চলনবিলে অস্তিত্ব সংকটে হলুদ আর লাল শাপলা

Spread the love

শাহজাহান আলী : চলনবিলের লাল শাপলা এখনও প্রকৃতি প্রেমীদের মুগ্ধ করে।প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠ পোষকতার অভাবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বিলের সৌন্দর্য।

সিরাজগঞ্জ ,নাটোর ও  পাবনা ৩ জেলার মধ্যবর্তী চলনবিলের খাল, বিলে ফোটে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা । এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার প্রতি আর্কষণ সবার চেয়ে বেশী । বর্ষা মওসুমের শুরুতে এ ফুল ফোটা শুরু হয়ে প্রায় ৬ মাস পর্যন্ত বিল ঝিল জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় লাল শাপলা । এই বিলে লাল সাদা সব ধারনের শাপলা ফুলের গন্ধে গোটা চলনবিল মুখরিত হয়ে উঠে । আবহমানকাল থেকে শাপলা মানুষের খাদ্য তালিকায় সবজি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত ছিল । চলনবিল এলাকার স্বল্প আয়ের মানুষেরা অভাবি সংসারে এক সময় শাপলা খেয়েই জীবিকা নির্বাহ করার কথা মানুষের মুখে এখনও শোনা যায় । সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধি গুনে সমৃদ্ধ । ছোটদের কাছে শাপলা ফুল একটি প্রিয় খেলনা উপকরণের পাশাপাশি অনন্ত সৌন্দর্যের আর্কষণ । ত্ড়াশ চাটমেহর.গুরুদাসপুর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, আত্র্াই, সিংড়াসহ বিল এলাকা জুড়ে শাপলা ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে থাকে । তাড়াশের হামকুড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আবুল বাশার ও মাদ্রাসার  শিক্ষক আঃ মান্নান জানান, কযেক বছর  আগেও বর্ষাকাল থেকে শরৎ কালের শেষ পর্যন্ত বিল এলাকায় মাইলের পর  মাইল মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকত নয়নাভিরাম রক্ত শাপলা বা লাল শাপলা । শুধু তাড়াশ উপজেলার হামকুড়িয়া বিলেই নয় চলনবিলের গোটা এলাকা জুড়ে এখনও লাল শাপলার অপরুপ দৃশ্য দেখা যায় । বর্ষার  শুরুতে শাপলা  জন্ম হলেও হেমন্তের শিশির ভেজা রোদ মাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রং-বেরংয়ের শাপলার বাহারী রুপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত । মনে হত, কোন এক সাজানো ফুল বাগানের মধ্যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি । এ দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না । ওই সব লাল শাপলার বিলে ছুটে আসতেন প্রকৃতি প্রেমীরা । অনেকে আবার শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে । স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় এলাকার লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে ,এবং বিভিন্ হাটে  বিক্রি করে থাকেন । গ্রামের পাশাপাশি শহরেও এখন শাপলা খাদ্য তালিকা স্থান  করে নিয়েছেন ।  বর্তমান সভ্যতায় বাড়তি জনগণের চাপের  কারণে আবাদি জমি ভরাট করে বাড়ি,পুকুর, মাছের ঘের বানানোর ফলে চলনবিলের পরিমাণ যেমন কমেছে ,তেমনি শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে । তাছাড়া জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদের কারণে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ , জলবায়ু পরিবর্তন , খাল বিল ও জলাশয় ভরাটের কারণে চলনবিল থেকে বিলুপ্ত  হয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা । এখন  খাল বিল ও জলাশয় থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা । অনেকে সৌন্দর্যের  জন্য পুকুরেও চাষ করত লাল শাপলা । তবে ওই সব পুকুর কার্প জাতীয় মাছ যেমন রোবকার্প , গ্লাসকার্প ইত্যকার মাছ চাষের ফলে শাপলার বংশ বিস্তার সমুলে বিনাশ হয়ে যাচ্ছে । তাড়াশ উপজেলা কৃষি  কর্মকর্তা লুৎফুন্নাহার লুনা জানান, সাধারণত শাপলা তিন প্রকারের হয়ে থাকে । এর মধ্যে ১.সাদা ২.বেগুনি বা হুন্দি ৩. লাল রংয়ের । এর মধ্যে সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে , বেগুনি রংয়ের শাপলা দশককে গ্ধুগ্ধ করে  ও লাল রংয়ের শাপলা ওষধি কাজে ব্যবহ্ার হয় । শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি । সাধারণ সবজির চেয়ে এর পুষ্টি গুণ অনেক বেশী । শাপলায় রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম । শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাত গুন বেশী । ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের  ডাক্তার আ: সাত্তার বলেন, শাপলা চুলকানী ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী । তা ছাড়া ডায়াবেটিস, বুক জ্বালা,লিভার, ইউরিনারী সমস্যায় উপকার সহ নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে  ।

প্রতি ১০০গ্রাম শাপলার লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩গ্রাম ,অ্যাশ ৮.৭গ্রাম,খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলোক্যালোরি প্রোটিন ৩.১গ্রাম, শর্করা৩১.৭ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম ফসফরাস ০.৩২ ড্রাই মেটার ৮.৪ ক্রড ফ্যাট ২.৮ ক্রড ফাইবার ৬২.৩ ক্রড আমিষ ১৬.৮ নাইট্রোজেন ৩৫.৪ সোডিয়াম ১.১৯ পটাশিয়াম ২.২৩ভাগ পুর্ব কাল থেকেই শাপলার ফল (ঢ্যাপ) দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খৈ ভাজা যায় । যেটি গ্রামে  গঞ্জে ঢ্যাপের খৈ বলে পরিচিত । মাটির নিচের মুল অংশকে  রাউজাম বা গ্রাম এলাকায় শালুক বলে । নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে বিল ঝিল হাওর বাওর ও পুকুরের পানি কমে যায় তখন শালুক তুলে খাওয়া য়ায় ।  হামকুড়িয়া গ্রামের ইসমাইল হোসেন (জলু )বলেন, শাপলার শালুক খেতে খুব সুস্বাদু । তিনি বলেন, শালুক পানিতে সিদ্ধ করে  খেলে আমাশয়ের জন্য বেশ উপকার হয় । তাড়াশে বাণিজ্যিকভাবে শাপলার চাষাবাদ না হওয়ায় স্থানীয় কৃষি অফিসে এর কোন পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ওই কর্মকর্তার দাবি, ৪০০ থেকে ৫০০ হেক্টর জমিতে চলনবিলে শাপলা জন্মায় । তাড়াশের মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বাচ্চু জানান, চলনবিলের খাল বিল ও আবদ্ধ জলাশায়গুলো শুকিয়ে রাখার কারণে শাপলা জন্মানোর ক্ষেত্র নষ্ট হলেও সরকারিভাবে অনুকুল পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন । বর্তমানে বন্যার পানির আর অভাব নেই। এ বছর শুরু থেকেই বন্যার পানিতে খাল বিল তলিয়ে যায়। চলনবিলে এখন পানিতে কানায় কানায় ভরে গেছে। সেখানে পদ্ম আর শাপলা ফুলে সুরভীত। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে প্রতিদিন দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে দর্শনার্থী ভীড় করছে। উপচেপড়া দর্শনার্থীর ভিড়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে আশাজাগানিয়া হলুদ আর লাল ফুলের সৌন্দর্য।প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা চলনবিলের শাপলা শালুক আর পদ্ম উৎসুক জনতার ভীড়ে নষ্ট হয়ে যা্েচ্ছ বিলের সৌরভ।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD