‘লুঙ্গি খুলে অন্তর্বাস পরীক্ষা করল এক রাজাকার’
আবদুর রাজ্জাক রাজু
তখন পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্প ও রাজাকারদের ঘাঁটি ছিল তাড়াশ থানা চত্বর ও বর্তমান তাড়াশ বাজারের গোবিন্দ মন্দির। তাদের অবাধ বিচরণ ছিল তাড়াশ বাজারে। বর্ষাকাল। একবার আমি আসানবাড়ী গ্রামের মফিজ উদ্দিন তালুকদার ও ফজলুর রহমান হেড মাষ্টারের সাথে নৌকায় তাড়াশ এলাম। পথিমধ্যে ঠেলা নৌকায় পুথিঁ পাঠ করে শুনাতে হল মুরুব্বীদেরকে। কখন তাড়াশ বাজারে নৌকা লেগেছে খেয়াল করিনি। যাহোক, নৌকা থেকে নেমে ভয়ে ভয়ে মাতব্বরদের পিছু নিলাম। কেননা, আতংক কখন যে কী হয় ! বহু পাকিস্তানী মিলিশিয়া, সেনা সদস্য, রাজাকার,আলবদর ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। তাড়াশ বাজারে এখন যেখানে হাবিব মেডিকেল ষ্টোর তার পাশেই ছিল খান পাড়ার কারো চায়ের স্টল। ততক্ষণে আমার সঙ্গীদ্বয় গ্রামীন লীডারগণ দূরে চলে গেছেন ছাতা হাতে। আমি চা স্টলের দিকে তাকাতেই তাড়াশ গ্রামের আব্দুল মাজেদ রাজাকার হাত উঁচিয়ে আমাকে ডাকলো, এই রাজ্জাক, এদিকে এসো। তার গায়ে ছিল খাকি পোশাক। আর কাঁধে বন্দুক। এই মাজেদ ভাই তাড়াশ থানা শান্তি কমিটির সভাপতি খন্দকার মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে। ওই কমিটির সেক্রেটারী মোকছেদ মৌলভী(মাষ্টার) মাজেদের চাচা ও একই সঙ্গে শ্বশুরও। তার ছোট ছেলে বর্তমানে তাড়াশ বাজারের দক্ষিণ পাশে বসবাসরত প্রতিবন্ধী সাজেদুল ইসলাম সাজ্জাদ আমার হাইস্কুলের ক্লাসমেট ও প্রায় সমবয়সী। মাজেদ বয়সে আমার বড়। এরপর মাজেদ কাছে এসে বলল, তাড়াশ এসেছো কেন? জবাবে বললাম, হেডমাষ্টার ভাই ও তালুকদার মামা সাথে নিয়ে এসেছে। তৎক্ষনাৎ সে জিজ্ঞেস করে তোমার লুঙ্গির ভেতর কি রাখা আছে। চটজলদি উত্তর দিই -না কিছু নাই তো। হয়তো সে ভেবেছে আমি মুক্তিফৌজের কোন সদস্য বা গুপ্তচর কি না। ততক্ষণে সে আমার লুংগি খসিয়ে ঝেড়ে দেখাতে বললে অন্যান্য লোকজনের সামনে আমার মুখ লজ্জায় আর ভয়ে লাল হয়ে গেল। চারদিকে চেয়ে দেখলাম, যাদের সাথে এসেছি আশপাশে তারা কেউ নেই। মাজেদ আমার লুংগিতে হাত দিল। নিরুপায় হয়ে আমি লুংগি খুলে ফাঁক করে ধরলাম। এছাড়া ঐ মুহুর্তে কোন প্রতিবাদ বা প্রত্যাখান করার উপায় ছিল না। নীচে আন্ডার প্যান্ট বা অর্ন্তবাস পড়া ছিল। সে সব নেড়ে চেড়ে দেখে আমাকে বললো-যাও এখন। আমি ততক্ষণে এত আড়ষ্ট হয়ে পড়েছি যে, কোথায় যাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর মাজেদ সলংগায় দ্বিতীয় বিয়ে করে তাড়াশ ফিরে এসে ওয়াবধা বাঁধে সপরিবার বসবাস শুরু করে। জীবিতকালে যতবারই বাজারে বা অন্যত্র তার সাথে আমার দেখা হয়েছে ততবারই সে আমাকে বলেছে,ক্ষমা করে দিও সে দিনের ঘটনার জন্য। আমি শুধু বলতাম, আপনি বেঁচে থাকলেন কী করে।
তবে ওই ঘটনার পূর্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে নিজ চোখে দেখা আরো কিছু স্মৃতিচারণে যেতে চাই। যদিও সুদীর্ঘ ৪৮ বছরে অনেক স্মৃতি অনুজ্জল, নিস্প্রভ ও বিস্মৃতির আড়ালে হারানোর পথে। অবশ্য লিখি লিখি করে এতো দিনেও স্মৃতিগুলো কেন ভালভাবে লিখলাম না, সেটা একটা প্রশ্ন নিজের কাছেই। তাড়াশের কয়েকজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধাকেও এ বিষয়ে তাদের স্মৃতিকথা কথা লিখতে অনুরোধ করেছি। লেখার জন্য রূপরেখা ধরণের ফরমেটও দিয়েছিলাম অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে। কিন্তু বাস্তবে তারা কেউই আগ্রহী নন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের কোনো স্মৃতিচারণমূলক লিখতে। এমনকি ফরমেটে তাদের তথ্য দিলে আমিই তাড়াশের মুক্তিযোদ্ধাদের সংক্ষিপ্ত জীবনীগুলো লিখে ফেলতে চেয়েছিলাম। সাড়া দিলে সে সুযোগ এখনও কিছুটা আছে।তাদের মধ্যে শুধু তাড়াশ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন ডেপুটি কমান্ডার বিনসাড়ার সাইদুর রহমান সাজু লিখেছেন নওগাঁ যুদ্ধের ইতিকথা কেন্দ্র করে কয়েক কিস্তিতে আমাদের সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তায় আমাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে। অন্যান্যদের অনীহা আমাদের কাছে কাম্য ছিল না। কারণ, তাদের ইতিহাস না থাকলে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তারা হারিয়ে যাবেন। বিস্মৃত হতে থাকবে সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবময় ইতিহাস । যেমন ইতিমধ্যে তাড়াশের ক’জন মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করলেও তাদের জীবনকাহিনি বর্তমান প্রজন্মের নিকট অজানা থেকে গেল। সেটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক বটে।