শঙ্খ হচ্ছে বড় আকৃতির সামুদ্রিক শামুক। আবার শামুকের অনেক নামের মধ্যে শাঁখ, শাখ, কম্বু নামেও এর পরিচিতি আছে। সামুদ্রিক শামুক বা শঙ্খের খোল দিয়ে নকশা করে চুড়ি, ব্রেসলেট, খোঁপার কাটা, আংটি, কানের টপ বোতামসহ নানা অলঙ্কার, বাদ্যযন্ত্র, প্রভৃতি তৈরি করা যায়। আবার শাঁখারীদের কাছে পাওয়া যায় এবং বিক্রি হয় এমন সামুদ্রিক শঙ্খের হরেক রকম নামও রয়েছে। যেমন- পিটকারি, রামেশ্বরী,জাটকী,পাটি, জাহাজী প্রভৃতি। ধমীয় অনেক কাজে শঙ্খের বিবিধ ব্যবহার জড়িত আছে প্রাচীণ কাল থেকে আজ অব্দি। বিশেষ করে হিন্দু সধবা নারীদের হাতে শঙ্খের তৈরি “শাঁখা” শোভা পায়। এ ছাড়া বিভিন্ন পূঁজা-পার্বণ এবং প্রত্যাহিক শুভ কাজে কাঁটা শঙ্খের বাঁশি বাঁজানো হয়। আবার হিন্দু ধর্মে শঙ্খের ধ্বনি পবিত্র জ্ঞানে মেনে চলাও হয়। পূঁজা অর্চনা, ছেলে সন্তানের জন্ম, অন্নপ্রাশন, শ্মশান যাত্রার মতো সময় কালে শঙ্খধ্বনি দেবার ধমীয় রীতি আছে। আবার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পঞ্চ পান্ডব ও শ্রী কৃষ্ণের ঠোঁটে শঙ্খ ধ্বনি ধ্বনিত হয়েছিল। তাছাড়া দেবী দুর্গা প্রতিমার হাতেও শঙ্খ দেখা যায়।
সনাতন ধর্মালম্বীদের কাছে শঙ্খ খ্যাতি, উন্নতি, দীর্ঘায়ু এবং উর্বরতার প্রতিক হিসেবে পরিগনিত হয়। তাই ধমীয় রীতি এবং সৌন্দর্য প্রীতিসহ নানা কারণে উপমহাদেশের সনাতন ধর্মালম্বী বাঙালী নারীদের কাছে শত শত বছর ধরে শঙ্খের অলংকার চির সঙ্গী হিসেবে রয়ে গেছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন কাল থেকে থেকে শুরু করে একুশ শতকের বর্তমান প্রজন্মের সনাতন ধর্মের নারীদের কাছেও শাঁখা-পলা ছাড়া বিয়ে পূর্ণতা পায় না এটাই নিয়ম ও সত্য। যা তাঁরা মনে প্রাণে ধারণও করেন।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই শঙ্খের শাঁখা হাতে পড়ার রীতি এলো কোথা থেকে? এর পেছনে আছে বিচিত্র কিছু গল্প। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মহাভারতের সময়কাল থেকে নারীদের হাতে পড়ার শাঁখার ব্যবহার শুরু হয়। সেই সময়ে শঙ্খাসুর নামে এক অসুরের প্রতাপ প্রভাবে ত্রিভুবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকি স্বর্গের দেবতারা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শরণাপন্ন হন আরেক দেবতা বিষ্ণুর নিকট। বিষ্ণুদেব তখন ওই অসুরকে বধ করে দেবতাদের রক্ষা করেন। এরপর তার ধর্মপরায়ণ স্ত্রী তুলসী নারায়ণের কাছে স্বামীকে ফেরত পাওয়ার জন্য ধ্যান শুরু করেন। তুলসীর প্রার্থনায় নারায়ণ সারা দিলেও শঙ্খাসুরকে ফিরিয়ে দেওয়ার মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারেন না। তখন নারায়ণ শঙ্খাসুরের প্রতিক হিসেবে তারই হাড় দিয়ে এই শাঁখা তৈরি করেন এবং তুলসীকে দেন। সেই থেকেই হিন্দু বিবাহিত নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় এটি হাতে পড়া শুরু করেন। এ ছাড়াও আরো নানা মত ও গল্প আছে সনাতন ধর্মালম্বী বিবাহিত নারীদের স্বামীর মঙ্গল কামনায় হাতে পড়া শঙ্খে থেকে তৈরি শাঁখা নিয়ে।
শত বছর ধরে এই শাঁখা তৈরীর জন্যই পাবনা জেলার চলনবিলস্থ চাটমোহর উপজেলার বর্তমানে হান্ডিয়াল থানার অন্তর্গত ডেফল চড়া নামের একটি গ্রাম বা জনপদ রয়েছে। আর এ গ্রামেই রয়েছে শাঁখারী পাড়া নামের একটি পাড়ার নামকরণও। যা আজও বিদ্যমান। হান্ডিয়াল মুলত: প্রাচীণ এক জনপদ। রাধারমণ সাহার লেখা ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’ ও নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার আব্দুল হামিদ সাহেব এর লিখিত ‘চলনবিলের ইতিকথা’ গ্রন্থ দুটি থেকে জানা যায়, চলনবিলের প্রাচীন জনপথের মধ্যে হান্ডিয়াল একটি। এখানে পাইকপাড়ায় শাহ মখদুম বা বুড়া পীরে মাজার, সমাজ নামের গ্রামে শাহ মখলেছুর রহমানের মাজার অবস্থিত। পাশাপাশি ভারতের পুড়ির আদলে তৈরী করা জগনার্থ দেবের দেব মন্দির আছে। এ ছাড়া শিতলাই জমিদার বাড়ি, দো-চালা শেঠের বাংলো বা বাংলা মন্দির, ইংরেজ কুঠি বাড়ি বিদ্যমান। আর ইংরেজ শাসন আমলেও হান্ডিয়ালের নৌ-বন্দরও বিখ্যাত ছিল। পাশাপাশি ইংরেজ কুঠিবাড়ি থেকে তৎকালিন সময়ে এলাকার পাট, নীলসহ নানা পণ্য রফতানি হতো অন্যত্র। আর বর্তমানে হান্ডিয়াল চাটমোহর উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এখানে আরো আছে পূর্ণাঙ্গ একটি পুলিশ ষ্টেশন বা থানা, স্কুল কলেজসহ শতবর্ষী হাট-বাজারসহ অনেক কিছু। সেই প্রাচীন জনপদের ডেফল চড়া নামের গ্রামটিতে ৩৪ টি পরিবার তাদের পৈত্রিক বা বাপ- দাদার রেখে যাওয়া শাঁখা তৈরীর এ পেশা এখনও ধরে রেখেছেন অনেকটা মায়া মমতার বন্ধনের মতই পেশার মর্যাদা দিয়েই।
কথা হয় ডেফলচড়ার শাঁখারী পাড়ার শাঁখারী প্রায় ষাট ছুই ছুই বয়সের মধুসূদন সেনের সাথে। তিনি জানান, শঙ্খ থেকে শাঁখা তৈরীর এ কাজ তার বাবা মৃত অনিল কান্ত সেন, বাবার বাবা রাখাল চন্দ্র সেনও করেছেন। এছাড়া এ পাড়ার শাঁখারী প্রয়াত বিরোজানার্থ, কালিপদ ধরসহ অনেক নাম ডাকের শাঁখারী ছিলেন। তাই একে শত বছরের পেশা বা ব্যবসা বলা যাবে না। যা কয়েক শত বছরের একটি ঐতিহ্যবাহি শাঁখা তৈরী এবং ব্যবসার প্রসিদ্ধ নাম ডেফল চড়া শাঁখারী পাড়া এমনটিই প্রয়াত বাবা-দাদারা আমাদের জানিয়ে গেছেন গল্পের ছলে। এ কারণে আজ অব্দি ডেফল চড়ার শাঁখারী পাড়ার শাঁখারীরা নানা সিমাবদ্ধতার পরও এ পেশা আঁকড়ে ধরে দিনাতিপাত করছেন। যা আমাদের কাছে গর্বেরও বটে। কথাগুলো এক দমে বলার পর মধুসদূন সেন জানান, তার স্ত্রী নিলাবতী সেন এমন কি পাবনার চাটমোহর উপজেলার একটি কলেজে ¯œাাতকে পড়া ছেলে মনজিৎ সেনও লেখা পাড়ার পাশাপাশি শাঁখা তৈরীতে তাকে সহযোগিতা দিচ্ছেন। আর বাবা হিসেবে মধুসূদন সেন জানান, শাঁখার নকশা করতে তার ছেলে মনজিৎ সেন ভাল নঁকশাকারক। আর বলতে গেলে নঁকশার কাজে আমার ছেলে ‘বহুত আচ্ছা’ বলে এক গাল হাঁসি ঁেহসে দেন। আর চলতে চলতে ঢুকে পড়ি ডেফল চড়ার শাঁখারী পাড়ার শাাঁখারী বিকাশ ধরের বাড়িতে। সেখানে বিকাশ ধর ও তার স্ত্রী সীমা ধর আপন মনে মিলেমিশে শাঁখা তৈরীর কাজ করছেন। আর এ কাজ তার বাবা বিনয় চন্দ্র ধরও করেছেন বলে জানান। শাঁখা তৈরীর খুঁটিনাটি জানতে গিয়ে বিকাশ ধরের স্ত্রী সীমাধর জানান, তারা বাজার দর জেনে অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যায় এমন শঙ্খের বাজার যেমন- ঢাকা, খুলনা, রাজশাহীর জামনগর খেকে প্রথমে শঙ্খ কিনে আনেন। আর ১০০ টাকা থেকে ১৫ এমনকি ১৮ হাজার টাকাও রয়েছে একেকটি শঙ্খের দাম। তা বাড়িতে নিয়ে এসে ড্রিল মেশিনে কেটে ছেটে র্যাত, কর্ণা, খুটনি মেশিনে শাঁখার আকৃতি এনে নিখুঁতভাবে নঁকশা করে পালিশ দিয়ে শাঁখা তৈরী করি। আর প্রতিদিন একজন শাঁখারী বায়না বা নঁকশা ধরনে শাাঁখায় বেশি নঁকশার কাজ থাকলে ৩ থেকে ৪ জোড়া আর নঁকশা ছাড়া ২০-২৫ টি শাঁখা তৈরী করতে পারেন। শাঁখার আবার নানা নামও আছে। যেমন বাউটি, চূড়, ববি, মানতাসা ইত্যাদি। তিনি আরো জানান, এখানে যে কেবল শাঁখাই তৈরী হয় এমন না। শাঁখা ছাড়াও ব্রেসলেট, কানের দুল, আংটিসহ অনেক বিছুই স্বল্প পরিমাণ তৈরী হয়। তবে তাদের মূল কাজ নানা ডিজাইনের শাঁখা তৈরী করা। তাদের তৈরী বাউটির জোড়া ৬০০ থেকে ৭০০, চূড় ২০০০ থেকে ৫০০০, ববি ৫০০০ থেকে ৭০০০, মানতাসা ৭০০০ থেকে ১০,০০০, ব্রেসলেট ৫০০ খেকে ৬০০ টাকায়ও বিক্রি হয়। তবে যে যেমন বায়না করেন তার চাহিদার উপর নির্ভর করে শাঁখার দাম কমে ও বাড়ে। আর স্বাভাবিক ভাবে এ অঞ্চলের হিন্দু নারীরা ৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যেই এক জোড়া শাঁখা কিনে থাকেন বেশি। ডেফল চড়ার শাঁখারী পাড়ার শাঁখার মোটামুটি ভাল ব্যবসা হয় বাংলা সনের অগ্রায়ন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত। কারণ তিথি মেনে এ মাস গুলোতে সনাতন ধর্মালম্বীদের ছেলে- মেয়েদের বিয়ে বেশি হয়। আবার গ্রীস্মকালে চলনবিল এলাকায় বৈশাখী মেলায় এবং গ্রামে গ্রামে ফেরি করে শাাঁখা বিক্রি হয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। আর ডেফল চড়ার শাঁখারী পাড়ার শাঁখা বিক্রি হয় পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুরসহ আশেপাশের এলাকায়। আর শাঁখা তৈরীতে বাড়ির নারী পুরুষ মিলে মিশে কাজ করা এবং দক্ষ হলেও বিক্রির কাজটি বাড়ির পুরুষ সদস্যরাই করে থাকেন। আর শাঁখা তৈরীর আয়েই প্রাচীন জনপদ হান্ডিয়ালের ডেফল চড়া নামের গ্রামটির ৩৪টি শাঁখারী পরিবারের সদস্যদের ভড়ণ-পোষণ চলে সারা বছর। তবে কথা প্রসঙ্গে শাঁখারী বিকাশ ধর জানান, হান্ডিয়ালের ডেফল চড়ার শাঁখারী পাড়ার শাঁখার নাম-ডাক আগেও ছিলো এখনও আছে। আর এ পাড়ার বাড়ি স্থানান্তর ছাড়া তেমন কোন শাঁখারী এ পেশা ছাড়েনি। বরং বংশ পরম্পরায় শাঁখারী পাড়ার ৩৪টি পরিবার আস্থা ও বিশ্বাস রেখে বাপ-দাদার চিরচেনা এ পেশা আঁকড়ে ধরে দিনাতিপাত করছেন। তাতেই বা কম কিসে ? তবে এ ব্যবসায় মুলধন বা পুঁজি এখন অনেক বেশি লাগে। যেমন ১০ থেকে ১৫ বছর পূর্বে শাাঁখার ব্যবসায় ৫০ হাজার টাকায় যা হতো তা এখন ১ লাখ টাকায়ও হয়না। আর প্রযুক্তির উন্নতিতে শহরে আধুনিক মেশিনে তৈরী মসৃণ বাহারী নঁকশার শাঁখার বাজার দখল করার প্রতিযোগিতা কিছুটা হলেও হান্ডিয়ালের ডেফলচড়া নামের গ্রমটির শাঁখারী পাড়ার ৩৪ টি পরিবারের শাঁখা তৈরীর কাজে নিয়োজিতদের কপালে ভবিষ্যতে এ পেশার কি হবে! তা নিয়ে ভাবনার ভাঁজ পড়ছে। যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা আশা করেন, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে এই পেশা টিকিয়ে রাখা ও আরো সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে।
লেখকঃ এম. আতিকুল ইসলাম বুলবুল প্রভাষক ও প্রাবন্ধিক