গাজী সৈয়দ শুকুর মাহমুদ
শয়তান কে? শয়তানের কাজ কী? শয়তান কোথায় অবস্থান করে? শয়তানের মুনাফা ও লোকসান কিসে? শয়তান জ্বীনের বংশধর। আল্লাহ পাক তাকে অনেক মর্যাদা দিয়েছিলেন। অল্পদিনেই ফেরেশতাদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠল। এক পর্যায়ে ফেরেশতাদের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছিল। মানুষের মধ্যে যেমন ৩টি নফস আছে,যথাক্রমে ১। নফসে আম্মারা, ২। নফসে মুতমাইন্ন্যা ও ৩। নফসে লাওয়াম্মা। জ্বীনের মধ্যেও তেমনি এই ৩টি নফস আছে। যেহেতু সেও জ্বীনের সন্তান তাই তার মধ্যেও ৩টি নফস আছে। অতঃপর অহংকার ও নিজের নফসের ধোকায় পড়ে আল্লাহ’র নাফরমানি করতে শুরু করে যার ফলে ফেরেশতাদের নেতৃত্বদানকারি আযাজিল বিতাড়িত শয়তানে পরিণত হয়। আল্লাহ’র পক্ষ থেকে লা’নত প্রাপ্ত হয়ে যখন বিতাড়িত হয় তখন আল্লাহ’র কাছে ৪টি বিষয়ে দাবি করেছিলো ১। কেয়ামত পর্যন্ত হায়াত, ২। বনি আদমের রগে এবং রক্তে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা, ৩। যখন তখন যে কোন রূপ ধারণ করা ও ৪। যখন যা মন চায় তা করবে। আল্লাহ’র পক্ষ থেকে তার এই ৪টি আবেদন মঞ্জুর করা হয়। এটিও হয়েছিলো তার অহংকারের ফসল। তাই তখন থেকে আযাযিল নাফরমান লা’নত প্রাপ্ত ইবলিস শয়তান হয়ে বিতাড়িত হয়েছে। তখন থেকেই ফেরেস্তাদের নেতৃত্বদানকারী আযাযিল ইবলিশ শয়তান মানুষের জাত শত্রুতে পরিণত হয়েছে। মানুষকে ধোকা দেয়া ও বিপথগামী করাই শয়তানের অঙ্গিকার।
শয়তান সাধারণতঃ তিন প্রকার। যথা- (১) বিতাড়িত ইবলিশ জাত শয়তান, (২) প্রত্যেক মানুষের ভিতরে আছে একটি শয়তানি আত্মা নফসে আম্মারা। এটি ভিতরের শয়তান, (৩) আর একটি হচ্ছে মানব শয়তান। প্রথমতঃ ইবলিশ শয়তান মানুষের ভিতরকার শয়তানি আত্মাকে অপরাধ করতে উৎসাহিত করে। তারপর ভিতরের ঐ শয়তানি আত্মা নফসে আম্মারা তার বহনকারী মানুষকে অপরাধ করতে উস্কানি দেয়। ঐ উস্কানিতে সে মানুষ যখন আল্লাহ’র নাফরমানি করে, নিষিদ্ধ কাজে নিজেকে জড়িয়ে নেয়, আল্লাহ’র হুকুমের পরিপন্থি কাজ করতে থাকে, মানবতা বিবেক বিসর্জন দিয়ে অপরাধ করতেই থাকে তখন ঐ মানুষটিও শয়তানে পরিণত হয়ে যায়। সেই হলো মানব শয়তান। পূর্বের আলোচনায় শয়তানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও তার প্রাথমিক কাজ জানা হলো। শয়তান মানুষের নিকটেই অবস্থান করে বিভিন্ন সময়ে শয়তান বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। মানুষকে বিপথগামী করতে নানাভাবে ধোকার ফাঁদ তৈরি করতে পারে। এমনকি মানুষের রগে রগে রক্তে মিশে যেতে পারে (যদি সুযোগ দেয়া হয়)।
এবার আসুন হিসেব মিলিয়ে নিন শয়তানের মুনাফা আর লোকসানের খাত কোথায়? শয়তানের শয়তানি ব্যবসায় মুনাফা হচ্ছে মানুষকে আল্লাহ’র নাফরমানি করানো, অন্যায় অপরাধে জড়িয়ে দেয়া। যে কোনভাবে মানুষকে বিপথগামী করে মৃত্যুর পর জাহান্নামে পৌছে দেয়াই শয়তানের শয়তানি ব্যবসায় মুনাফা। আর যদি মানুষ শয়তানের ধোকা থেকে বেরিয়ে এসে ভাল কাজ করে অনুশোচনা করে নিজেকে সংশোধন করতে পারে সেই মানুষ মৃত্যুর পর জান্নাতি হবে। এখানেই শয়তানের শয়তানি ব্যবসায় লোকসান হয়।
