ট্রেনিং হলেও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হলো না

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু
আমি তখন দশম শ্রেনির ছাত্র। তাড়াশ ইসলামিয়া পাইলট হাইস্কুল। এ স্কুলেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে বন্দুক প্রশিক্ষণের শিবির স্থাপন করা হল। যতদূর স্মৃতি যায়, অধিকাংশ প্রশিক্ষণার্থী ছিল এই হাইস্কুলের ছাত্র। তবে কিছু রাজনীতি করনেওয়ালা স্থানীয় বাইরের যুবকও ছিল। আমিও ক্যাম্পে যথারীতি ভর্তি হলাম বাড়ী থেকে বিছানা-কাঁথা নিয়ে এসে। এব্যাপারে আমার পিতারও অনুপ্রেরণা ছিল যথেষ্ট। কারণ তিনি আপাদমস্তক ছিলেন স্বাধীনতা স্বপক্ষের একজন দৃঢ় সমর্থক, তা তাড়াশের আজকের দু’চারজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধারও বোধ করি ভালভাবেই জানা। যাহোক ,খাওয়ার ব্যবস্থা হলো ক্যাম্পেই। তাড়াশ হাইস্কুলের প্রথম যুগের ভবন ছিল ইট সুরকি মিশ্রিত মাটির দেয়াল। উপড়ে টিনের চাল। কাঁচা মেঝেতে রাত্রি যাপন। মনে পড়ে দেশী গাদা বন্দুক জোগার হয়েছিল থানায় এলাকার বিভিন্ন লাইসেন্সকৃত বন্দুক ক্লোজ করার মাধ্যমে। অন্যান্য লাইসেন্সধারী বন্দুক ছাড়াও সব ইউপি চেয়ারম্যনরাই তাদের ব্যাক্তিগত বন্দুক বিরাট মহতী উদ্দেশ্যে জমা দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। আর সে উদ্দেশ্যে ছিল হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রুখতে এই অস্ত্র প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষক ছিলেন তৎকালীন ভিডিপি আনসার কমান্ডার তাড়াশের মোবারক হোসেন ও ভাদাসের আব্দুর রহমান মিঞা। আমরা তাদের উভয়কেই চাচা বলে ডাকতাম। পরবর্তীতে এরা দুজনেই ছিলেন তাড়াশের নেতৃস্থানীয় তথা শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক। খুব সম্ভবত: ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষনের পর এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আয়োজন করা হয়। একই সাথে তাড়াশে হানাদার সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ বা আক্রমন প্রতিহত করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণই ছিল এ প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য। অবশ্য আজকে তাড়াশের যারা ভাতাভোগী দীর্ঘ মুক্তিযোদ্ধা তালিকার অন্তর্ভূক্ত তাদের অধিকাংশকেই সে সময়ের ট্রেনিং ক্যাম্পে আমি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবে অনেকেই সেসময় ওই ট্রেনিংয়ে যোগ না দিলেও পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে বা দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিফৌজ হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
এখন যেখানে তাড়াশ ডিগ্রি কলেজ। এই কলেজ প্রাঙ্গনে ছিল একটি কাঠাল গাছ। অধিকাংশ সময় কাঠাল তলার এই মাঠে অর্থাৎ হাইস্কুলের উত্তর পার্শে¦ অর্থাৎ আজকের ডিগ্রী কলেজ মাঠে বন্দুকের প্রশিক্ষণ মহড়া চলতো। আমরা সাধারণভাবে গুলি করা তথা বন্দুক চালানো শিখে ফেলেছিলাম এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যেই। বড় কথা মনের কল্পনাতে ও অন্তরের গভীর প্রত্যয়ে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার একটা দৃঢ় অঙ্গীকারের ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল। কেননা আমরা ছিলাম তখন তরুণ ও যুবক। স্বাধীনতার শপথ অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো ফুঁসতে ছিল আত্মার অনুভবে। ওদিকে তখন পাকিস্তানী সরকারকে সহযোগীতার নামে তাড়াশে শান্তি কমিটি গঠনের গুজব ছড়িয়ে পড়লো। এটা ছিল হানাদারবাহিনীর সহযোগী দোসরদের একটা পাঁয়তারা বা চালবাজি। এরা ছিল তৎকালীন জামায়াত ও মুসলিম লীগের সদস্য ও পাকিস্তানীদের সমর্থক ও সহায়তাকারী। তাড়াশ সদরে হয় শান্তি কমিটির কুখ্যাত নেতাদের ষড়যন্ত্র অথবা পাক সেনাদের আগমন আসন্ন ভেবে আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প ভেঙে দেয়া হলো। বন্দুকগুলোও ক্লোজ করে নেয়া হল থানায়। আমরা সবাই যার যার মতো বাড়ি ফিরে গেলাম। সর্বত্র গণ আন্দোলন চলছে। মুসলিমলীগপন্থী ইউপি চেয়ারম্যান ও নেতাদের পাকড়াও করছে আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ, সাথে আপামর জনতা। প্রায় প্রতিদিন দল বেধে অভিযান চলতো কোন না কোন এলাকায় দুস্কৃতিকারীদের ধরতে। পাকিস্তানী শাসক পন্থী স্বাধীনতা বিরোধী অন্তত তাড়াশের দু’জন ইউপি চেয়ারম্যানকে ধরার আন্দোলনকারীদের সাথে আমি গিয়েছিলাম, মনে পড়ে। এদের একজন তালম ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সেক্রেটারী চানপুর গ্রামের আবু জাফর সরকার। অন্য আরেকজন তাড়াশের সোনাপাতিল গ্রামের আজগর আলী আকন্দ। উল্লেখ্য, আকন্দ পরিবারের সকলেই ছিলেন মুসলিমলীগের নেতা ও কর্র্মী। আজগর আলী আকন্দকে গণরোষের মুখে বন্দী হতে হয় তৎকালীন তাড়াশ খেলার মাঠের কাঠালতলায়।সেখানে তাকে জনজটলার মাঝে নানা প্রশ্ন করা হলে তিনি জোকিং টাইপের দু’একটি কথা বলে সমাপ্তি টানেন এই বলে যে, এখানে ওসি সাহেব আছেন – দু’চার কথা বলবেন। এতে সমবেত সংগ্রামী জনতা সবাই হেসে গড়িয়ে পড়েন। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা যেতে পারে, এই পরিবারেরই আলেপ মিয়া তাড়াশের মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত পাকিস্তানী বাহিনির দোসর ও রাজাকারদের পৃষ্ঠপোষক শান্তি কমিটির অন্যতম নেতা ছিলেন। অথচ বিস্ময়করভাবে স্বাধীনতার পরেও প্রায় দুই যুগ সেই আলেপ বেশ মাথা উঁচু করে কৌলিন্যের ঢঙএ তাড়াশ বাজারের দক্ষিণ মোড়ে বসতি গেড়ে প্রতাপের সাথে জীবন কাটিয়ে গেলেন। তাড়াশের মানুষ আজ যেটাকে ‘আলেপ মোড়’ বলে অভিহিত করে প্রকৃতপক্ষে তা রাজাকার মোড় বলার নামান্তর। এই নিন্দনীয় এবং কলংকজনক নামে কোন গোলচত্বর লোকমুখে শোভা পেত না যদি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সেভাবে আমাদের সমাজ ধারণ ও লালন করত। অবশ্য আমাদের স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হল না বলে বহু ক্ষেত্রেই নিরবে নি:শব্দে তেলেজলে মিশে এমনিভাবে একাকার হয়ে গেছে সে ব্যাপারটা নতুন প্রজন্মের কেউই বুঝতেই পারল না। (চলবে)

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD