চলনবিলের মৃৎ শিল্প বিলুপ্তির পথে

Spread the love

মুহাম্মদ জাকির হোসেন

চলনবিলের ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্প বর্তমানে নানাবিধ সমস্যার কবলে পড়ে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চাশের দশকে সমগ্র চলনবিলাঞ্চলের প্রতিটি ঘরে ঘরে মৃৎশিেিল্পর পণ্যে ভরা ছিল। রঙ্গিন কলস-খেলনা-বাক্সসহ নানা ধরনের পণ্যে সাজানো হত শোকেস। বিয়ে মসলিসে খাবার পরিবেশন করা হত মাটির থালায়  পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত অধুনা কাঁসা যা পাতিলে ভাত রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। তখনকার দিনে প্রতি বাড়িতেই মাটির থালা কাঁসা আসবাবপত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। দাদি নানির কাছে গল্প শুনেছি মাটির পাতিলে রান্না করা ভাত তরকারী স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

এখন আধুনিকতার ঢেউ লেগেছে শহর ও গ্রামাঞ্চলে। মাটির তৈরি সামগ্রির বদলে এসেছে কাঁসা পিতল এ্যালুমেনিয়াম স্টেইনলেস ম্যালামাইন ও বর্তমানে কড়ির কাঁচ ও প্লাষ্টিকের চোখ ঝলসানো সামগ্রী। তখন থেকেই মৃৎ শিল্পের বিলুপ্তির সূত্রপাত। কালের কবলে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎ শিল্পের চোখ ধাঁধানো সামগ্রী। চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে এক গ্লাস ঠান্ডা পানির জন্য রাখা হত মাটির তৈরী বেলে কলসী। পানি  বরফের মত ঠান্ডা। কাঠফাটা রোদ ও ভ্যাপসা গরমে পান পিপাসায় প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত তখন এ কলসের এক গ্লাস পানিতে যে কত তৃপ্তিদায়ক তা শুধু তখনকার দিনের তৃষ্ণার্ত মানুষই বলতে পারত। এখন সে কালের পরিবর্তে এসেছে ফ্রিজ। তা স্বাস্থ্য সম্মত না হলেও আধুনিক কালচার বটে।

চলনবিলের বিভিন্ন উপজেলায় বসবাস করছে প্রায় দু’সহ¯্রাধিক পাল। তারা আধুনিক যুগের সাথে প্রতিযোগীতায় হেরে গিয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত। আর্থিক দৈনতায়র শিকার হয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। কথা হল গুরুদাসপুর উপজেলার নাহিরপুর গ্রামের লিটন কুমার পালের সাথে। তাদের দিনকাল কেমন যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতেই দীর্ঘনি:শ্বাস ছেড়ে বললেন- সাংবাদিক বাবু আমাদের পৈত্রিক ব্যবসা এখন লাটে উঠেছে। স্ত্রী-সন্তানাদি নিয়ে সাংসারিক জীবন আমাদের দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। দেখার কেউ নেই। কথা কটি বলতে বলতেই তার গলার আওয়াজটা কেমন যেন বেসুরো হয়ে গেল। কান্না চেপে রাখতে না পেরে কান্না বিজরিত কন্ঠে বলতে লাগলেন, আমাদের এ ব্যবসা প্রায় একশ বছরের পুরানো। আমরা হাড়ি-পাতিল-কলস-চাড়ি-ডাবর-কুয়ার পাট- ফুলদানি-জালের কাঠি-খেলনা তৈরী করি। এ শিল্পের জন্য প্রয়োজন মাটি-খড়ি-খড়-শোলা-ধানের গুড়া-বালু-ফর্মা-চাকা ইত্যাদি। বর্তমানে এক গাড়ী (ড্রাম ট্রাক) মাটির দাম পনেরশ হতে দু’হাজার টাকা। এছাড়া স্থানীয় পুলিশ ও স্থানীয় হোমরা চোমরাকে ম্যানেজ করে গুনতে হয় বাড়তি টাকা।এব্যাপারে বিষ্ণু কুমার পাল বলেন, একটা মাঝারি পাতিলে খরচ হয় কুড়ি টাকা বিক্রি হয় পচিশ টাকা। মাটির সামগ্রী তৈরী করে শুকানো ও পোড়ানোর সময় প্রায় অর্ধেকই ভেংঙ্গে চুরে নষ্ট হয়।সুনীল পাল রাম প্রসাদ মিন্টু পাল বলেন, বড়াইগ্রাম উপজেলার লক্ষীকোল গ্রামের পাল পরিবারের করুণদশা। ৫০ থেকে ৬০ খানা  বাড়ীর মাত্র শতকরা ১০ ভাগ পরিবার সরকারীভাবে যৎ সামান্য সাহায্য পায়।

বড়াইগ্রামের মুলাঢুলির পাল পাড়ার দিন মজুর সান্তনা সুজাতা-স্বরস্বতী রানী বলেন, ব্যবসার অবনতির সাথে সাথে উক্ত পেশার শ্রমিকের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। শ্রম বিক্রী করতে না পেরে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়। চলনবিলের মৃৎ শিল্পে কর্মরত পরিবার ও শ্রমজীবি মানুষের আর্থিক দৈনতা চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। এ ব্যাপারে সরকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের  আশু নেক নজর দান করা প্রয়োজন বলে ভুক্তভোগী মহল অভিমত ব্যক্ত করেন।

 

লেখক : ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি, চলনবিল বার্তা।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD