ভাঙ্গুড়া(পাবনা)প্রতিনিধি : পদ্মা-যমুনার প্লাবনভূমি চলনবিলের প্রাণ বড়াল নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। এ নদী রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে ২০৪ কিলোমিটার পথ প্রবাহিত হয়ে পাবনার বেড়ার মোহনগঞ্জে যমুনায় মিলিত হয়েছে। চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করায় বড়াল এখন মৃতপ্রায়। শরৎকালেই বড়াল সংযুক্ত বিল, নদী ও খাড়িগুলোর বেশিরভাগ অংশই পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এর প্রভাবে কমেছে মাছ, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া ও জলজ গুল্ম। পানির অভাবে নদী-বিলকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে এ অঞ্চলের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। চলনবিলের অভ্যন্তরে অসংখ্য ১৬টি নদী, ৩৯ বিল ও ২২টি খাল বা খাড়ি রয়েছে।
এসব বিল ও খাল প্রাকৃতিক। আবার বিল থেকেও ছোট নদীর উৎপত্তি হয়েছে। নদী থেকে খালও হয়েছে। এক কথায় বলা চলে, চলনবিল হচ্ছে অসংখ্য স্রোতের জাল। আর এ জালের প্রধান সূত্র হচ্ছে বড়াল নদী। শরৎকালেই চলনবিলের অধিকাংশ নদী-বিল-খাড়ি নাব্য সংকটে নৌপথকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। বহুলাংশে কমে গেছে মাছ, ঝিনুক, শামুক, কাঁকড়াসহ জলজ প্রাণীর বংশবিস্তার ও উৎপাদন। ১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়ালের উৎসমুখে নির্মাণ করা হয় তিন দরজাবিশিষ্ট স্লুইসগেট। পরে ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়ি নামক স্থানে স্লুইসগেট নির্মাণ করে পদ্মা নদী থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া বড়াল নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করা হয়। এ গেটটি নির্মাণের ফলে দক্ষিণ দিকের অংশে পানি থাকলেও উত্তর দিকের অংশে পানি চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগ নন্দকুজা অন্য ভাগ বড়াল। বড়ালের উৎস্য মুখে চারঘাটে স্লুইসগেইট নির্মাণ করায় ভাটির বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় নদী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। বনপাড়ার ভাটিতে বড়াল নদীতে তৃতীয় ও চতুর্থ স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুড়া এবং চাটমোহরের দহপাড়ার কাছে। দহপাড়ার নিকটবর্তী স্লুইসগেটটির উভয় পার্শ্বই শুকিয়ে যায় শুষ্ক মৌসুমে।
অনেকেই নদী দখল করে ঘরবাড়ি, দোকান-গুদাম উঠিয়েছেন। নদীর মধ্যে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। রাজশাহীর চারঘাট থেকে সৃষ্টি হয়ে বড়াল নদী নাটোরের গুরুদাসপুরের কাছে আত্রাই নদীতে মিশেছে। এ অংশকে আপার বড়াল বলা হয়। এ অংশের দৈর্ঘ্য ৮৪ কিলোমিটার। বড়াইগ্রামের আটঘড়ি থেকে বেরিয়ে বনপাড়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ও সাঁথিয়া হয়ে শাহাজাদপুরের বাঘাবাড়ী ঘারে ভাটিতে চয়ড়ায় হুড়াসাগর নদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যমুনা নদীতে মিশেছে। এ অংশ লোয়ার বড়াল নামে পরিচিত। লোয়ার বড়ালের দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। বড়াল নদীর মোট অববাহিকা হচ্ছে ১ হাজার ৫৪২ বর্গকিলোমিটার। আপার বড়ালের গড় প্রস্থ ৬০ মিটার, গড় গভীরতা ৫ মিটার। লোয়ার বড়ালে গড় প্রস্থ ১২০ মিটার, গভীরতা ৯ দশমিক ৯০ মিটার। বড়ালের দুটি শাখা নদী হচ্ছে মুসা খাঁ এবং নন্দকুজা।
মুসা খাঁ নদীর উৎপত্তি নাটোরের বাগাতিপাড়া হাঁপানিয়ায়। পাইকপাড়া গিয়ে মুসা খাঁ নদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে নারোদ নদীর। এ নদীটি নন্দকুজা নদী হয়ে আত্রাই নদীতে মিশেছে। বড়ালের একটি প্রশাখা নাগর নদী। বড়ালের শাখা নন্দকুজার উৎপত্তি নাটোরের আটঘড়িতে। নদীটি নাটোর হয়ে গুরুদাসপুরের চাঁচকৈরে আত্রাই নদীর সঙ্গে মিশেছে। নন্দকুজা এবং আত্রাইয়ের মিলিত প্রবাহ গুমানী নাম ধারণ করে চাটমোহরের নুননগরে বড়ালে মিশে বড়াল নামেই বাঘাবাড়ী চলে গেছে। বাঘাবাড়ীর ভাটিতে বড়াল এবং করতোয়ার মিলিত প্রবাহ হুড়াসাগর নাম ধারণ করে ৮ কিলোমিটার ভাটিতে যমুনায় মিলেছে।বড়াল নদীর পারে ফরিদপুর উপজেলার ডেমড়ার কৃষক জুয়েল রানা বলেন, এক সময় এই বড়াল নদীতে ১২ মাস পানি থাকত, যা দিয়ে কৃষকের চাষের জন্য সেচ সুবিধা পাওয়া যেত; কিন্তু এখন ৩-৪ মাসের বেশি আর পানি থাকে না।ভাঙ্গুড়ার মৎস্যজীবী কেরো হলদার বলেন, আমরা এক সময় বড়াল নদীতে ১২ মাস মাছ পেতাম, এখন বড়ালে ৩-৪ মাস পানি থাকে। অন্য সময় হেঁটেই বড়াল পার হওয়া যায়। তার প্রশ্ন, পানি না থাকলে মাছ কীভাবে পাব? বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে না দিলে পরিবার নিয়ে কীভাবে জীবন চলবে।এ বিষয় ভাঙ্গুড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বাকি বিল্লাহ বলেন, বড়াল নদীর উজানে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মাণ করা এবং খনন না করায় বড়ালের এ অবস্থা হয়েছে।
মোঃ:আকছেদ আলী
ভাঙ্গুড়া পাবনা
০১৭১০৯৮৬৪৩৫