ভূঁইয়া একটা চিঠি বের করে অনেক লোকের সামনে পড়ে শুনিয়ে বলেছিলেন, এই মানের ভাষা, এই মানের সম্মান প্রদর্শন করে কেউ চিঠি লিখতে পারে আমার জানা ছিল না। একজন মানুষের কী পরিমাণ পান্ডিত্য থাকলে এভাবে লেখা সম্ভব !

প্রফেসর পাড়া গঠনঃ অধ্যক্ষ আমিন উল আলম চৌধুরী তাড়াশের মাটি ও মানুষকে ভালবেসেছিলেন। বিনিময়ে তিনিও মানুষের  ভালবাসা ও সম্মান পেয়েছিলেন। এ  জনপদের সর্বস্তরের মানুষই তাঁকে অত্যন্ত সমীহ করে স্যার বলে সম্বোধন করতেন। তিনি অত্র এলাকার মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমি আমৃত্যু তাড়াশেই থাকবো এবং তাড়াশেই আমার দাফন সম্পন্ন হবে। সেই প্রত্যয়েই তিনি শিক্ষকদের নিয়ে নিজের চেষ্টায় আমাদের মত ক্ষুদ্র মানুষের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন তাড়াশ প্রফেসর পাড়া। যা ইতোমধ্যে স্বতন্ত্র একটি পাড়া হিসেবে সুন্দর পরিবেশে গড়ে ওঠেছে।

অবসরকালীন সময় ঃ কথায় আছে শেষ ভাল যার সব ভাল তার। চাকুরীকালিন সময়টা অনেকেরই ভাল কাটে। কিন্তু অবসর কালিন সময়টা অনেকেরই ছন্দহীন, হতাশাময় এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কিন্তু অধ্যক্ষ আমিন উল আলম চৌধুরী শুধু নামেই অধ্যক্ষ নন, নামেই চৌধুরী নন-তিনি মনে প্রাণে ও কাজে অধ্যক্ষ ও চৌধুরী ছিলেন। শেষ জীবনেও তিনি তাঁর সময়, ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্ব সবই সমান তালে রক্ষা করে চলে গেছেন। তিনি যেখানে সেখানে বসতেন না, নিদিষ্ট একটা জায়গায় সঠিক নিয়মে সঠিক সময়ে বসতেন। তাড়াশে সূধীজনদের  বসার তেমন কোনো জায়গা না থাকায় বেশীর ভাগ সুধীজন ডাঃ আব্দুল হাকিম ও  তাঁর ভাই আব্দুল মতিন সাহেবের ঔষধের দোকানে বসতেন। অধ্যক্ষ স্যারের শেষ জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় মতিন সাহেবসহ কিছু সূধীজনদের মাঝে অতিবাহিত করেছেন। আমরা এই জনপদের মানুষ হিসেবে এই আলোকিত, বরেণ্য ও সোনার মানুষটির জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া এবং তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি । মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁকে যেন জান্নাত নসীব করেন।  আমীন

লেখক:  সহকারী অধ্যাপক, তাড়াশ মহিলা ডিগ্রী কলেজ ,কবি ও কলামিষ্ট।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD