করোনায় মফস্বল সাংবাদিকদের দুরাবস্থা

Spread the love

শাহজাহান আলী

করোনাভাইরাসে সবকিছু আজ স্থবির। দেশের সাধারণ মানুষদের জীবনযাপন যেন দুঃসহ হয়ে উঠছে। গরিব শ্রেণির মানুষ তাও সরকারি বেসরকারি সাহায্য চাইতে পারছে বা পাচ্ছে। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন আজ সবচেয়ে বিপর্যস্ত। তারা সাহায্যের জন্য হাত পাততেও পারছেন না, আবার সংসারও চালাতে পারছেন না।সারা দেশের মফস্বলে কর্মরত অধিকাংশ সাংবাদিকরাই এ শ্রেণিভুক্ত। দেশের এ বিশেষ ক্রান্তিলগ্নে মফস্বল সাংবাদিকদের জীবন কেমন কাটছে? তাদের সংসারে খাবার আছে কি না? এ খবর কি কেউ নিচ্ছে? এ পর্যবেক্ষণে যা দেখছি তা আর বলার নয়। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত সারা দেশের সংবাদ কর্মীদের জীবন আজ গভীর খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা মান সম্মানের প্রশ্নে মুখ ফুটে কারও কাছে বলতেও পারছেন না আবার চলতেও পারছেন না। আসলে এ নিয়ে লিখতে বসে অনেক কথাই মনে ভীড় করছে। যে প্রশ্ন করেছিলাম, মফস্বল সাংবাদিকদের সংসার কিভাবে চলছে এ খবর কেউ নিচ্ছে কিনা ? এর উত্তরে কী বলবো? কে খবর নিবে? মিডিয়া মালিক না সরকার। প্রথমেই বলতে হয়, যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই মিডিয়ার দায়িত্বই সবার চেয়ে বেশি। তারপরেও সরকারের ভুমিকাও কম নয়।মিডিয়া কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে কি বলবো? মিডিয়া সম্রাটরাই ভালো বলতে পারেন তারা সে দাযিত্বটুকু নুন্যতম পালন করছেন কি না? সাংবাদিকদের করোনাভাইরাসের সুরক্ষার বিষয়টি নাই বললাম।আমার মনে হয়েছে বেশিরভাগ মিডিয়া কর্তৃপক্ষ করোনার এ দুর্যোগে মফস্বল সাংবাদিকদের খবর নেয়ার নৈতিক সাহসটিও হারিয়েছেন।কোন মুখে তারা খোঁজ নেবেন? খোঁজ নিতে গেলেই তাদের বকেয়া বেতন, কমিশনের টাকার প্রশ্ন এসে যায়। তারা তো গ্রামীণ সাংবাদিকদের ন্যূনতম স্বীকৃতি এবং সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করে থাকেন
আমার জানতে ইচ্ছা করে কয়জন মিডিয়া মালিক আছেন যারা মফস্বল সাংবাদিকদের মাচ-এপ্রিল মাসের বেতনটা দিয়েছেন। আসলে বেতন বললে ভুল হবে সাংবাদিকদের খোরপোষের দয়া ভিক্ষার টাকাটা দিয়েছেন?আবার কোন কোন মিডিয়ার সাংবাদিকরা জানেন না তাদের কত মাসের বেতন বকেয়া আছে।বিবেককে প্রশ্ন করুন তো? বলতে পারবেন না।সংবাদ কর্মীদের মধ্যেও বিভাজন দীর্ঘদিন ধরে সুস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।যারা ডেস্কে কাজ করেন তারাই যেন সংবাদ কর্মী। আর সারা দেশের মফস্বলে কাজ করেন তারা যেন গৃহভৃত্য। আজও যেন সেই মান্ধাতার আমলের দাস প্রথা চলছে।মিডিয়ার কাছে মফস্বল সাংবাদিকরা যেন সেই দাস। তাদের ক্ষুধা নেই, নেই সংসার। তাদের সন্তানদের উৎসবে জামা কাপড় লাগে না। তাই উৎসবেও কোন ভাতা নেই।তাদের কোন রোগশোকও নেই। নেই কোন করোনাভাইরাসের মৃত্যু ভয়।মিডিয়া শুধু চায় তাদের কাছ থেকে কাজ আর কাজ।একটু এমন তেমন হলেই সেই পিছন থেকে দাসের মতো বেত্রাঘাত।অধিকাংশ মিডিয়া মালিকই চান মফস্বল সাংবাদিকরা যেন অফিসে ঘুরে তাদের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে পাঠায়। যত বেশি বিজ্ঞাপন তত বেশি তাদের আয়। কিন্তু তারা একবারও কি ভাবেন বিজ্ঞাপন সংগ্রহে সংবাদকর্মীর কত টাকা খরচ করতে হয়। জানতে ইচ্ছা করে তারা কি সে খরচ দেন? আবার বিজ্ঞাপনের যে কমিশন তাও কয়টি মিডিয়া সংবাদ কর্মীদের ঠিকমতো দেন ? বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও পাওয়া য়ায় না।কী বলবো তাদের বিচার বুদ্ধির তারিফ না করলেই নয়।সাংবাদিকরা টাকা ও সময় ব্যয় করে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের কোটি কোটি টাকা আয় করে দেবে; কিন্তু তাদের প্রাপ্য অংশের কমিশনের সামান্য টাকাটাও তারা পকেটস্থ করবে।হায় এটা কেমন বিচার? তাও করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।।নিজের ভালো কিন্তু মানসিক অসুস্থরাও বোঝে, কিন্তু এ ধরণের মিডিয়া কর্তৃপক্ষ তা বেঝে না বলেই আজ মফস্বলের অনেক সাংবাদিক বিরক্ত হয়ে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ থেকে বিরত হচ্ছে।তাই তাদের মিডিয়ার আয়ও দিনের পর দিন কমছে। মফস্বল সাংবাদিকরা শুধু বৈষম্যের শিকারই নয়, যুগ যুগ ধরে তারা মারাত্মক শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত।তারা সুক্ষè প্রতারণারও শিকার বলা যায়। তার একটি নমুনা উল্লেখ করছি।অধিকাংশ মিডিয়া মফস্বল সাংবাদিকদের প্রথমে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তার মেয়াদ ৬ মাসের। এ নিয়োগ নিয়ে ২০-২৫ বছর দায়িত্ব পালন করলে ও তাদের আর কোন নিয়োগ দেয়া হয় না। দেশে ৮ম বেতন বোর্ড রোয়েদাদ কার্যকর ২৫- ৩০টি মিডিয়া আছে।তারা মিডিয়া ষ্টাফদের এ বেতন বোর্ডের আওতা দেখিয়েছেন।আমার প্রশ্ন সেক্ষেত্রে কয়টি মিডিয়া মফস্বল সাংবাদিকদের সে বেতন বোর্ডের আওতায় এনেছেন? হয়ত তাদের যুক্তি মফস্বল সাংবাদিকরাতো স্থায়ী নিয়োগকৃত ষ্টাফ নয়।
এখানে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মফস্বল সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়ণ দেখানো হচ্ছে। আর এভাবে বেতনবোর্ড রোয়েদাদ কার্যকর দেখিয়ে মালিক পক্ষ সরকারি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়িয়ে নিয়ে কোটি কোটি টাকা বাড়তি আয় করছেন। আর মফস্বল সাংবাদিকরা শুধু চেয়ে চেয়ে চোখের জল ফেলছেন। অথচ এটা যে শ্রম আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন তা কি কেউ দেখছে? শ্রম আইনে অস্থায়ী নিযোগপ্রাপ্তদের ৬ মাস পার হলে তাদের দিয়ে কাজ করালে স্থায়ী নিয়োগ বলে গণ্য হয়।তাই অস্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত মফস্বল সাংবাদিকরা বছরের পর বছর যারা কাজ করছেন তারা স্থায়ী বলে আইনের চোখে গণ্য হলেও মিডিয়ার চোখে অস্থায়ী।এটা আইনগতভাবে সিদ্ধ না হলেও দেখার কেউ নেই? না আছে সরকারের ভুমিকা না আছে সাংবাদিক সংগঠনের কোন ভুমিকা। যে যার মতো স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। তাদের ভাবটা এমন ব্যাটারা এভাবেই কাজ কর, না হলে না কর। তাদের পেটে ভাত উঠুক বা না উঠুক তাতে কি? প্রতিটি মিডিয়ায় সাংবাদিক ইউনিয়নের শাখা আছে তারাও মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন।তারা নিজেদের পাওনা পেলেই খুশি আর মফস্বল সাংবাদিক সে তো নিম্ন বর্ণের অস্পৃশ্য, হরিজন,তারা কি মানুষ?
আজ না হয় করোনার কারণে সংবাদপত্র শিল্পে মারাত্মক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে কি মফস্বল সাংবাদিকদের মুল্যায়ণ করা হয়। যদিও বলা হয় মফস্বল সংবাদই হলো পত্রিকার প্রাণ।আর পত্রিকার বিজ্ঞাপনের সিংহভাগই আসে মফস্বল সাংবাদিকদের হাত থেকে।তারপরেও মফস্বল সাংবাদিকদের সাথে এ বিমাতাসুলভ আচরণ কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। বলতে সংশয় নেই, এক শ্রেণির মিডিয়ার কারণে আজ মফস্বলে হলুদ সাংবাদিকতা ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। বিশেষ কিছু মিডিয়া টাকার বিনিময়ে কার্ড বিক্রি করে সাংবাদিক তৈরি করে তাদের যেন ব্লাকমেইলিং করার লাইসেন্স দিয়েছে। এটা প্রিন্ট ইলেকট্রোনিক উভয় মিডিয়া ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।।আবার এমন মিডিয়াও দেখা যায় যারা সাংবাদিকদের কাছ থেকে মাসিক চুক্তিতে নজরানা আদায় করেন। আজ যারা ন্যায় নিষ্ঠার সাথে সাংবাদিকতা করছেন তারা যেন মুখ লুকিয়ে চলতে হচ্ছে।এমনিতেই তারা সারা বছর অভাব অনটনে জীবন কাটান আর করোনায় বর্তমানে তারা দুঃসহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।তারা সম্মানের ভয়ে বলতেও পারছেন না চলতেও পারছেন না।তাদের বোবা কান্না কে দেখবে? কে শুনবে তাদের মনের বেদনা, যন্ত্রণা।দেখলাম সংবাদপত্র মালিক সংগঠন সরকারের কাছে পাওনা বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের আবেদন করেছেন। তথ্যমন্ত্রী জরুরিভাবে তা পরিশোধের ও নির্দেশ দিয়েছেন।
হয়ত সরকার দ্রুত বকেয়া পরিশোধ করবে। এটা এ সময়ে ভালো খবর বটে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বকেয়া বিজ্ঞাপনের টাকা পাওয়ার পরেও কয়জন মালিক মফস্বল সাংবাদিকদের পাওনা বেতন পরিশোধ করবেন? তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? আসলে আমরা অন্যের দুর্নীতি অনিয়মের সংবাদ পরিবেশন করি কিন্তু আমাদের দুর্নীতির খবর কবে কোথায় প্রকাশ হবে? কে তা করবে? সাংবাদিকেরা অন্যের সমালোচনা করে, অথচ তাদের সমালোচনা করবে কে ? সরকারিভাবে সাংবাদিকদের উৎসাহ ভাতা দেয়ার খবর দেখলাম। প্রেস কাউন্সিল সারা দেশের সাংবাদিকদের তালিকা চেয়ে চিঠি দেয়ার পরেও তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।সরকারের তরফ থেকে কিভাবে প্রণোদনা দেয়া হবে? কারা পাবেন? এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যাহোক, মফস্বল সাংবাদিকদের দুরাবস্থা জানানোর কোন প্লাটফর্ম নেই। সারা দেশে তাদের সংগঠনও নেই। ইউনিয়নভূক্ত অভিজাত সাংবাকিরা বিভক্তি-বিভাজনের পর্যুদস্ত। তাই গ্রামীনণ সংবাদসেবকদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ জানানো ছাড়া আর কি আছে? এভাবেই চলছে চলবে তাতে যেন কারো কিছু এসে যায় না। আমরা মনে হয়, নিজেরা দুর্নীতিমুক্ত না হয়ে মুখে যতই দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই না কেন তা হবে বিবেকের বরখেলাপ।তাই আগে নিজেদের বদলাতে হবে তার পর অন্যকে বদলে যাওয়ার কথা বলা আমাদের জন্য মানানসই হবে।আমরা যে অবস্থানেই থাকি না কেন তারা যদি ন্যায় নীতিকে প্রধান্য দিয়ে ন্যায্যতার চর্চা করি তাহলে আমাদের সমাজ হবে মানবিক সমাজ।আর যতদিন এ মানবিক সমাজ গড়ে না উঠবে ততো দিন সর্বস্তরে শোষণ নিপীড়ণ চলতেই থাকবে। তাই আগে সাংবাদিক সমাজের বিবেককে জাগ্রত করুন। এভাবে শোষন-বঞ্চনা আর কতকাল চলবে। আমরা সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তথা মফস্বলের লেখক- সাংবাদিকরা আর কতকাল শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হবো তার উপলদ্ধি কবে হবে তা বিচার বিশ্লেষণের ভার পাঠকের উপরই ছেড়ে দিলাম।

লেখক : চলনবিলের বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD