রোখসানা খাতুন
প্রথম রনজিত বসাক (৪৩) এর সাথে সাক্ষাৎ হলে জিজ্ঞেস করি, আপনাদের বাড়ীর পায়খানা কোথায়। তখন সে যে দিকে হাত দিয়ে ইঙ্গিতে দেখায় সেখানে কোন ঘর বা পায়খানা স্থাপনার চিহ্ন চোখে পড়ে না। তাড়াশের মাধাইনগর ইউনিয়নের মাধাইনগর গ্রামের সনগৈ দীঘির পশ্চিম পাড়ে তার বাড়্।ী বারেক প্রশ্ন করায় সে মুচকি হাসি দেয়, কোন কথা বলে না। যার অর্থ সেটা কোন ঘর নয় খোলাস্থান, মুক্ত আকাশের নীচে। এটাই রনজিৎসহ তার আরো ৩ আত্মীয় পরিবারের অন্তত ১০ সদস্যের প্রাকৃতিক কাজ কর্ম সম্পাদনের আসল ঠিকানা। ঐ গ্রামের সমতল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পরিবারগুলোর এ করুণ দৃশ্য যুগ যুগ ধরে চলছে যার কোন উন্নয়ন বা পরিবর্তন কেউ চিন্তা করেনি। রনজিতের স্ত্রী বলেন, শেষ রাত থেকে এসব পরিবারের সদস্যরা একে একে খোলা স্থানে পায়খানা করে। ফলে ভোরের আলো ফুটে ওঠার পূর্বেই ঝোপঝাড়ে তাদের প্রাকৃতিক কর্মকান্ড সেরে ফেলতে হয়। সেকাজ শিশুদের জন্য সুবিধা হলেও নারী ও অসুস্থ বয়স্ক মানুষের জন্য ভোগান্তি স্বরুপ। কারণ শিশুরা দিনের বেলাও যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করতে পারে। বড়দের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। আর অতি বৃদ্ধ ব্যাধিগ্রস্থ আদিবাসীদের পক্ষেও রাতের অন্ধকারে ‘কর্ম সাড়া’ কষ্টদায়ক সঙ্গত কারণেই ।
অথচ এই গ্রামের আদিবাসীদের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এটা কোন ব্যাপার নয়। তারা তাদের ভাগ্যের নিয়তি বলে এই পরিস্থিতি মেনে নিয়ে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলেছে প্রাচীনকাল থেকে। রাষ্ট্র বা সরকার তাদের এই অমানবিক চিত্র বদলে দেবার কোন পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা নেয়নি। সমাজনেতারাও এটাকে কোন দায়িত্ব-কর্তব্য মনে করেনি। এমনকি সাম্প্রতিককালে তাদের সম্প্রদায়ে গজানো কিছু আদিবাসী নেতাও নানা ফন্দি ফিকিরে নিজ সম্প্রদায়ের উন্নয়নের বা সেবার কথা বলে নিজেদের মওকা ধরার চেষ্টা করছে কিংবা আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। প্রকারান্তরে আদিবাসীরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। অশিক্ষা, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন তাদের চিরায়ত সংস্কৃতির ন্যায়।
এমতাবস্থায় ফাউন্ডেশনের বিশেষ বরাদ্দ অনুদানে রনজিতের পরিবারে পাকা টয়লেট পাওয়াটা ছিল তাদের কাছে অচিন্তনীয়। তারা কখনো ভাবতে পারেনি এমনটা হতে পারে। তাছাড়া রনজিতরা এ সুবিধা পাওয়ার জন্য কোন আবেদন নিবেদনও করেনি। ফাউন্ডেশনের পরামর্শে নির্ধারিত জরীপের মাধ্যমে পার্টনার সংস্থা পরিবর্তন তাদের সনাক্তকরণের কাজটি সম্পন্ন করে। এখন তার আরো ২টি আত্মীয় পরিবার মিলে মোট ১২ জন সদস্য ঐ সেমিপাকা টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে অবর্ণনীয় উপকৃত হচ্ছে। যুগপৎ তাদেরকে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আগে বাতাসে ভেসে আসত খোলা জায়গায় মলমূত্রের দুর্গন্ধ। তাতে বাড়ীতে খাবার দাবার ও অন্যান্য কাজ কর্মে বিরক্তি লাগতো, অস্বস্তি বোধ হতো। পেটের ব্যাধি বিমার ছিল প্রাত্যাহিক ঘটনা। প্রায় দিনই ওষুধ আর ডাক্তার এর প্রয়োজন হতো। তাদের টয়লেট দেয়ার পর সে রকম স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমে গেছে। তাদের বাড়ীর পরিবেশ হয়েছে দুর্গন্ধমুক্ত, স্বচ্ছ ও সুন্দর। বড়রা সবাই পালাক্রমে টয়লেটের যতœ ও পরিচর্যা করে। টয়লেটে দেখা মিলল হারপিক ও ব্রাশের। স্বল্প শিক্ষিত রনজিৎ তার মত ব্যক্ত করে বলেন ,আমরা না চাইতেই ভগবান আমাদের এই সৌভাগ্য দিয়েছে যা আমরা পূর্বে কখনো ভাবতে পারিনি। এটা সত্যি আমাদের জন্য আশীর্বাদসবরুপ। যারা এ সাহায্য দিয়েছে সেই বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের চির কল্যাণ কামনা করি।