বিলু মামার নির্বাচন

Spread the love

কাইয়ুম কবির
তাহার ভবিষ্যৎ গণনা করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। আমার সাধ্য নাই তাহার মুখের উপরে কিছু বলা। বলিতে গেলে আমাকে বলিবে, কুবুদ্ধি লইয়া ফিরে যা। কি দরকার আমার। আমি গনক জ্যেতিষি নই, তাহাকে লইয়া আমার মাথা ব্যাথা করিবে। তিনি বড় মামা হওয়াতে আর কিছু বলিবার রহিল না আমার। আমি তাহার আপন ভাগিনা না ঠিক। তবে আমার জন্য তাহার অনেক চিন্তা হইতো। তাহার সমস্ত কাজ-কারবারে আমাকে লইয়া যাইতো। কোন কিছু না বলিয়া ছুটিয়া যাইতাম। কয়েক দিন আমি বাড়িতে কাজে আটকাইয়া রহিলাম। তাহার কোন প্রকার খবর নাই । ভোর বেলা আমার বাড়িতে আসিয়া জোরে জোরে আমার নাম লইয়া ডাকিতে থাকিলেন। ঘুম হইতে উঠিয়া পড়িলাম। তাহার কন্ঠ শুনিয়া উত্তর দেব না ভাবিলাম। তবু গলা ছাড়িয়া কেবল ডাকিয়া চলিলেন। আমি বিরক্ত হইয়া লেপের কভার এর পাতলা কাপড় দইু হাত দিয়া শক্ত করিয়া টানিয়া কানের ভিতর ঢুকাইয়া না শোনার ভান করিয়া শুয়ে রইলাম । আমি বুঝিতে পারিলাম আজকে জব্বর খবর আছে । কানে কাপড় লইয়া তাহাতে কোন কাজ হইলো না। বিলু মামা ঘরের দরজা চাপরাইতে লাগিলেন। আমি ঘুমের ভান করিয়া উঠিয়া পড়িলাম।

যাহা দেখিলাম মনে মনে ভাবিতেছি আজ হইতে ঘুম কামাই। অসুখ করেছে বলিয়া পাত্তা পাইলাম না। আমাকে ঘরের বাহিরে লইয়া কানে কানে বলতে লাগিলেন, কিছু দিন পড়ে নির্বাচন। ছাপাখানায় যাইতে হইবে। ছবি উঠিয়া ভাল করিয়া ছাপাইতে হইবে। আমি মাথা নারিয়া সায় দিতে দিতে বলিলাম ,ঠিক আছে। তাড়াহুরা করিয়া ছুটিয়া চলিলাম । আমার প্রিয় বিলু মামা বিভিন্ন ভঙ্গিতে পোজ দিতে লাগিলেন। বসিয়া থাকিয়া তাহার এই মোশান দেখিতে লাগিলাম। ছাপা খানা হইতে কিছু পোষ্টার লইয়া বাড়ির দিকে রওনা হইলাম। তাহার সমস্ত কাজের ভার আমার উপর পরল। ভাবিতেছি পোষ্টার কারে বলিয়া দিয়া আসিব। এসময় বিলু মামার দলের একজনকে পাইলাম। তাহার হাতে আমি সব বুঝিয়া দিয়া চলিয়া আসি। মামা আমাকে বলিলেন, ভাগিনা আজকে তাড়া করিয়া বাহিরে যাইতে হইবে। আচ্ছা বলিয়া ঘরের ভিতর ঢুকিয়া পরিলাম। ছোট পোষ্টার হাতে লইয়া ছুটিয়া চলিলাম চেনা অচেনা সবার হাতে দিতে। আর মামা বলিতে লাগিলেন, দোয়া করিবেন । এরকম কারবার দেখিয়া আমি আস্তে আস্তে হাসিতে লাগি। তাহারা সবাই ছিল যে অন্য গ্রামের মানুষ আমি কিছুই বলিলাম না। রাত হইয়া আসিল। তাহার চিহিৃত জায়গায় পোষ্টার সাটাইয়া দিলাম। নির্বাচনের ভোট চাইতে এ গ্রাম সে গ্রাম যাইয়া ভোট চাওয়া এসমস্ত কাজ আমাকেই করিতে হইতো।বিলু মামার তাই আমার উপর ভরসা একটু বেশি।
ভোট হইতে এখনো দুই মাস বাঁকি আছে । আগে ভাগে প্রচার শুরু করিয়া দিলো তাহার কাছে একটাই কারণ ,মনের মধ্যে যাহাতে এলাকার কোন লোকজন বিলু মামাকে ভুলিয়া না যায়। কেননা নতুন প্রার্থীর চেয়ে বিলু মামাকে সবাই একটু চেনেই বেশি। তাহার অনেক খ্যাতি । আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হইল, তিনি চার বার করিয়া ভোটে দাড়াইয়া ডিফিট হইয়াছেন। এজন্য এলাকার মানুষের কাছে পরিচিতি বেশি। এতে তাহার তিল মাত্র কষ্ট নাই। সব সময় ভাবিতেন, একদিন পারিতে হইবে। তাহা বুঝিয়া আগে হইতেই প্রচারনা শুরু করিয়া দিলো । জমিজমা যাহা কিছু ছিল সব বিক্রি করিয়া এলাকার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করিতে লাগিলেন। থাকিবার মতো ছোট একটা ভিটা আছে, সব আগেই ফুড়িয়ে গিয়াছে। মানা করিয়াছে অনেকে। কিন্তু কাহারো কথা কর্ণপাত করিতো না। এবার পারিবে বলিয়া তাহার কর্মীরা বুক ভরা আশ্বাস দিয়েছেন। তাহা শুনিয়া বেমালুম মাতোয়ারা হইয়া আছেন বিলু মামা। ভোটের দিন ঘনিয়া আসিতে লাগিলে আমি, বিলু মামা ও তাহার দল ,বল ব্যস্ত হইয়া পরিলাম। কেহ পায়ে হাটিয়া প্রতিটা বাড়ি দিনের বেলা ৮ থেকে ১০ বার করিয়া বিলু মামার জন্য ভোট চাহিতাম। কেহ কেহ মুখের উপর বলিয়া দিতো আর কতো বার না পারিলে তাহার ফুর্তি ফুরাইবে না। তাহা শুনে বিলু মামা কিছু না বলিয়া আমাকে কহিল, দেখিস ভাগিনা ,এবার বিপুল ভোটে জয়ী হইবো । আমি ও সায় দিয়া তাই বলিলাম । তাহার ভক্তরা পার পাবেন বলিয়া মামাকে জোর বাড়াইয়া দিতেন। আমার উপর দ্বায়িত্বটা পড়িয়া গেল আরো। কাল থেকে মাইক লইয়া শুরু করিয়া দেই । গলা ফাটিয়ে গ্যার গ্যার করে মামাকে কহিলাম, শেষ ভরসা। এবার নির্বাচন করিয়া জয়ী হইবো। মামা কহিলেন, আমি সবাধিক যোগ্য। তুই দেখিস কেহই থামাইতে পারিবে না । আমি শুনিয়া মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, সময় আসিলেই বুঝাইয়া দিবে এলাকার জনগন। আমি তাহার পক্ষ নিতে চাই নাই। কেননা কয়েকবার হারিয়েছি বলে কিন্তু বিলু মামা জোর করিয়া আমাকে সাথে রাখিতেন। আমি তাহাতে কোনো বারাবারি করি নাই । একমাত্র ভাগিনা বলে তাহার চেলাপলাকে সাথে লইয়া সকাল থেকে ভোট চাওয়া শুরু করিয়া দিলেন।
যাহারা গত নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল আমাদের সামনে বলিতো, আহা বেচারার সব শেষ হইয় গেছে। এবার না পারিলে পথে নামিতে হইবে। টাকা করি যাহা কাছে ছিল প্রায় শেষ হইয়া গেল। শুধু মুখের কথায় ভোট চাইতে আরাম্ভ করিলাম। তাহার এক কর্মী আসিয়া যা কহিলো তাহা শুনিয়া বিলু মামা ঠিক করিলেন, তাহা যদি হয় কালকে আসিয়া আমার সাথে দেখা করিবে। চলিয়া গেল লোকটি । বিলু মামার এক আতœীয় আসিয়া সব শুনিয়া তাহাকে বাধা নিষেধ দিল । কিন্তু বিলু মামা অত সহজে হাল ছাড়িবার পাত্র নয়। নিকট আতœীয় বলিলেন, পৈত্রিক ভিটা বিক্রয় না করিয়া আমার ভাতিজার নিকট হইতে কিছু টাকা লইয়্ াদেই। ভাতিজা শোনার পর কহিল বাড়ীর দলিলটা আমাকে দিয়ে দাও। বন্ধকী হিসেবে টাকা দিয়ে দেব। এই বলিয়া ঘর হইতে ব্হিরে আসিয়া টাকা বিলু মামার হাতে দিয়া চলিয়া গেল। মামা টাকা হাতে লইয়া মন মত খরচ করিতে লাগিলেন। দিন ঘনিয়া আসিল ।আর মাত্র দুই দিন বাঁকি। ভোটের জন্য তাহার কর্মীরা সবকিছু ভাল বলিয়া মামাকে সান্তনা দিতেন । মামা শুনিয়া মাথা নাড়াইতো ।এবার তাহাকে ঠেকায় কে পরিষদ নির্বাচনে। ভাবিয়া ভাবিয়া ফন্দি বাহির করিতেন। এক দল আসিয়া বলিলেন, এলাকার মানুষের মুখে রব উঠিয়া গিয়াছে- শুধু বিলু মামা, বিলু মামা । তাই কান খাড়া করিয়া মহা আনন্দে শুনিতে লাগিলেন। সব দেখিয়া ভাল বলিয়া তাহার কর্মীরা বাড়িতে চলিয়া গেলেন। সকাল থেকে আমরা সবাই মামাকে লইয়া ভোট কেন্দ্রে পৌছাইলাম। ভোট দিয়া বাহির হইয়া আমরা যার যার মতো এদিক সেদিক ঘুরিতে লাগিলাম। কোন রকম কাহারো সাউন্ড পাইলাম না। লোকজন ভোট দিয়ে তাহাদের নিজ বাড়ির দিকে রওনা হইল। একএক জন আমাদের কে বলিতে লাগিলো , বিলু মামার দাবা ভোট। তাহা শুনিয়া মামা কথার ফাকে মিষ্টি করিয়া হাসিতো। বিলু মামার শ্লে¬াগান লাগিলাম শুনিতে। মনে মনে সান্তনা পাইয়া আমি ও জেরে জেরে বিলু মামা বলিয়া তাহার দলের সাথে মিছিল করিতে ছিলাম। এবার আমাদের জয় ঠেকায় কে । চায়ের পর চা খেতে খেতে আরাম করে পরিলেন বসিয়া। একজন দুইজন কর্মী আসিয়া মামাকে ভাল খবর দিয়া চলিয়া গেল ।
আমরা সব ভোট কেন্দ্রে উপস্থিতি হইয়া খবর লইলাম। মামার ফিল্ড খুব ভাল। নতুন প্রার্থীগণ মুখ কালা করিয়া থাকিতে দেখিলাম। বয়স তাহার বেশি হওয়াতে সবাই বিলু মামা বলিয়া ডাকিতো। তিনি একই নির্বাচন ৪ বার করিয়া পাশ হয়নি। বিলু মামা থেকে শুরু করিয়া আমরা সবাই গভিরভাবে চিন্তা করিতে লাগিলাম। আবার কেউ কেউ বলিতো, এবার মামাকে ঠেকায় কে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলিল ভোট ।এখন শুধু গণনার পালা । সবাই বিলু মামাকে ঘিরে রইলাম। একজন আসিয়া বলিতো, আমরা খুশিতে চেঁচাইতে থাকি । অনেকে আসিয়া মামাকে বলিতো, দুইশো আবার কেউ কেউ বলিতো তিনশো ভোটে এগিয়ে আছেন মামা । আমরা তাহা শুনিয়া লাফাইয়া বিলু মামাকে শুন্য করিয়া গলা ফাটাইয়া বিলু মামা বলিয়া অনেকে বিলু ভাই বলিয়া চিল¬াইতে আরাম্ভ করিয়া দিলাম। খবর ভাল শুনিয়া মামা তাহার চেম্বারে চলিয়া যায়। কাঠের চেয়ারে বসিয়া গভির চিন্তায় মগ্ন হইয়া ঢুলিতে লাগিলেন। ভোট গণানা না হওয়া পর্যন্ত তাহার দিলে-অন্তরে বিশ্বাস এলো না। মামার এক চেলা আসিয়া মামাকে ধরে কহিলো, আপনি এবার চেয়ারম্যান। তাহার এই কথা শুনিয়া দলবল লাফাইতে লাফাইতে বিলু বিলু বলিয়া আকাশ মাথায় তুলিয়া নিলো ।
আমি দেখিতে লাগিলাম ,এমন করিয়া লাফ মারিলো মনে হইতো আকাশে মাথা ঠেকে যায়। বিলু মামা চুপচাপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। তাহার এমন চেহারা দেখিয়া আমি কিছু একটা বুঝিতে পারিলাম। যাহারা চিল¬াইতে ছিল তাহারা নির্বোধ বটে। গণনা সব শেষ হইয়া গেছে । এতক্ষণ সবাই মিছে খবর লইয়া চেচামেচি করিতো । বিলু মামার এক দল আসিয়া সবার মুখের উপর বলাতে আমরা সবাই চুপ করিয়া বসিয়া পড়িলাম। বিলু মামা এবারো পাঁচশো ভোটে ফেল করেছেন। তাহা শুনিয়া ফেকাসে হইয়া গেলো বিলু মামার মুখ। কর্মীরা বলিতে লাগিলেন আর তাহাকে সান্তনা দিতে থাকেন। মামা কিছুই কহিল না। সবাই চলিয়া গেল। আমি আর মামা বসিয়া রহিলাম ।তাহার ভিতরে তিল মাত্র বিচলিত ভাব দেখিতে পাইলাম না। বিলু মামা উঠিয়া আমাকে সাথে করিয়া লইলো। তাহার এরূপ আচরণ দেখিয়া আমি অবাক হইয়া যাই। প্রতিপক্ষের সাথে দুইহাত মিলাইয়া মোছাবা করিতে করিতে চলিলো। তাহাদেরকে বলিলো খুব ভাল নির্বাচন হইয়াছে। এই বলিয়া মামা আমাকে লইয়া রওনা হইলো বাড়ির দিকে। আসিলাম বাড়ীতে। ঘরের ভিতর ঢুকে ফ্যান জরে ছাড়িয়া খাটের উপর ধপাস করিয়া বসিয়া পরিলেন। চিৎকার করিয়া কহিল, কে কোথায় আছিস আমাকে হুক্কা তামাক সাজিয়ে আগুন দিয়ে যা। সঙ্গে সঙ্গে আনিয়া দিল। হটোর হটোর শব্দে টানিতে টানিতে মাথা উঁচু করিয়া ধোয়া ছাড়িয়া কহিল, এবারে না পারিলেও সামনের নির্বাচনে পারিবোই “ইন্শাআল্ল¬াহ” । তাহার এই বাক্য শুনিয়া আমি মনে মনে কহিলাম, এ জনমে আর না। পিছন ফিরে দেখি, চোখ বড় বড় করিয়া মামা আমার দিকে চাহিয়া আছে ।

লেখক : কবি, গল্পকার ও শিল্পী।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD