সুজন কুমার মাল
এক সময়ে চিত্ত বিনোদনের উপকরণ বলতে বুঝানো হতো হারমোনিয়াম, ডুগি তবলা , খোল, ঢোল, মাদল , জুড়ি, খঞ্জনী , সেতারা বাঁশের বাঁশি সহ আরো অনেক নাস না জানা উপকরণ। কিন্ত সাম্প্রতিক সময়ে সব কিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে নানা কারণে। তার মধ্যে আকাশ সংস্কৃতি ও তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণেই বেশী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলে আপনার আমার মত অনেকেই মনে করেন।
পশ্চিমা সংস্কৃতির কারণে তাদের মত আমাদের বাঙ্গালীর চিরচেনা নিজস্ব সংস্কৃতিতেও পরিবর্তনের স্পর্শ লেগেছে। এখন দেশী বাদ্যযন্ত্রের চর্চা হয়না তেমনটি। সেখানে ইলেকট্রিক গিটার, ইলেকট্রিক প্যাড, ড্রাম, ক্যাসিও সহ আরো অনেক কিছুর যান্ত্রিক উপকরণের মাধ্যমে কলা-কুশলীরা চর্চা করেন।
এক সময়ে গান বাজনার আয়োজন হতো উন্মুক্ত জায়গায় সাদামাটাভাবে। মঞ্চ সাজিয়ে মাইক বাজানো আর কিছু রঙ্গীন বাতির আলোক সজ্জা হতো সেটাও কম পরিমাণে। আর এখন চিত্ত বিনোদনের আয়োজনের অংশ হিসেবে গান বাজনার আয়োজন মানেই বিপুল পরিমাণ আলোকসজ্জা, আধুনিক সাজসজ্জা, ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে প্রচার-প্রচারণা সহ কত কি। সব মিলিয়ে আয়োজন ব্যাপকতর হলেও তার স্থায়িত্ব কম। আগে কোন একটা অনুষ্ঠান হয়ে গেলে তার আলোচনা-সমালোচনা চলতো। সেখানে কে কতটা ভাল সঙ্গীত বা নৃত্য উপস্থাপন করছেন সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনা । কিন্ত এখন আর তেমন নেই, সবাই যেন নিত্য নতুনের অনুসন্ধানে ব্যস্ত । আর হয়তো এই ব্যস্ততা-ত্রস্ততার কারণেই স্থায়িত্ব কম।
এক সময়ে চিত্ত বিনোদনের জন্য রেডিও, ক্যাসেটে শোনা , টিভি দেখা , ভিসিআর ও ভিসিডিকে নিয়ে অনেকেরই রয়েছে মনে অজানা হাজারও গল্প। পারিবারিক আড্ডা, রাতে খাবার খাওয়া কখনো বা সরকারী ছুটির দিনের শুক্রবার বিকাল বেলায় সবাই মিলে সিনেমা দেখা , আলিফ লায়লা , সিন্দাবাদ সহ অসংখ্য জনপ্রিয় অনুষ্ঠান । সেই সময়ে বিটিভিতে প্রচারিত বাকের ভাই নামের নাটক নিয়ে অনেকের রয়েছে অনেক পুরোনা স্মৃতি। পরিবারের সকলে মিলে আত্মীয় বাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার আয়োজনও হতো ছুটির দিনগুলোতে। একটা সময় স্কুল বন্ধ হলেই সকলে যাওয়া হতো মামার বাড়িতে। সেখানে মামা, মামি , মামাত ভাই বোন, নানা-নানীদের সাথে কতই রয়েছে আনন্দ বেদনার স্মৃতি। গ্রামে গ্রামে এই সময়টাতে আয়োজন হতো ফুটবল খেলা, হাডুডু খেলা , নৌকা বাইচ সহ আরো কত আয়োজন মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্য । সেখানে সকলের অংশ গ্রহণে এক অন্য রকম পরিবেশের সৃষ্টি হতো হতো কতই না খুনসুটি কে জিতবে কারা হারবে এ নিয়ে । সবাই মিলে খেলা দেখার সময় চার ছক্কা কোন খেলোয়ার মারলে বা প্রিয় দলের কোন খেলোয়ার গোল দিলে সকলে হৈ হুল্লোর সহ কত আনন্দ ছিল তখন। আর ছিল যে কোন আয়োজনই সর্বজনীন বা সকলের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা । সেসবে ছিল প্রাণের স্পন্দন, হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা। আর এখন ইট পাথরের শহরে ব্যস্ত জীবনে তেমন নেই অবসর । ঘড়ির কাটার সাথে সাথে ছুটতে হয় সকলকে।রাতে ঘুমানোর আগেই আগামীকালের পরিকল্পনা করে ঘুমাতে ঘুমাতে রাতই ভোর হয়ে যায় । তবুও আমরা কি যেন এক অদৃশ্যর শক্তির আশায় ছুটে চলেছি অবিরত। আর এই ছুটে চলা জীবনে কি পেলাম আর কি পেলাম না তা নিয়ে কি কখনো ভেবে দেখেছি আপনি আমি ? শহরে এতটুকু সবুজের সমারোহ নেই যে, যেখানে মানুষজন একটু কাজের অবসরে ক্লান্তি ভূলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। এমনকি এই গ্রামীণ সেমি শহরেও শিশুদের বিনোদনের খেলার মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে।
এখন চিত্ত বিনোদন মানুষের হাতে হাতে। সকলেই ব্যস্ত ভার্চুয়াল বিনোদন মাধ্যমে ফেসবুক , টুইটার, ইউটিউব সহ আরো কত কি। এইতো সেদিনের কথা বাড়িতে শুধু একটা করে টিভি, মোবাইল সহ সবকিছুই থাকতো সেখানে সকলে মিলে সে সকল ব্যবহার করতো । সকলের জীবন ছিল সহজ, সরল, একতা , ঐক্যতা, সৌহার্দ এবং সংঘবদ্ধ। আর এই ধারণাটির কারণেই বোধহয় পরিবার,সমাজ ব্যবস্থার মূলমন্ত্র এমনকি মানবিকতা। আর সে সময়ে একটি টিভিতেই বিনোদন উপভোগ করতো সকলে মিলে একসাথে। আর এখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই যতজন সদস্য ততটি টিভি , মোবাইল সহ আরো কত কি । হয়তো ব্যক্তি স্বাধীনতা, হয়তো পরিবর্তন এর পেছনে ভাল-মন্দ সব দিকই আছে । পরিবর্তন সকল ক্ষেত্রেই অবশ্যম্ভাবী । কালের পরিক্রমায় সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন আনতে হয় । পরিবর্তন দরকার । কিন্ত সেই পরিবর্তনের প্রভাবটা যেন ভালর চাইতে খারাপ না হয়। এখন বাড়িতে সবই আছে টিভি, মোবাইল , কম্পিউটার।কিন্ত সেগুলো ব্যাবহার করার জন্য নেই মন, নেই সেই মানসিকতাও আর এভাবে চলছে জীবন ।জীবনের তাগিদে এক স্থান হতে অন্যস্থানে দম ফেলানোর সময় নেই । সকলেই কঠিন প্রতিযোগীতার আয়োজনে আপসহীন প্রতিযোগী । আর সেই প্রতিযোগীতায় সবারই লক্ষ্য একটা বিজয় বা জয়ী হওয়া । শেখার কিছুই নেই। যদিও শেখার আছে অনেক কিছু । তাই পরিশেষে বলতে হয় সবই আছে তবুও যেন মনে হয় কি যেন নেই । তারপর কোভিড-১৯ এর ফলে আসছে নিউ নরমালের আরেক পৃথিবী। যেখানে অনেক অস্বাভাবিক বিষয়াদি স্বাভাবিকতায় পরিণত হবে বলে শোনা যাচ্ছে এবং তা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। জগত হবে আরো কৃত্রিম বুদ্ধি নির্ভর ও অনলাইন-ভার্চুয়ালের জটিল আবর্তে ঘেরা। বিনোদনও হবে তেমনি প্রযুক্তি ও জ্ঞান- বিজ্ঞানভিত্তিক। সমাজের যারা তথ্য-প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকবে তারা বিনোদন সহ জীবনজীবিকার নানা ভোগ উপভোগেও পেছনের সাড়িতে থাকবে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করে চলেছেন।
লেখক: হ্যালো : ০১৭৭২-৮১০৩৮৮