শয়তানের ব্যবসায় অপর একটি মুনাফার খাত হচ্ছে অহংকারী, শিরককারী ও মিথ্যাবাদীর কলিজায় শয়তানের বৈঠকখানা। এই তিন শ্রেণির মানুষ জাহান্নামী হবে। তাতেই শয়তানের মুনাফা। অহংকারী যথা ধন-সম্পদের অহংকার, বিদ্যা-শিক্ষায় অহংকার, জনবল বা বংশীয় অহংকার অথবা পদের অহংকার। যার্ াঅহংকারের বশবর্তী হয়ে নিজেকে খুব বড় মনে করে তারা জান্নাতে যেতে পারবে না, জাহান্নামী হবে। শিরক আরবী শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে অংশীদারত্ব। যারা আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব করবে তারাও জান্নাতে যেতে পারবে না। তাহাও জাহান্নামী হবে। মিথ্যা সকল পাপের মা। মিথ্যাবাদিরা শয়তানের দোসর তারা মানব শয়তান। তারাও জাহান্নামী। এক্ষেত্রেও শয়তানের মুনাফা শয়তান মানুষকে অপরাধ করার পথ সৃষ্টি করে। যেমন এক বুজুর্গ পথ চলতে দেখলেন শয়তান রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। তিনি শয়তানকে সাথে নিয়ে পথ চলতে লাগলেন। পথিমধ্যে এক বাজারে গিয়ে আসরের নামায পড়বেন। তিনি শয়তানকে এক দোকানের সামনে বসিয়ে রেখে নামায পড়ছেন। নামায শেষে এসে দেখেন সেখানে মানুষের জটলা। একজন মানুষ খুন হয়েছে। তিনি শয়তানকে বললেন এখানে মানুষ খুন হলো তুই কি করেছিস? শয়তান বলল, আমি তেমন কিছু করিনি শুধু বাতায় একটু গুড় লাগিয়েছিলাম। তারপর পিপড়া এসেছে গুড় খেতে। টিকটিকি এসেছে পিপড়াকে খেতে বিড়াল টিকটিকিকে তাড়া করেছে। কুকুর বিড়ালকে তাড়া করেছে। দোকানি কুকুরকে আঘাত করলে কুকুরটি মারা যায়। আর কুকুরের মালিক এসে দোকানিকে আঘাত করেছে তাতেই দোকানিও মারা গেছে। এর বেশি কিছু আমি করিনি। বুজুর্গ বললেন, এই অল্প সময়ের মধ্যেই তুই এত বড় মুনাফা করে নিলি? এখন খুনি জাহান্নামী হবে বাদী পক্ষ আদালতে মিথ্যার আশ্রয় নিবে বাদীগণ, বিবাদী পক্ষের বাড়ি-ঘর লুট করবে, বিচারক, সাক্ষী, উকিল, মহুরি ঘুষ খাবে। ফলে সকলেই জাহান্নামী হবে। এক মুসুল্লি মসজিদমুখী যাচ্ছে নামায পড়তে। একজন গাড়ী নিয়ে সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন করছে কোথায় যাবেন? তিনি বললেন নামায পড়তে মসজিদে।গাড়ীওয়ালা লোকটি কে বলল, আমার গাড়িতে আসুন আপনাকে মসজিদের দরজা পর্যন্ত পৌছে দেই। তিনি উঠলেন গাড়ীতে। যথাস্থানে মুসুল্লি নেমে বললেন কে তুমি আমাকে এগিয়ে দিলে? সে বলল আমি শয়তান। পরিচয় পেয়ে লোকটি বলল শয়তানের কাজ তো অপরাধ করা, আমাকে মসজিদে পৌছে দিয়ে তোর ব্যবসায়ে লোকসান হয়ে গেল যে? শয়তান বলল এখানেই আমার মুনাফা। কারণ আপনি হেটে এলে প্রতি কদমে নেকি লেখা হতো। আমি তা হতে দেই নি। ওর কথা শুনে মুসুল্লি দৌড়ে পুনরায় সেখানে গিয়ে হেটে এলেন। তাতে শয়তানের আর মুনাফা হলো না।
অন্য এক বুজুর্গ যোহরের নামায পড়ে ঘুমাচ্ছে। আসরের নামাযের পূর্বে শয়তান তাকে বাতাস করে ঘুমের গভিরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বুজুর্গ ঘুম থেকে উঠে দেখেন আসরের জামাত শেষ হয়ে গেছে। তিনি একা একা নামায পড়ে খুব করে কাঁদলেন। পরদিন আবারও ঘুমাচ্ছেন। নামাযের ওয়াক্তে কেউ তাকে ডেকে দিচ্ছে নামায পড়তে। বুজুর্গ তাকে প্রশ্ন করলেন কে তুমি নামাযের জন্য ডেকে দিচ্ছো? সে বলল, আমি শয়তান। বুজুর্গ বললেন শয়তানের কাজ তো নামায কামাই করা অথচ তুই …..। শয়তান বলল, গতকাল আপনার নামায কামাই করিয়ে আমার অনেক লোকসান হয়েছে তাই আজ আগে ডেকে দিলাম। তিনি বললেন আমার নামায কামাই করিয়ে তোর লোকসান কেমন হয়েছে বল। শয়তান বলল, গতকাল আপনি জামাত কামাই হওয়ায় যে কাঁদা কেদেছেন তাতে আপনার আমলনামায় সত্তর ওয়াক্তের সওয়াব জমা হয়েছে। তাই আজ আর লোকসান করতে চাই না। এই হলো শয়তানের মুনাফা আর লোকসান। মানুষ নেক কাজের উদ্দেশ্যে কত যে গুণাহ করে যাচ্ছে তার একটি বিষয় উল্লেখ করা হলো। ওয়াজ মাহফিলে শয়তানের উস্কানিতে বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে মাইক দিয়ে ওয়াজ মাহফিল অথবা উরশ এর নামে রাতভর ওয়াজ, বক্তব্য, গজল, হাম ও নাত পাঠ করে অনাধিকার চর্চা করছে। বাধ্য করা হয় মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঐ সকল বয়ান শুনতে। এতে মানুষের কষ্ট দেয়ার যে গুণাহ হয় এখানেই শয়তানের মুনাফা
শয়তানের মুনাফার অন্য একটি খাত দেখা যায়, যেমন- কারো অর্থ-সম্পদ আছে আল্লাহপাক তাকে হজ্ব¡ করার হুকুম দিয়েছেন। যার অর্থ সম্পদ আছে তার জন্য হজ্ব ফরজ (অবশ্যই করনীয়) তেমনই একজন হজ্ব করে আসলেই তার নফস শয়তান উস্কানি দিতে থাকে নামের আগে হাজী/আলহাজ্ব লিখতে। মনের মাঝে অহংকার আসে এত টাকা ব্যয় করে হজ্ব করলাম নিজে হাজী/আলহাজ্ব না লিখলে তো মানুষেরা হাজী সাহেব বলবে না। পর্যায়ক্রমে দেখা যায় যে, কেউ তার নামের আগে হাজী/আলহাজ্ব না লিখলে তিনি রাগ করেন। আপনি জানেন কি ইসলামের মূল খুঁটি ৫টি ১। কালেমা, ২। নামায, ৩। রমজানের সিয়াম, (রোজা) আর মালদারের জন্য ৪। হজ্ব ও ৫। যাকাত? আপনি কালেমা পড়ে যেমন কালামী লিখছেন না, নামায পড়ে নামাযী, রমজানে রোজা রেখে রমজানী বলেন না, যাকাত দিয়ে যেমন যাকাতী লেখা হয় না। সেহেতু হজ্ব করে হাজী/আলহাজ্ব লেখা বা পরিচয় না দেয়াই উত্তম। হজ্ব করে এসে হাজী শব্দ লিখে এটিকে অলংকার হিসেবে ব্যবহার করলে দুনিয়াতেই আপনার হজের মুনাফা চুকে যাবে। আপনি গুণাহগার হবেন। এখানেই শয়তানের আরেকটি মুনাফা। মানুষ নফস শয়তানের ধোকায় পড়ে কত যে গুণাহের কাজ করে যাচ্ছে তার হিসেব ঐ মানুষের কাছে নেই। নেক এর কাজ মনে করে অসংখ্য বিদ’আত লালন করে যাচ্ছে মানুষ। একবারও ভাবছে না কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল। কেউ কেউ আবার তা নিয়ে দল ভারী করে লড়ছে। সাবধান! কবর, হাশর, মিযান ও পুলসিরাতে কারও দল দেখে বিচার করা হবে না। যার যা আমল আছে তার উপরই বিচার করা হবে। আমাদের সমাজে যত ভুল তথ্য বা বিদ-আত যোগ হয়েছে সবই হচ্ছে হক্ক এর বিরুদ্ধে বাতিলের মহড়া। আসল কথা হচ্ছে বিতাড়িত শয়তানই শয়তানী করে। তার সহায়ক হচ্ছে মানুষের ভিতরের শয়তান নফসে আম্মারা আর মানব শয়তান।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিষ্ট শাহজ্বাদপুর,সিরাজগঞ্জ। মোবাইল- ০১৭৮২-৪৫৭৭৮৩