উপমহাদেশ খ্যাত বিপ্লবী রাজনীতিক তাড়াশের এম. সেরাজুল হক

Spread the love

অধ্যাপক শফিউল হক বাবলু
স্বর্ণপ্রসবা বাংলার মাটিতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে কয়জন অকুতোভয় বীর আমরণ সংগ্রাম করেন এম, সেরাজুল হক তাদেরই একজন। তিনি ছিলেন চলনবিল তথা তাড়াশের সন্তান। ১৯০৩ সালে তৎকালিন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহহুমাধীন তাড়াশ থানার মোরশেদগুনা (বর্তমান) সেরাজপুর গ্রামে তার জন্ম। পিতার নাম শেখ মেছের উদ্দিন মাতা সবজান নেছা। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক,অনলবর্ষী বক্তা,সমাজসেবী ও বিপ্লবী রাজনীতিক।
সাহিত্যিক -কর্মবীর এম, সেরাজুল হক ছিলেন এক জন বড় মাপের সাহিত্যক। সাহিত্য ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ১৫ টির অধিক বই লিখেছেন ।তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো-(১) পাকিস্থানের গজলগীতি (২) আল্লাহর পানে ফিরে চাও (৩) কেতাবুল ঈমান (৪) শেরেক ধ্বংশ ঈমান রক্ষা (৫) সুধার পেয়ালা (৬) অমর জীবন কাহিনী (ঁ৭) ভুতের বেগার (৮) ইসলাম প্রভা (৯) বিদ্রোহী তিতুমীর ও (১০) শিরাজী চরিত । হক সাহেবের “সিরাজী চরিত” বই খানি বিশ^বিদ্যালয়ের উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভুমিকা পালন করছে। উক্ত বইটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দিকপাল গাজীয়ে বলকান অনল প্রবাহের কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর একমাত্র জীবনী গ্রন্থ।
সাংবাদিকতা- কর্মবীর এম, সেরাজুল হক চলনবিলাঞ্চলের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। উনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে ব্রিটিশদের নানা অবিচার-অনাচারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম কলম হাতে তিনি প্রতিবাদ করেন। তিনি সে সময়ে ভারত বর্ষের প্রসিদ্ধ পত্র-পত্রিকায় লিখতেন। তার লেখা প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য পত্রিকাগুলো হলো- নয়াজামানা, কৃষক,ইত্তেহাদ, ইত্তেফাক,সংবাদ,ধুমকেতু,লাঙল,তরক্কী ও নবযুগ উল্লেখযোগ্য। তিনি শুধু সাংবাদিকই ছিলেন না স্বীয় মেধা ও যোগ্যতার গুণে তৎকালিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত কৃষক ও লাঙল পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলেন। সুধীজনদের মতে,কর্মবীর এম, সেরাজুল হক অবহেলিত চলনবিলবাসীর জন্য ছিলেন আর্শীবাদ। তার ক্ষুরধার লেখনির ফলে চলনবিল সফরে এসেছেন খাজা নাজিমউদ্দিন,হোসেন শহীদ সোহরাওর্য়াদী,শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সহ প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। ফলে চলনবিলবাসীকে রক্ষার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে সরকারীভাবে জনহিতকরমুলক নানা পদক্ষেপ।
রাজনীতি- কর্মবীর এম, সেরাজুল হক উপমহাদেশ খ্যাত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনের অনেকটা সময়ই হক সাহেবকে জেলে থাকতে হয়েছে। ছোট বেলা থেকেই হক সাহেব ছিলেন স্বাধীনচেতা। জমিদারদের অত্যাচার ও ইংরেজ শাসন তিনি পছন্দ করতেন না। এজন্য অতি অল্প বয়সেই হক সাহেবকে জেলে যেতে হয়েছিল। বিলাতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনে তাকে সর্ব প্রথম জেলে যেতে হয়। বিপ্লবি চেতনা ও সংগ্রামী জীবনে মহাতœা গান্ধীর আর্দশে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি কংগ্রেস রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার তার বিরুদ্ধে “ সেকশান ফোর অব ইমারজেন্সী অর্ডিনেন্স” জারী করে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করেন। ফলে তাকে ব্রিটিশ সরকার তার নিজগ্রাম মোরশেদগুনা বর্তমান ( সেরাজপুর) গ্রামে গৃহবন্দী করে রাখেন। কার্যত তাকে রাজনীতি থেকে দুরে রাখতেই এ ষড়যন্ত্র করা হয়। আন্দোলন করতে গিয়ে পিছু হঠার মানুষ হক সাহেব ছিলেন না। ব্রিটিশ সরকার তাকে বড় চাকুরীতে অধিষ্টিত করার শর্তে ক্ষমা চাইতে বলেন। হক সাহেব তাতে মাথা নত করেন নি। এর ফলে তাকে দীর্ঘদিন কারা ভোগ করতে হয়। কর্মবীর এম, সেরাজুল হক জীবনের অনেকটা সময় জেলে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। তিনি অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলে বন্দি থাকতেন। উল্লেখযোগ্য জেলখানাগুলো হলো সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কলকাতা, কৃষ্ণনগর,দমদম ও আলীপুর সেন্ট্রাল জেল। মুলত জেলে বসেই হক সাহেবের রাজনৈতিক সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এসময় তার জেল জীবনের রাজনৈতিক সঙ্গী ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, শেরেবাংলা এ,কে, ফজলুল হক . হোসেন শহীদ সোহরাওর্য়াদী, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কবি নজরুল ইসলাম, গায়ক আব্বাস উদ্দিন প্রমুখ ভারত বর্ষের বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্গ। তিনি তার আতœজীবনীতে লিখেছেন, জেল খানা যেন তীর্থ ক্ষেত্রে পরিণত হলো।
সমাজসেবা- এম, সেরাজুল হক ছিলেন চলনবিল বাসীর আর্শীবাদ। তার প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, রাস্তা- ঘাট, ঈদগামাঠ,শশান,হাট-বাজার মক্তব ও মসজিদ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তার অবদানের ফলেই তাড়াশ হতে কাঁটাগাড়ী প্রায় ১০ কিঃ মিঃ দীর্ঘ রাস্তাটি তৈরি হয়ে ছিল। উনি তখন মাধাইনগর ইউ পি চেয়ারম্যান হিসাবে মামলা ও জেল জুলুম উপেক্ষা করে রাস্তাটি তৈরি করেন। এ ছাড়া ও ঐতিহাসিক চলনবিল সাইটখাল তারই অবদান। তিনি সে সময় ৯ (নয়) লক্ষ টাকা পাকিস্থান সরকারের নিকট থেকে বরাদ্দ এনে তাড়াশ হতে নিমাইচড়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কিঃমিঃ চলনবিল বাসীর পানি নিষ্কাসনের জন্য ঐতিহাসিক চলনবিল সাইটখালটি খনন করেন। এছাড়া বস্তুল, তাড়াশ,মাটিয়ামালিপাড়া, নিমগাছি হাইস্কুল তারই সৃষ্টি। অতীব দুঃখের বিষয় তার মৃত্যুর পরে তাকে স্মরন করে রাখার মত কিছুই নেই তার জন্ম ভ’মি চলনবিল তথা তাড়াশের মাটিতে। এই ত্যাগীব্রতি কাল পূরষের জীবনের অবসান ঘটে ১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্ভর। তাকে স্বরণ করে রাখারা জন্য তাড়াশে “সেরাজুল হক স্মৃতি পাঠাগার” সেরাজুল হকের নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ “তাড়াশ – –কাঁটাগাড়ী” রাস্তাটি“ সেরাজুল হক সড়ক” নামে নামকরন করার প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। কর্মবীর সেরাজুল হক সমাজ,দেশ, জাতীর অহংকার তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সবার।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক তাড়াশ মহিলা ডিগ্রী কলেজ। মানবজমিন প্রতিনিধি-তাড়াশ, সম্পাদক সেরাজুল হক স্মৃতি পরিষদ-তাড়াশ- সিরাজগঞ্জ।

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD