অধ্যাপক শফিউল হক বাবলু
শৈশব ও কৈশর কাল থেকেই রুহুর আমিন স্যারের নাম শুনতাম। এর মূল কারণ ছিল উপমহাদেশ খ্যাত বিপ্লবী রাজনীতিক ,বিশিষ্ট সাহিত্যিক,সমাজসেবক, অনলবর্ষী বক্তা, চলনবিলের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কর্মবীর সেরাজুল হকের পরিবারে আমার জন্ম। রুহুল আমিন স্যার ছিলেন হক সাহেবের ভাব শিষ্য। হক সাহেবের শৈশব থেকেই রুহুল আমিন স্যারকে যাতায়াত করতে দেখতাম।কিশোর বয়স থেকেই রুহুল আমিন স্যার এম. সেরাজুল হকের নিকট থেকে সাংবাদিকতায় অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তার অনুপ্রেরণাতেই ১৯৬৩ সালের ১৫-ই নভেম্বর হক সাহেবের মৃত্যুর পর অত্র এলাকার শোসিত ,নিপিরিত,নির্যাতিত, হতভাগ্য মানুষের পক্ষে নিজ হাতে কলম তুলে নিয়ে আমৃত্যু সংগ্রাম করেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি রুহুল স্যার ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। মুলত শিক্ষকতা এবং পরবর্তীতে নিকাহ্-রেজিস্টার বা কাজী পেশার মাধ্যমে এবং ইত্তেফাক পত্রিকার সামান্য অর্থ দিয়ে তিনি কষ্টের করে সংসার পরিচালনা করতেন। তিনি ৬০ এর দশক হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একাধারে প্রায় ৫০ বছরের অধিককাল সাংবাদিকতা করেন। এ সময়ের মধ্যে ৬০ এর দশক হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত অতি কষ্টে সাংবাদিকতা করতেন। কারণ সে সময় সাংবাদিকতার আধুনিক যন্ত্রপাতি বা ডিভাইস ছিল না। তার সময়ে বেশির সাংবাদিকতা ছিল পোষ্ট অফিস বা ডাকঘর নির্ভর। হাতে লিখে এবং হেঁটে তখন সাংবাদিকতা করতে হত। ২০০০ সালে এসে আধুনিক সাংবাদিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে তিনি একটি ফ্যাক্স মেশিন কিনে ছিলেন। তার মাধ্যমে আমরা অপেক্ষাকৃত নবীন সাংবাদিকেরা নিউজ পাঠাতাম। বিভিন্ন সময় নিউজ পাঠাতে গিয়ে তাকে বিরক্ত করতাম। কিন্তুু তিনি কখনও বিরক্তির প্রকাশ ঘটাতেন না। তার সাথে সংবাদ সংগ্রহের কাজে গেলে কখনও বিরক্তি বা কøান্তির ছাপ চোখে পড়েনি। উপরন্ত তিনি খেয়ে না খেয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। সংবাদ সংগ্রহই ছিল তার প্রধান নেশা। মাইলকে মাইল গ্রামের পর গ্রাম তিনি ছুটে চলেছেন সংবাদের পেছনে। সত্যের সন্ধানে কখনও আপস করেন নি। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন যোদ্ধা। তার সাংবাদিকতা ছিল নিঁখুত ও স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন।
তার জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি চলনবিলের প্রায় ১০ টি থানা- পাবনা জেলার চাটমহর, ভাংগুড়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ , উল্লাপাড়া,শাহজাদপুর, রায়গঞ্জ নাটোর জেলার সিংড়া , গুরুদাসপুর,বড়াইগ্রাম,এবং বগুড়া জেলার নন্দিগ্রাম উপজেলা নিয়ে কাজ করতেন। তিনি এই বৃহৎ এলাকার দেশের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা ইত্তেফাকের চলনবিল সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করতেন। তিনি কখনও সরেজমিন তদন্ত বা চাক্ষুষ না দেখে সংবাদ লিখতেন না।
রুুহুল আমিন স্যারের সবচেয়ে বড় গর্ব ছিল তিনি কখনও অর্থ উর্পাজনের জন্য সাংবাদিকতা করতেন না। তার সুদীর্ঘ ৫০ বছর কাল সাংবাদিকতার জীবনে তাকে কেউ উৎকোচ বা ঘুষ দিয়েছে এ কথা কেউ বলতে পারে না। সীমাহীন গর্বের মাঝে তার সাংবাদিকতায় কোন কলংক নেই। আর একটি কথা না বললেই নয় রুহুল আমিন স্যার কোন অফিসে গিয়ে অফিস কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের সংগে ব›ধুত্ব গড়ে তোলেন নি। আজ কালের সাংবাদিকদের মত ইউ এন ও, ও সি, অফিস কর্ম কর্তারা না চিনলে উনি ভাল সাংবাদিক নয় এ চিন্তা তার মধ্যে ছিলনা। তিনি কখনও আমলা, মন্ত্রীদের গাড়ীতে উটতেন না। সব সময়ই একটা দুরত্ব বজায় রাখতেন। আমি একবার কৌতহল বশত স্যারকে জিজ্ঞেস করে ছিলাম, “স্যার আপনার জন্য ভি আই পি দের গাড়ী বরাদ্দ সহ ভারী খাবারের ব্যাবস্থা থাকে আপনি এটা গ্রহন করেন না কেন? ” উত্তরে উনি বলেছিলেন, “ তোমরা তরুণ সাংবাদিক, সাংবাদিকতা খুব সহজ বিষয় নয়। একজন ভাল সাংবাদিকের কোন বন্ধু নেই। আমি যদি কারো সংগে বন্ধুত্ব গড়ে তুলি তাহলে আমার কলম তার বিরুদ্ধে লিখবে না। ডিসি,এসপি, ইউএনও, ওসি,এমপি,মন্ত্রীদের সাথে সখ্যতা হলে আমি কোন ক্রাইম নিউজ শক্ত হাতে লিখতে পারব না। এটা আমি শিখেছি সাংবাদিকতার দ্বিগপাল কর্মবীর এম, সেরাজুল হকের কাছ থেকে।” রুহুল আমিন স্যার বেঁচে থাকুক যুগযুগ ধরে মানুষের হীদয়ে। তার সততা ন্যায় নিষ্টা অনুসরণ করে আমরাও আদর্শ উত্তসরী হতে চাই।
লেখকঃ সাংবাদিক, দৈনিক মানবজমিন। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, তাড়াশ প্রেসক্লাব।