অমর হয়ে থাকবে রাফি

Spread the love

কাইয়ুম কবির
মানুষ মাত্রই মরণশীল। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু মন থেকে মেনে নেওয়া যায় না। সেই মৃত্যু যদি কোন দৃস্কৃতিকারীদের হাতে হয় তবে তা হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। নিজেকে সামলিয়ে আনাটা খুব বড় কঠিন হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় সারা বাংলাদেশে শহর থেকে প্রতিটি গ্রামে মানুষের মনে যে ঘটনা বেদনা বিদুর হয়ে আছে। চোখের সামনে মুহুর্তের মাঝে ভেসে উঠে এই হৃদয় বিদারক ঘটনা। জানি না আর কত নিস্পাপ প্রাণ ঝরে যাবে এমনি করে মানুষ নামের এই পশুদের হাতে। কি অপরাধ ছিল মেয়েটার। বলতে গেলে নূসরাত তার (ধর্ষকের) মেয়ে বয়সি ছিল। এত জঘন্য পাশন্ড হৃদয়ে এরকম মন মানষিকতা নিয়ে শিক্ষকতা করেন কিভাবে ? আমি শুধু সেই এলাকার মানুষকেই দোষারপ করতে চাই। কেননা তার এই কুৎসিৎ কলঙ্কিত বৈশিষ্ট্য জানার পরেও সেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ’র পদে চাকুরী বহাল রাখা আছে। আগে থেকে বহিস্কার করা উচিৎ ছিল। তাহলে অকালে নিভে যেত না নুসরাত জাহান রাফির জীবন। অনেক স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষায় জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলা। তার সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। অন্য দিনের মত সেদিনও পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছিল নুসরাত। তাকে দেখে একজন বোরকা পরিহিত মহিলা বলে, তোর বান্ধবীকে ছাদের উপর কারা যেন মারছে। শোনা মাত্র সেখানে পৌছায় নুসরাত। সে দেখল উল্টো তাকে মিথ্যা বলে নেওয়া হয়েছিল ছাদে। নুসরাত গিয়ে দেখল চারজন মহিলা যাদের সমস্ত শরীর ছিল কালো বোরকায় ঢাকা। নুসরাতকে বলে তারা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে। সঙ্গে সঙ্গে নুসরাত জানায়, কখনই না। শোনার পরে ক্ষিপ্ত হয়ে হাত পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় তার গায়ে। তার সারা শরিরের আশিভাগ পুরে যায়। ঐ মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা বলে অনেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রমাণ করতে পারে নাই।

অসৎ চরিত্রহীন শিক্ষকের জন্য এমন কথা মুখে একদম জঘন্যতম। তাকে প্রশ্রয় দেওয়া একটা বোকামি। সারা বাংলাদেশকে একটা বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে আমরা মনে করি। শিক্ষাঙ্গনে শুধু শিক্ষার আলো ছড়ানোই কাজ। সেখানে শিক্ষার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে নির্ভরযোগ্য মনে করে পাঠানো হয়। তার বিপরিত আমাদের মেয়েরা যৌন হয়রানীর স্বীকার হচ্ছে। একলঙ্ক শুধু আমাদেরই নয়। সারা বাংলার সবার । সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে মাদ্রাসার মত একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান, সেখানেও যদি আমাদের মেয়েরা যৌন নিপিড়নের শিকার হয়, তাহলে আমাদের আস্থাটা কোথায়। যৌন হয়রানী ও হত্যার সঙ্গে জড়িত সবার বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করবে – আমরা সবাই এমনটাই দেখতে চাই। সেই সাথে বাংলাদেশের সব মাদ্রাসাসহ শিক্ষাঙ্গনে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ করতে যৌন হয়রানী সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর ব্যাপারে সংশি¬্ষ্ট সবাই নজর দিবেন। আর যেন রাফির মত কোন মেয়েকে যৌন হয়রানীর স্বীকার না হতে হয়। শিক্ষকতা শুধু মানুষ গড়ার কারিগরি , মহান পেশা। কিন্তু সেখানে তা না করে জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করার অপরাধ যেন না করতে পারে। কি ছিল অপরাধ এই নিস্পাপ রাফির। সে শূধূ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিল। লম্পট অধ্যক্ষের প্রতিবাদ করায় প্রাণ দিতে হলো মাদ্রাসার ছাত্রী রাফিকে। যৌন হয়রানীর ঘটনা নিরবে মেনে নেওয়ার বদলে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল রাফির পরিবার। সে মামলায় লম্পটকে গ্রেফতার করাও হয়। কিন্তু তার লেলিয়ে দেওয়া দূর্বৃত্তরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য রাফির উপর চাপ সৃষ্টি করে। রাফি তাতে অস্বীকৃতি জানালে তার শরীরে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। লালসার লেলিহান অগ্নিতে দগ্ধ হয় নিস্পাপ ফুলের মত মেয়েটি। পিতা-মাতার একমাত্র আদরের সন্তান । তাদের কত স্বপ্ন , মেয়েকে ইসলামি শিক্ষায় গড়ে তুলবে। তারা খুব ভালো করেই জানত পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচার এটাই একমাত্র দ্বীনি পথ ও প্রতিষ্ঠান। বাবাও মাদ্রাসার দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত। তা না হয়ে সেখানে অধ্যক্ষের বিকৃত লালসার কবলে পড়ল এই রাফি। আমি বলতে চাই, মেয়েটি এক প্রতিবাদী হওয়া ছাড়া আর কিছু করে নি। জানিয়ে দিয়ে গেল আমাদের সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে, দেখিয়ে দিল বাংলাদেশে মেয়েরা যৌন নিপীড়ন ভন্ডদের কাছে মাথা নত করবে না । তারাও দু:সাহসী প্রতিবাদ করতে পারে, সোচ্চার হতে পারে। আর এই প্রতিবাদ যদি না হয়, তাহলে নুসরাত জাহান রাফির মত ঝরে যাবে আরও অসংখ্য প্রাণ।যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে আইনগত যথযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
ফেনির সোনাগাজীর মেয়ে এই নুসরাত এবছর আলিম পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী ছিলেন। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস ,এম, সিরাজ উদ দৌলার হাতে যৌন হয়রানির শিকার রাফি। এতো কিছু করার পরও শান্ত হননি তিনি। পুড়িয়ে মারার পর শান্ত হয়েছে কিনা সন্দেহ। শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে গত ২৭শে মার্চ সোনাগাজী থানায় একটি মামলা করা হয়। সেই মামলার জের ধরে রাফিকে আগুনে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু আগুন নিয়ে দৌড়ে ছাদ থেকে চিৎকার করে নামতে থাকে। এক পুলিশ কনস্টেবল তার সারা শরীরে পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ফেনি সদর হাসপাতালে এবং পরে শনিবার রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি রাফির চিকিৎসার নির্দেশ দিলেও শারীরিক অবস্থার কারণে সম্ভব হয় নি। সিঙ্গাপুর চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। গত বুধবার রাত সাড়ে ৯.৩০ টায় লাখো মানুষকে কাঁদিয়ে রাফি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। রাফির শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য যেমন লড়েছে তেমনই অধ্যক্ষের শাস্তির দাবিতেও ছিল অটল। রাফির উপর যৌন হয়রানী ও হত্যার সঙ্গে জড়িত সবার বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করতে প্রশাসন সবকিছু করবে আমরা সবাই এমনটাই আশা করি। আর মানুষ নামের পশু অধ্যক্ষের কলংক যেমন সহজেই মুছে যাবে না দেশবাসীর মন থেকে , তেমনি রাফির সতীত্ব রক্ষার বীরোচিত সাহসী ভূমিকার কথাও মানুষের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে বহুকাল। ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন রাফি।

লেখক: কবি ও শিল্পী ।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD