শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণেবাংলাদেশ সরকারের প্রয়াস

Spread the love

আমির হামজা

কোচিং-বাণিজ্য বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময় এই বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করা হলেও এখনো চলছে রমরমা ব্যবসা, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন দেশের অনেক শিক্ষক। এখন দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষকেরা তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং বা প্রাইভেটে ভর্তি হবার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন এবং তারা ভর্তি না হলে কম নম্বর দেয়াসহ তাদের জন্য বিভিন্ন সমস্যার সৃিষ্ট করেন। দেশের শিক্ষা তাই ধীরে ধীরে কোচিংনিভর্র হয়ে যাচ্ছে, যা কখনোই কাম্য নয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে এই কোচিং সেন্টার গুলোর স্ম্পৃক্ততার ব্যাপারটিও গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।

এই কোচিং-বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরা এবং এর সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা বন্ধ করার জন্য ২০১২ সালে একটি নীতিমালা পাশ করে বাংলাদেশ সরকার। এই নীতিমালায় বলা আছে যে, কোনো শিক্ষক তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না এবং কোনো কোচিং সেন্টারের মালিকানাসহ এগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারবেন না। এই নীতিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা পাঁচটি রিটের শুনানি শেষে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের রায়ে গত ৭ ফেব্রয়ারী, ২০১৯ এই নীতিমালাকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। এই নীতিমালায় মোট ১৪টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। অনুচ্ছেদ-৩-এ  বলা আছে যে, কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের  প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান-প্রধানের পূর্বানুমতি নিয়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন এবং সেই ছাত্রছাত্রীদের তালিকা উক্ত শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে লিখিতভাবে জমা দেবেন। অনুচ্ছেদ-৫ অনুযায়ী কোনো শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারে পড়ার জন্য কোনো প্রকার উৎসাহ বা চাপ প্রদান করতে পারবেন না। এ ছাড়া অনুচ্ছেদ-৭ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিকে কোচিং- বাণিজ্য বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলে। প্রধান শিক্ষকের কোচিং-বাণিজ্য বিরোধী প্রচারণা এবং অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের বিষয়টি বলা আছে অনুচ্ছেদ ৮-এ।

নীতিমালা না মেনে কোচিং-বাণিজ্য করলে কী শাস্তি হবে তা বলা রয়েছে অনুচ্ছেদ ১৪-এর উপ-অনুচ্ছেদ ‘ক’তে। কোনো এমপিওভুক্ত শিক্ষক এই কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকলে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বার্ষিক বেতন স্থগিত, বেতন কমানো, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে যদি পরিচালনা পরিষদ উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেন তাহলে সরকার এই পরিষদ ভেঙে দেয়াসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমতি বাতিল করতে পারেন। অনেক অভিভাবকেরাই এই কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন। এমন একটি সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছে, যেখানে প্রতিটি বিষয়ে কোচিং করা বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকদের প্রশ্ন হলো শিক্ষকেরা বেতন নিয়ে ক্লাসে না পড়িয়ে কেন অর্থলোভে তাদের সন্তানদের কোচিংমুখী করবেন? ক্লাসে শিক্ষকেরা পাঠদানে মনোযোগী নন, সেজন্য ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে তাদের পড়াশোনায় আশানুরূপ সাহায্য পাচ্ছে না, ফলে কোচিং হয়ে উঠছে তাদের জন্য পাশ এবং ভালো ফলাফলের শেষ পথ। এভাবে কোচিং সেন্টারে পড়ার ব্যাপারটি একটি বাধ্যতামূলক অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।

কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে গত বছর দনর্ুীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমদু বলেন, ‘কোচিং সেন্টার গুলো শুধু অবৈধই নয় বরং দনর্ুীতর আখড়া।’ কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে সাবেক শিক্ষামšী¿ নরুুল ইসলাম নাহিদ তখন বলেছিলেন, দেশে ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং-বাণিজ্য হয়। এই কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে শিক্ষকদের সিন্ডিকেট, যার ফলে এর নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে গিয়েছে। এই বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টার গুলোকে পশ্র প্নত্র ফাঁসের জন্য দায়ী করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষক-সংগঠনগুলোর মতে, কোচিং সেন্টারগুলো বেশি শিক্ষার্থী ভতির্র লোভে ছোট ছোট সাজেশন আকারে প্রশ্ন পত্র ফাঁস করে থাকে। কোচিং সেন্টার গুলো বন্ধ করে দিলে প্রশ্ন পত্র ফাঁস অনেকাংশে কমে আসবে বলে মত দিয়েছেন অনেকেই। টিআইবির মতে, দেশে কোচিং-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে দিন দিন প্রতিযোগিতা বাড়ছে, যার দরুণ কোচিং সেন্টারগুলো প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করছে। টিআইবির মতে, প্রশ্ন ফাঁস এবং  শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেগুলো দ্রুত ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে এই কোচিং সেন্টারগুলো। কোচিং সেন্টারগুলো বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কিছু প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ও মডারেশনকারীদের সঙ্গে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছে, যা প্রশ্নপত্র ফাঁসে সরাসরি কাজ করে।

কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করা ২০১২ সালের নীতিমালায় শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের ওপর কোচিং-বাণিজ্যের নিষেধাজ্ঞা আনা হয়েছে। এই কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষকদের বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব দিচ্ছে এবং শিক্ষকেরা স্কুল-কলেজ ছেড়ে সরাসারি কোচিং-ব্যবসাকে তাদের প্রধান পেশা হিসবে গ্রহণ করতে দিন দিন আগ্রহী হচ্ছে, এজন্য শিক্ষকদের বেতনবৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিচ্ছেন অনেকেই। কোচিং-বাণিজ্য আমাদের ভুল শিক্ষানীতির ফসল। কোচিং-সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা কোচিংবিহীন শিক্ষায় অভ্যস্ত হওয়াও একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ২০১২ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়নের পরেও শিক্ষকেরা কোচিং-বাণিজ্য করে আসছিলেন, যা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ২০১৯ সালে এসে এর বৈধতা ঘোষণার পর সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হবে শিক্ষকদের নিয়মিত পযর্বেক্ষণে রাখা এবং কোচিং-বাণিজ্যে জড়িয়ে গেলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা।

সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর বুলেটিন, মার্চ ২০১৯ সংখ্যা থেকে নেয়া।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD