বাবুল হাসান বকুল
কবি বলেছেন এই পৃথিবীতে যা কিছু চির কল্যাণকর অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। আমাদের বাংলা সাহিত্যকে প্রাণবন্ত ও সুন্দর করার পেছনে কবি সাহিত্যিকদের অবদান। সেকারণে আমরা কবি সাহিত্যিকদের উক্তি ও কর্মকে সম্মান করি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানব কল্যাণমুখি কাজের পেছনে নারী, পুরুষ এর অংশগ্রহণ কিংবা সুন্দরভাবে তা সম্পন্ন করা চিত্র দেখেছি কিংবা শুনেছি। তখন থেকে আমাদের কাছে কবি উপরোক্ত উক্তিটি গুরুত্ব ও মাধুর্য বেড়েছে। আমাদের দেশের সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা মুখি উদ্যোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন আরও দৃঢ় করার লক্ষে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। দেশের প্রতিটি স্তরে নারীর স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ তৈরি করার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ভূমিকা অতুলনীয় এবং প্রশংসনীয়। রাষ্ট্রীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা বাণিজ্য, কোর্ট কাচারী, অফিস আদালত এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি স্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন সভা সেমিনারে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি ও টেলিভিশনের পর্দায় নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর উন্নয়ন নিয়ে যারা কথা বলেন তিনি বা তারা অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি। আমি তাদের অনেক সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। তারা বেশিরভাগ সময় রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাষ্ট্রের অংগ প্রতিষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণকারী নারীর অধিকার নিয়ে বেশি সময় কথা বলেন এবং তা সমাধানের পথ খুঁজে বেড়ান। তার বাইরে কথা বলার মানুষ নেই তা নয়। কিন্তু তার সংখ্যা অত্যন্ত কম। নারীরা আজ পুরুষের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে রাষ্ট্রের সরকারী ও বেসরকারি কাঠামোগুলোতে কাজ করছে।
সরকারি চাকুরীতে নারী পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই। শ্রমের মর্যাদার দিক দিয়ে নারী পুরুষ সমান মুজুরী বা বেতন পাচ্ছে। আমরা আজ শতভাগ নারী শ্রমের মর্যাদা দিতে পারিনি। বাংলাদেশ সরকারের নানা মুখি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সত্বেও দেশের সর্বস্তরের মানুষের নারীর প্রতি শোষণের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হওয়ার কারণে নারীর অধিকার ও শ্রমের মর্যাদা দিতে পারিনি আমরা। আজও গ্রামীণ কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিতে অবদান রাখা নারীর জীবন জীবিকা ও শ্রমের মর্যাদা অত্যন্ত নিম্ন মানের। তাই পাঠক, আমি আজ গ্রামীণ কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিতে অংশগ্রহণকারী নারীর শোষন ও নির্যাতনের কথা আপনাদের কাছে লেখার মাধ্যমে তুলে ধরতে চলেছি। শস্য ও মৎস্য ভান্ডার নামে খ্যাত সর্ববৃহত বিলের কথা জানতে চাইলে সবাই একবাক্যে বলবে চলনবিলের নাম। শাহাজাদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, উল্লাপাড়া, তাড়াশ, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম , নলডাঙ্গা, আত্রাই, ফরিদপুর ও সিংড়া উপজেলা নিয়ে চলনবিল গঠিত। এই বিলের প্রদান শস্য বোরো ধান হলেও গম, আঁখ, পাট, গোল আলু, মিষ্টিআলু, গম, মুগ, খেসারী ডাল, মুসুর, রসুনসহ বিভিন্ন জাতের শাকসবজি চাষাবাদ করা হয়। আর ঐসব কৃষি কাজের সাথে পুরুষের পাশাপাশি অনেক শ্রমজীবী নারী অংশ নিয়ে থাকে। প্রতিদিন সকাল হলে দুমুঠো ভাতের থালা বা বাটি হাতে নিয়ে নারীরা একা কিংবা দলবেধে চলে যায় চলনবিলে। ঐসব উপজেলাগুলোর বিভিন্ন কৃষি জমিতে কেউ বা বোরো ধানের জমিতে আগাছা পরিস্কার করে, আলু, রসুন, মরিচ ও তরমুজের জমিতে পরিস্কার করে কিংবা জমি থেকে ঐসব ফসল উত্তোলনের কাজ করে। পুরুষ শ্রমিকদের সাথে বা নারীরা দল বেধে সারা দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করে মজুরীর বেলায় পুরুষের তুলনায় অর্ধেক বা তার একটু বেশি পায়। বর্তমানে পুরুষ শ্রমিকের মজুরী ৪০০/- টাকা ,সেখানে নারী শ্রমিকের মজুরী ২০০-২৫০ টাকা। পুরুষের চেয়ে নারীরা তুলনামুলক বেশি সময় পরিশ্রম করার পরেও মজুরী বৈষম্যের কারণে তাদের প্রতি মানবতা ও মানবাধিকারের চরম অবমাননা করা হচ্ছে। অনেকে বলতে পারেন, নারীরা কেমন করে পুরুষের তুলনায় বেশি কাজ করে। পুরুষ শ্রমিকেরা বিড়ি সিগারেট খাওয়ার জন্য এবং শরীর হাঁপিয়ে গেলে মাঝে মাঝে কিছু সময় কাজের বিরতি দেয়। কিন্তু নারী মাদক দ্রব্য খায় না এবং শরীর ক্লান্ত হলেও কাজের বিরতির সুযোগ নেই। কারণ তারা নারী। একটা উদাহরণ দিলে আরও পরিস্কার হয়ে যাবে বিষয়টি। বেশ কয়েকদিন আগে খেয়াল করে দেখি, একজন কৃষক রাস্তায় লোকদের সাথে কথা বলছে। আমি বললাম চাচা কি হয়েছে। লোকটি উত্তরে বললো কিছু নারী শ্রমিক লাগবে। কেননা তাদের দিয়ে পুরুষের চেয়ে বেশি সময় কাজ করিয়ে নেওয়া যায় এবং শ্রমের মজুরী কম। চলনবিলে যেসব নারী শ্রমিক কাজ করেন তাদের অনেক দুঃখ কষ্টে জীবন পার করতে হচ্ছে। এক নারী শ্রমিক বলেন, সাড়া দিন কাজ করে যা পাই তা দিয়ে আমাদের খাবার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাই। স্বামী সারা দিন কাজ করে যে টাকা পায় তা দিয়ে সর্বনাশা মাদক সেবন করে। মাঝে মাঝে আমার মজুরীর টাকাও কেড়ে নিতে চায়। না দিলে মারধর করে। সে আরও বলে, আমার মত অনেক নারী শ্রমিক আছে যারা ঘরে ফিরে মাদক আসক্ত স্বামীর হাতে শারীরিকভাবে এবং কর্মক্ষেত্রে মজুরী বৈষম্যের কারণে মানবিক নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। চলনবিলের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে অংশ নেওয়া নারীরা জানে না নারী দিবস কবে। নারী দিবসের উদ্দেশ্য কী আর কীভাবে নারীর অধিকার আন্দেলন করতে হয়। তারা শুধু স্বপ্ন দেখে, কবে তাদের শ্রমের মূল্য দেবে সমাজ। আমাদের হাতে গড়া সমাজ নয়। সমাজের মানুষ যখন ইচ্ছাকৃত সামান্য মানসিক মূল্যবোধ হারিয়ে বসে তখন তাদের কোন উপদেশ দেওয়ার কিছুই থাকে না। আজ থেকে অনেক বছর ধরে যেমন ছিল আমাদের চলনবিলের শ্রমজীবী নারীদের অবস্থা। আজও তার কোন পরিবর্তন হয়নি। শুধূ শ্রমবাজারে তাদের আগমন বেড়েছে। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সবার আগে দুমুঠো খাবার। সেই দুমুঠো খাবার পাবার আশায় আমাদের চলনবিলের হাজারও নারী শ্রমিক নিজের শরীরের ঘাম ঝরাচ্ছে। বিনিময়ে কি পাচ্ছে ওরা। পুরুষের সম পরিমাণ সময় কাজ করেও মজুরী বৈষম্যের কারণে ঠিক মতো দুমুঠো খাবারের চাহিদা মেটোতে পারছেনা তারা। নারী দিবস আসে যায় তবুও নিজেদের শ্রমের অধিকার পায় না চলনবিলের শ্রমজীবী নারীরা। বর্তমান সরকারকে বলতে চাই, আপনারা দেশের যেমন উন্নয়ন করছেন তেমনি নারীদের অনেক উন্নয়ন করেছেন এবং আরও উন্নয়নের চিন্তা আছে। সেই চিন্তার সাগরে একটু জায়গা দিন চলবিলের শ্রমজীবি নারীদের। এতে যেমন চলনবিলের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহন বাড়বে তেমনি নারীর শ্রমের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক ঃ বাবুল হাসান বকুল সাংবাদিক ও কলামিস্ট নাটোর।