রাজনৈতিক লেবাসে প্রতারণার কৌশল

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু

কিছুদিন আগে সরকারী স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই বিচিত্র প্রতারণার দায়ে ধরা খেল বিশ্ব প্রতারক রিজেন্ট হাসপাতালের পরিচালক মো: সাহেদ করিম। যিনি করোনাকালে মানুষের জীবন নিয়ে প্রতারণা তথা মর্মান্তিক খেলা করেছেন। যুগপৎ সাবরিনা-আরিফুল জুটিও তাদের ছলচাতুরী চাপা দিতে পারলো না। এরপর আবজাল দম্পতির দুর্নীতির সমাচার। তারও পূর্বে সম্রাট, সহিদ ইসলাম আর ক্যাসিনো কান্ড চাউর হয়ে একের পর এক দেশব্যাপী আলোড়ন তুলল। এমনি নিত্য নতুন উম্মোচিত হচ্ছে কত জাল-জালিয়াতির ঘটনা। দেখেশুনে মনে হয়, কোভিড-১৯ যেভাবে এখনো লাফিয়ে বাড়ছে (অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, কোভিড-১৯ বিদায়ের পথে) তার চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে বেড়ে চলেছে সমাজে বিভিন্ন অপকর্ম, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা। এটা যেন জার্মান সমাজ বিজ্ঞানী উলরিখ বেক এর ভাষায় “ঝুঁকিপূর্ণ সমাজ” রিস্ক সোসাইটি, যেখানে দূর্যোগ-দূর্ঘটনা-ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা প্রাত্যাহিক চালচিত্র। কিন্তু আমাদের দেশে এই প্রতারণার ফাঁদ পাতার বড় কৌশল হচ্ছে- রাজনৈতিক ছত্রছায়া। বিশেষ করে দল ও রাজনীতির ছদ্মাবরনে শুধু ভূয়া প্রতারণা কাজকর্মই নয়, প্রায় সর্ব প্রকার দুস্কর্মই করা সম্ভব তথা সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। দল করলে সব হালাল। রাতারাতি বিত্ত-বিভবের মালিক হয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন করার এটাই মোক্ষ পন্থা। এখানে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি অসম্ভব বলেও কিছু নেই। অর্থাৎ এটা সব সম্ভবের দেশ।
সম্প্রতি গণমাধ্যমের খবর, দেশে দুর্নীতির সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় পর্যায়ের যত কুকীর্তির কাহিনী ইদানিং প্রতিদিন খবরের পাতায় আসে তার সিংহভাগ দলবাজীর আড়ালে সংঘটিত হয়। অর্থাৎ রাজনীতি বর্তমানে বৈধ-অবৈধ সব রকম ব্যবসা করারই উপযুক্ত ও নিরাপদ আশ্রয় স্থল যেখানে সাতখুন করেও পার পাওয়া যায়, বিচার হয় না। এক সময় রাজনীতি ও দল করা ছিল জনসেবা ও জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। সরল কথায় মানুষের উপকার করা, সহায়তা করা, সেবা করা ও সুদিনে-দুর্দিনে জনগণের পাশে থাকার মহতী চিন্তা-চেতনা কাজ করতো দল ও রাজনীতি করার মূলে। তখন রাজনীতির সাথে নীতি-নৈতিকতা এবং আদর্শ জড়িত ছিল। তবে এখন সেই ধারণা সম্পূর্ণ উল্টে দিলে তার যে বিপরীত অর্থ দাড়ায় সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি ইদানিংকার দল ও রাজনীতির চর্চ্চায়। এ যেন আপনি বাঁচলে বাপের নাম। আত্মস্বার্থপরতা ও লোভ লালসায় সয়লাব দল আর রাজনীতির মঞ্চ। তাই সম্পূর্ণ না হলেও বহুলাংশেই রাজনীতি এখন দূষিত, দুর্বৃত্তায়িত। রাজনীতিকরনেওয়ালারাও অনৈতিক ও নিজেদের আখের গোছানোতে নিমজ্জিত। নেতা হলেই অঢেল অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া চাই। সেজন্য রাজনীতির অপর নাম আজ প্রতারণা, প্রবঞ্চনা সর্বোপরি মানুষকে ঠকানোর বড় ব্যবসা বা হাতিয়ার। দলের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে সবকিছু জায়েজ হয়ে যায়। হয়ে উঠে দুর্দম, অপ্রতিরোধ্য। মনে হয় সীমা লঙ্ঘনের চূড়ান্ত চুড়ায় উঠে প্রকৃতির প্রতিশোধ না হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা অধরাই থেকে যায়। পরিবেশ দূষণের মত রাজনীতির ও দলবাজির দূষণ আজ সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এখন শুধু বালা-মছিবত ভোগ করার অপেক্ষা। মাঝে মাঝে তা ঘটেও চলেছে আমাদের সামনেই। রাজনীতির লেবাছে হচ্ছে না এমন কিছু নেই।
অতি সম্প্রতি তাড়াশে ফাঁস হওয়া ডিজে শাকিল ওরফে রাব্বি শাকিল চক্রের মহা প্রতারণার ঘটনাবলী উপরের ভাষ্যকেই জলন্ত আকারে প্রমানিত করে। এই প্রতারক চক্র একদিন গড়ে ওঠে নি। যদিও তাড়াশে এ ধরণের জাতীয়-আন্তর্জাতিক মার্কা জাল-জালিয়াতির ঘটনা এটাই প্রথম। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, প্রতারক টিমের মূল হোতা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় শাখার কোন সাধারণ সদস্য নন, একজন কেউকেটা বটে, মানে অন্যতম শীর্ষ পদের অধিকারী ,যদিও তার ভন্ডামী এবং অপকান্ড উন্মোচিত হওয়ার পর তাকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। তার পিতাও একই দলের অপর শাখার প্রধান শীর্ষ নেতা। লোকেরা বলছে, প্রতারণার মহারথী রাব্বি শাকিল এমনিতেই দলে ঢুকতে পারে নাই। কারণ, সে তাড়াশের মানুষ হলেও দীর্ঘদিন ঢাকায় অবস্থান করে নানাভাবে সেখানে হাত পাকিয়েছে নানা অপকর্ম করার প্রশিক্ষণ নিয়ে। পূর্বে রাজনীতিতে তার সংশ্লিষ্টতা বা অভিজ্ঞতা ছিল না। তারপর তাড়াশে ফিরে প্রথমেই সে তেল মেরে আর বখসীশে খুশী করার বিনিময়ে সরকার দলীয় শাখার উচ্চ পদ পেয়েছে। এরপর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে পদ-পদবী ব্যবহার করে সে অবলীলাক্রমে তার প্রতারণার সুদুরপ্রসারী মিশন চালিয়ে গেছে নির্বিঘেœ। তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তাড়াশ সদরে স্থাপন করেছে জাঁকজমকপূর্ণ একাধিক অফিস। খুলে বসেছে তথাকথিত কোম্পানী। সাথে সাথে নিয়ন সাইনবোর্ডে প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ৩০টিরও বেশী অনলাইন পত্রিকার ঘোষণা দিয়েছে যার সবগুলোর সম্পাদক-প্রকাশক সে নিজেই।
এসব তথাকথিত ইলেকট্রনিক পত্রিকার সাথে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় গণমাধ্যমের সিনিয়র সারির কেউ কেউ তা অনলাইন ভার্সন যারা দেখেছেন তাদের নজরে পড়েছে। তাছাড়া এসব পত্রিকার নামে টাকার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কত যে ভূয়া সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেসব ভূয়া সাংবাদিকরা আবার সমাজে সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে। এভাবে তারা একের পর এক নতুন নতুন সংক্রমন ছড়িয়েছে। অপরদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষকে চাকুরী দেয়া, ঋণ পাইয়ে দেয়াসহ নানা প্রকার সেবা সহযোগীতার প্রলোভন দেখিয়ে কত বিশাল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তা ক্রমশ: বেড়িয়ে এলেও এর সর্বশেষ সীমা জানতে আরো সময় লাগবে। এক্ষেত্রে মি. শাকিল দল-রাজনীতিকে ব্যবহার করা ছাড়াও স্থানীয় সরকারী বেসরকারী নাগরিক সমাজ, শীর্ষ নেতৃবর্গ ও গণমাধ্যম কর্মী ইত্যকার সব মহলকে ম্যানেজ করেই সে প্রতারণার ফাঁদ পেতে তৎপড়তা চালিয়ে গেছে। তাকে ব্যবহার করেছে স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ পর্যন্ত সৌজন্যমূলক সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে। ফলে তার দুষ্কর্মের গতি ছিল অবারিত,হাত ছিল অনেক লম্বা। এজন্য নিশ্চিন্তে তার অন্তর্ঘাতী তৎপরতা চালিয়ে যেতে স্থানীয়ভাবে তাকে কোন বাধাবিঘেœর সন্মুখীন হতে হয় নি।
আর বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে বা নেতৃবর্গকে তার ব্যবহারের কৌশল ছিল ছোট বড় দান অনুদান ও সাহায্য সহযোগীতা করা। তাড়াশের বিভিন্ন সেক্টরে সে বিভিন্ন অবদান কিংবা সৌজন্যমূলক আর্থিক ও উপকরণগত সহায়তা করেছে। দুস্থ-অসহায়দের দিয়েছে টাকা-পয়সা। মূল লক্ষ্য ছিল সবাইকে খুশী,সন্তুষ্ট করে ম্যানেজ করার মাধ্যমে তাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তার আসল উদ্দেশ্য হাসিল করা। উদাহরণস্বরুপ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কোরআনশরীফ বিতরণ, বিভিন্ন ক্লাব সমিতিতে ফ্যান, টিভি পাশাপাশি দলীয়, সরকারী বেসরকারী নানা আয়োজন অনুষ্ঠানে তার আর্থিক বদান্যতা ছিল বহুল প্রশংসিত। অথচ সবাই শুধু নিয়ে গেছে, খেয়ে গেছে, উপভোগ করেছে তার উপহার-উপঢৌকন। কেউ খোঁজ করেনি কোথা থেকে সে এসব দান-বখশিস করে যাচ্ছে। এসবের উৎস কি, হারাম না হালাল, বৈধ না অবৈধ ? এ সম্পর্কিত প্রথম আলো পত্রিকার খবরে জানা গেল , শাকিল কর্তৃক রাজশাহীর গোদাগাড়ীর প্রতারিত জনৈক ব্যক্তি তাড়াশ থানায় শাকিলের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলেও তা নেয়া হয়নি। এতে বোঝা যায় পুলিশ কর্তৃপক্ষের ডি.জে শাকিলের দুই নম্বরী, শঠতা ও ঠগবাজি কর্মকান্ড অজানা ছিল না। তা সত্তেও স্থানীয়ভাবে তার টিকিটি স্পর্শ করতে কেউ পারেনি। প্রতিদিন তার ছোটাছুটি ও দৌড়াদৌড়ি ছিল বড় কোন ভিআইপির মত। এদেশে দল রাজনীতির করে কেউ যখন ধরা খায়, তখন তাকে বহিস্কার করা হয় দল থেকে । তার পূর্ব পর্যন্ত তার স্বাদ গন্ধ উপভোগ করতে সবাই থাকে মাতাল। তাকে ব্যবহার করতে দল বা নেতারা কোন আত্মজিজ্ঞাসার ধার ধারে না। দল কাকে ভর্তি করলো ,তার কোন অতীত যাচাই -বাছাই কিংবা বিচার বিশ্লেষণ করা হয় না, শিক্ষা-জ্ঞান-প্রজ্ঞা বিবেচনা করা হয় না। তার কাজকর্মের কোন মূল্যায়ণ ও সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের কোন নিয়মনীতি দলে নেই।একারণে অজ্ঞ-মুর্খ আর মাস্তানে ছেয়ে গেছে এদেশের সব রাজনৈতিক দল যেখানে প্রকৃত রাজনীতিকদের স্থান আজ অনেকখানি সংকুচিত হয়ে এসেছে। দলগুলোর মধ্যে কোন গঠনতান্ত্রিক নিয়ম অনুশীলন করতে দেখা যায় না, গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। নেতাদের পদপদবী কিংবা চেয়ার আজীবন বদল হয় না বললেই চলে।
সবশেষে বলা যায়, তাড়াশের সাহেদ করিম ডি. জে শাকিলের সব রহস্য উদঘাটন হলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে তা অমূলক নয়। কিন্তু অতদূর পর্যন্ত জল গড়ায় কি না তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। অথবা প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় অপরাধীরা যেমন সহজেই পার পেয়ে যায় ; তেমনটি হলে শীঘ্রই তারা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার ধোয়া তুলসী পাতার মত জনজীবনের গতানুগতিক কাতারে বর্ণচোরার মত মিশে যাবে । তবে তাড়াশের যে অখ্যাতি ও দুর্নাম তা আগেও মুছে যায় নি আগামীতেও যাবে বলে মনে হয় না। হয়তো একটি পিছিয়ে থাকা জনপদের এটাই বৈশিষ্ট্য যে, এখানে দলের মধ্যে দেশে আলোড়ন জাগানো দ্বন্দ্ব-মারামারি হয়, সাড়া জাগানো চাঞ্চল্যকর বিশাল প্রতারণার ঘটনা ঘটে এবং অতি সম্প্রতি জাতির পিতাকে কটাক্ষ করার মতো হীন ও নীচ চিন্তার অনুশীলন প্রতিফলিত হয়। আর এসব এই জনপদের অনগ্রসরতা , অপ্রগতিশীল ও অনুর্বর কালচারের দৃষ্টান্ত বহন করে। তাই তাড়াশের রাজনৈতিক , সামাজিক ও নাগরিক অঙ্গনে যতদিন আদর্শ, ত্যাগী, সৎ ও সাহসী নেতৃত্বের আবির্ভাব না হবে, শিক্ষা, সংস্কৃতি-প্রগতিতে না হবে সচেতন এবং অগ্রসর ,ততদিন এখানে প্রতারণাসহ নানা কুচক্রের পদচারণা ঘটতেই থাকবে এমনটা অস্বাভাবিক নয় বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।  লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলনবিল বাতা, তাড়াশ সিরাজগঞ্জ।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD