১৩ই নভেম্বর তাড়াশে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক

Spread the love

হাদিউল হৃদয় : গণহত্যা শব্দটি প্রতিটি বাংলাদেশীর কাছে খুবই স্পর্শকাতর ও ঐতিহাসিক একটি শব্দ। ইংরেজি ‘জেনোসাইড’ শব্দটি ‘গণহত্যা’ হিসেবে বাংলায় স্বীকৃত, যার অর্থ বিশেষ কোনও জনগোষ্ঠী বা ধর্ম, বর্ণ ও বিশ^াসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত পন্থায় পরিচালিত ব্যাপক হত্যাকা-, আক্রমণ ও পীড়ণ এবং যা সেই জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। জাতিসংঘের ১৯৪৯ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশনে’ও এই সংজ্ঞার স্বীকিৃত আছে। সেই কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের হাতে যে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ঘটে, তা সঠিক অর্থেই গণহত্যা বা জেনোসাইড।
১১ই নভেম্বর ১৯৭১। এই দিন সারাদেশের ন্যায় ঐতিহাসিক চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জল নক্ষত্র হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (র:) এর পূণ্য স্মৃতি বিজড়িত তাড়াশের নওগাঁ পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সংঘঠিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয় ঘটে এবং যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর প্রায় এক কোম্পানী সৈন্য নিহত হয়। তাদের দোসর রাজাকার ৫০-৬০ জন মারা যায়। তার প্রতিশোধ নিতে হানাদার বাহিনী ১৩ই নভেম্বর নওগাঁ আক্রমন করে। কিন্ত সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে তাড়াশে ফেরার পথে আমবাড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করে ১৪ জন সাধারণ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে চলে যায়।
নিমিষেই মৃতপুরীতে পরিণত হয় আমবাড়িয়া গ্রাম। হতাহতদের আর্তচিৎকারে সেদিন আমবাড়িয়া গ্রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গুলিতে ওই দিন যারা শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন- শহীদ ইয়ার মোহাম্মাদ, শহীদ মোক্তার হোসেন, শহীদ আব্দুর রহমান, শহীদ মেহের আলী, শহীদ সুলতান সেখ, শহীদ ফজলার রহমান, শহীদ মফিজ উদ্দিন সেখ, শহীদ কিয়ামত আলী প্রাং, শহীদ মজিবর রহমান, শহীদ ওসমান আলী প্রাং, শহীদ দেছের আলী প্রাং, শহীদ আমিন উদ্দিন প্রাং, শহীদ জুব্বার ফকিরও শহীদ ইয়াছিন আলী। ধ্বংসযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানী হায়েনার দল গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন গুলিতে নিহত ১৩ জনকে ঘটনাস্থলের পাশেই কবর দিয়ে রাখে।
পরবর্তীতে বর্তমান এমপি মহোদয় গাজী ম. ম আমজাদ হোসেন মিলন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে এলজিইডি এর সহায়তায় ১৩টি কবরের বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করে দেন। তারপর এই গণকবরের আর কোন উন্নয়ন নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ,স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার এবং পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবিরের সহ-অধিনায়নক এমপি মিলন মহোদয় একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও নতুন করে আর কোন উদ্যোগ নেননি। তৈরি হয়নি একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, নির্মাণ হয়নি একটি শহীদ মিনারও।এখানে মুক্তিযুদ্ধের গণকবর সংরক্ষণে কোন পদক্ষেপই নেয়া হয়নি অদ্যাবধি। আমবাড়িয়া এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে। অথচ আমবাড়িয়ায় নিহতদের জীবনীসহ এ গ্রামকে ঘিরে তথ্যচিত্র তৈরী করা হলে তা স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে বিরাট অবদান রাখবে।
৭১- এ আমবাড়িয়ার ১৩ জন নিরহ মানুষের উপর গণহত্যা চালানো হয়েছে। এটা চলনবিল তথা তাড়াশবাসীসহ সবার জানা প্রয়োজন। তথ্য প্রমাণ সবই আছে। তাই দিনটিকে স্মরণ করতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাড়াশ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে আমাদের বিন্দুবিসর্গ দ্বিধা নেই। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন, তাড়াশ উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে এই মহৎ ও স্মরণীয় কাজটি করতে এগিয়ে আসবে বলে আমরা তাড়াশবাসী আশা করি।
সকল নিহতদের স্মরণে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। যাতে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মাঝে ইতিবাচক অনুভূতির সঞ্চার হবে। এবং ১৩ নভেম্বরকে স্মরণে রাখার জন্য তাড়াশে গণহত্যা দিবস পালন করলে ভবিষ্যৎ প্রজম্ম তাড়াশে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা সম্পর্কে ইতিহাস জানতে পারবে। সাথে সাথে এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যও সমুন্নত হবে।

হাদিউল হৃদয় ঃ সম্পাদক, লেখক ও কলামিষ্ট ।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD