বহুল আলোচিত রুপা হত্যার এক বছর

Spread the love

গোলাম মোস্তফা
বহুল আলোচিত জাকিয়া সুলতানা রুপা হত্যার আজ এক বছর। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর ঢাকার আইডিয়াল ল কলেজে ভর্তি হন রুপা। লেখা পড়ার পাশাপাশি ময়মনসিংহের শেরপুরে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরিরত অবস্থায় গত বছরের ২৫ আগষ্ট বগুড়াতে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। পরীক্ষা দিয়ে কর্মস্থলে ফেরার পথে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর পৈশাচিক কায়দায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আইন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী রুপাকে। হত্যার পর ঘাতকরা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়কের মধুপুর উপজেলার পঁচিশ মাইল এলাকার বনাঞ্চলের রাস্তার ধারে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে রুপার রক্তাক্ত লাশ। লাশ উদ্ধারের পর ২৭ আগষ্ট রাতেই ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত নিরাপদ পরিবহনের ছোঁয়া নামের (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৩৯৬৩) বাসের চালক, সুপারভাইজার ও তিন হেলপারকে গ্রেফতার করে মধুপুর থানা পুলিশ। ২৯ ও ৩০ আগস্ট টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিট্রেটের আদালত আসামিদের জবানবন্দি রেকর্ড করে তাদেরকে কারাগারে পাঠান।


এদিকে রুপা হত্যার আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে দেশব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ আর প্রতিবাদ। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলতে থাকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও তোলপাড়। দাবি ওঠে, দ্রুত বিচার আইনে রুপা হত্যা মামলাটি নিষ্পত্তি করা হোক। অবশেষে প্রচলিত আইনে মাত্র ১৪ কার্যদিবসের মধ্যেই শেষ করা হয় মামলার সকল কার্যক্রম। ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক আবুল মনসুর মিঞা ৪ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। অপর আসামিকে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। একই সঙ্গে ছোঁয়া পরিবহনের সেই বাসটি ‘নির্দায়’ অবস্থায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে রুপার পরিবারকে দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে রায়ের ৭ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করে আসামিপক্ষ। সেই থেকে প্রায় ৭ মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে একবারও আপিল শুনানি হয়নি। বাসিটিও মধুপুর থানা চত্বরেই পড়ে আছে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় রুপার বড়ভাই হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি আবারও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ রুপাকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবিতে সরব দেশবাসীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। বলেন, রুপা ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের রায় যুগান্তকারী। তবে যতই দিন যাচ্ছে রায় কার্যকর নিয়ে সংশয় আর হতাশা ততই বাড়ছে। কবে হবে ছোট বোনের ঘাতকদের ফাঁসি! ৭ মাসে একবারও আপিল শুনানির তারিখ পড়েনি। আইনি জটিলতায় ছোঁয়া পরিবহনের বাসটিও আটকে আছে। পরিত্যাক্ত অবস্থায় নষ্ট হচ্ছে বাসের মূল্যবান যন্ত্রাংশ।
রুপার ছোট বোন পপির বগুড়াস্থ এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মাদ নাসীম। পপি জানিয়েছেন, প্রথম অবস্থায় সামান্য বেতনে চাকরি করছেন তিনি। নিজের খাওয়া-পড়া ও বাসা ভাড়া দেওয়ার পর তেমন কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। রুপার অকাল মৃত্যুতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাদের বিধবা মা। উন্নত চিকিৎসার অভাবে দিন দিন শয্যাসায়ী হয়ে পড়ছেন তিনি। এইচএসসি পাশ করে তাদের বড়ভাই হাফিজুর রহমান ও ছোটভাই উজ্জল হোসেন সম্পূর্ণ বেকার বসে আছেন। তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কোথাও চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে না। মূলত: তাদের দুইবোনের চাকরির টাকায় পরিবারের ৭ জন মানুষের ভরণ পোষণ চলতো। উপার্জনক্ষম রুপাকে হারিয়ে তারা একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছেন। চাকরির টাকায় নিজের কোনমতে চলছে ঠিকই। তবে পরিবারের অন্য সদস্যদের আজও খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে।
কথা হয় রুপার মা হাছনাহেনা বানুর সঙ্গে। আক্ষেপ করে বলেন, আর কেউ তার খোঁজ রাখেনা! অসুস্থ শরীর নিয়ে সারাক্ষণ শুয়ে থাকেন তিনি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বাদেও মেয়ের জন্য প্রার্থনা করে কাটে অনেকটা সময়। প্রার্থনা করেন, কবরে চির নিদ্রায় শায়িত সোনা মেয়ের আত্মার শান্তির জন্য। মা আর ভাই-বোনদের জন্য সবকিছু করার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করত রুপা। স্বপ্ন দেখতো উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একদিন বড় অফিসার হবে। তার কোন আশাই আর পূরুণ হলো না। ঠিকই সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছে মেয়েটি। এখন একটাই দাবি দ্রুত আসামিদের ফাঁসি কার্যকর হোক। তিনি আরও বলেন, রুপার মৃত্যবার্ষিকী উপলক্ষে আজ শনিবার বাড়িতে দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। ফজরের নামাজ শেষে গ্রামের মসজিদেও রুপার রুহের মাগফেরাত কামনায় বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত: স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে ২৫ আগষ্ট রাতে রুপার লাশ উদ্ধার করে মধুপুর থানা পুলিশ। পরিচয় না মেলায় ২৬ আগষ্ট ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারীশ হিসাবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ সময় মধুপুর থানায় ১টি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ২৭ আগষ্ট নিহতের বড় ভাই হাফিজুর রহমান পত্রিকায় মধুপরে অজ্ঞাত যুবতীর লাশ উদ্ধারের খবর দেখে মধুপুর থানায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি রক্তাক্ত লাশের ছবি ও ছালোয়ার-কামিজ দেখে শনাক্ত করেন যে, অজ্ঞাত যুবতীই তার ছোট বোন জাকিয়া সুলতানা রুপা। তার দেওয়া তথ্য মতে ঐদিন দিবাগত রাত ১টার দিকে মধুপর থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় পাঁচ ঘাতক। ৩১ আগস্ট রুপার মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঐদিন দিবাগত রাত আটটার দিকে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় রুপার লাশ তার গ্রাম আসানবাড়ি কবরস্থানে দাফন করা হয়।

লেখক ঃ সাংবাদিক ও নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD