মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিকথা

Spread the love

অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই

আমি একটি পাটসোলার বেড়া দেয়া ছোট্র টিনের ছাপড়া ঘরে একাকী শুয়ে ছিলাম সে রাতে। গুমানী নদীর তীর থেকে বেশী দুরে নয় ঘরটি। এটা তৎকালীন গুরুদাসপুর থানার চাঁচকৈড়ের ভাটিতে গুমানী নদী তিরবর্তী মসিন্দা বাহাদুর পাড়া গ্রাম। রাত আনুমানিক দেড়-দুইটা হতে পারে। বাড়ীর সবাই নিজেদের ঘরে ঘুমিয়ে গেছে। ওরা কখন সন্তর্পণে এসে এ বাড়ীতে হানা দিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে তা কেউ টের পায়নি। ঘুমন্ত অবস্থায় তারা আচমকা আমাকে টেনে তুলে নিষ্ঠুরভাবে একরূপ টেনে হিচড়ে মুহুর্তেই আমাকে নদীর কিনারে নিয়ে গেল। শোলার বেড়ার ঘরের দরজা ছিল শোলার বাঁধাই এক কপাট যা শুধু গুনা দিয়ে খামের সাথে আটকিয়ে বন্ধ করা ছিল।  ফলে আমার ঘরে ঢুকতে তাদের বেগ পেতে হয় নি। আর এরা সবাই স্থানীয়। সে কারণে হয়তো পূর্বাহ্নেই আমার অবস্থান জেনে নিয়েছে এবং সুযোগ বুঝে হানা দিয়েছে। অধিকন্ত এসব বাড়ীঘরও তাদের নেহাতই  ছিল চেনাজানা।

 

যাহোক, আচমকা ঘুম থেকে টেনে তোলার ফলে  আমার পরণে  কেবল লুংগি ছিল। গায়ে শুধু গেঞ্জি। মনে পড়ে হঠাৎ ঘুম থেকে জাগার কারণে তেমন একটা জ্ঞান চেতনা ছিল না প্রথমে । সেই হেতু ভয়, ভড়কে যাওয়া, চিৎকার দেয়া কিছুই হল না।তাছাড়া তারা আমাকে কোনো প্রকার চিৎকার না দিতে বা শব্দ না করতে ইশারা-ইঙ্গিতে ও চাপা কণ্ঠে হুমকি দিচ্ছিল।বলছিল যে, তেমনটি আওয়াজ করলে আমাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলে দিবে। তাই নির্বাক নির্বিকার অনেকটা পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে আছি  তাদের দিকে আর দেখছি তাদের গুন্ডামী কর্মকান্ড। যদিও আলো অন্ধকারের রহস্যময় পরিবেশে কিছুই ভাল করে অনুধাবন করা যাচ্ছিল না। বাড়ীর লোকজন কেউ তখনো ঘটঁনাস্থলে এসে পৌছায় নি। কেবলি চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। সব অচেনা মানুষ। অধিকাংশ তরুণ যুবক। দু একজন বয়স্ক লোকও চোখে পড়ল। তারা চ্যাংদোলার মতো করে নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা তখনো বোঝা সম্ভব ছিল না।

 

পরে যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বুঝতে পারলাম, এরা সবাই রাজাকার, আলবদর ইত্যাকার। হাতে লাঠি-কাঁধে বন্দুক ছাড়াও  তাদের কাছে ধারালো চকচকে ড্রেগারসহ দেশীয় অস্ত্রাদি সজ্জিত। দলে তারা ছিল ১৫/২০ জন। তবে সঠিক সংখ্যা অনুমান করা কঠিন। সকলেই খাকী পোশাক পরিহিত। অধিকাংশের  নাক-মুখ বাঁধা অথবা মুখোশ পড়া। প্রায় সবার হাতেই তখনকার দিনের ব্যাটারী চালিত বড়-মাঝারি টর্চ লাইট। তারা অনর্গল চারিদিকে টর্চের আলো ছুড়ে মারছে। হয়তো বৈরী প্রতিপক্ষ সম্পর্কে তারা সদা সতর্ক। শীতের রাত ছিল অন্ধকার। তাদের নিকট মাছের ডালিসহ কিছু জিনিসপত্র দৃষ্টি গোচর হল। ডালিতে  তরতাজা ইলিশ ও বাচা মাছ। এগুলো হয়তো  রাতে নদীতে চলা নৌকা আর কোন বাড়ীঘরে লুটতরাজ করে নিয়ে এসেছে। কেননা, সাধারণ মানুষের জানমাল হরণ ও সহায় সম্পদ লুটপাট করা ছিল তাদের দৈনন্দিন রুটিন কর্ম। তারা ছিল দেশের শত্রু, সমাজের নরপিশাচ এবং স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী। আজো এরা  বিচারবহির্ভূত বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে সেটা এক বিস্ময়।

 

এই রাজাকাররা ছিল স্বাধীনতার শত্রু,কুলাংগার। হেন অপকর্ম , কুকমর্ নাই যা  তারা করে নাই। এমনকি ওরা আপন আত্মীয় স্বজন ভেদাভেদ করেনি। চোখ বুঁজে নির্বিচারে সর্বক্ষেত্রে অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার করে গেছে। এরা  নিজেদের গ্রাম প্রতিবেশী আত্মীয় নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট করতেও কুণ্ঠা করেনি। অপরদিকে পাকবাহিনিকেও অনুরুপ কুকর্মে সর্বাত্মক সহায়তা করেছে তারা। তাদের বাধা দেওয়ার কিংবা প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না। যাহোক খেয়াল করলাম, বাড়ীর কতিপয় মহিলা ও তরুণ,যুবক দুর থেকে বাঁশঝারের মধ্য দিয়ে আমাকে উকি মেরে দেখলেও তাদের করার কিছু ছিল না। কারণ, রাজাকাররা তাদেরই নিজ দেশ ও গ্রাম অঞ্চলের নারীদের ইজ্জত হরণ করতেও দ্বিধা করত না। তাদের পাশবিকতা ও  নির্মমতার সামনে প্রকৃত ধর্ম আর মনুষত্ত্বের কোন বালাই ছিল না। তাই সে সময় মহিলাগণ রাজাকার দেখলেই পালিয়ে থাকতো বা লুকিয়ে চলতো তাদের নজর এড়িয়ে। সর্বত্রই রাজাকার ছিল এক আতঙ্কের নাম। মোট কথা এরা ছিল শয়তানের নামান্তর। এরা পশুরও নিচে নেমে গিয়েছিল।

 

এদিকে রাজাকারদের মধ্যে ইঙ্গিত ইশারায় একটা প্লান হয়ে গেল বলে মনে হল ,তাহল  আমাকে দ্রুতই ড্রেগার মেরে নদীতে ফেলে দেওয়া। কাজটিও কঠিন ছিল না তাদের পক্ষে। কেননা, আমাকে নিয়ে ওরা দাঁড় করিয়ে রেখেছিল একেবারে নদীর ধার ঘেঁষে বা কিনারে যেখানে খারা তীরের নীচেই নদীর প্রখর স্রোত আর গভীর পানি। তখন অনেকটা বন্যা বিদায়ের সময়। ফলে নদীতে স্রোতের টান প্রবল। তাদের ফিসফাস কথায় বুঝা গেল, আমার সদ্য গজানো কালো মোচ ও একজন সুঠাম দেহের তরুণ তাড়াশ থেকে গিয়ে ওখানে দিনের পর দিন অবস্থানের পেছনে কোন দুরভিসন্ধি আছে বলে ওদের ধারণা। হয় সে মুক্তি বাহিনীর লোক হবে, ছদ্মবেশে এখানে অবস্থান করছে।  নয়তো তাদের কোনো সোর্স  কিংবা  গুপ্তচররুপে কাজ করছে। অতএব তাকে শেষ করে দেয়াই ভালো। তাছাড়া এর পক্ষাবলম্বনের জন্য অথবা বাঁচাতে কেউ এগিয়ে এলো না এখন পর্যন্ত। ঠিক এমনি মুহুর্তে ওই বাড়ীর জয়নাল ভাই ঘটাস্থলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত। সে এসেই বলল, এ তোরা কী করছিস? আরে আকবর পিসি (প্লাটুন কমান্ডার) যে। রাজ্জাক আমাদের আত্মীয় ছেলে। সে  তাড়াশ থেকে কদিন হল এখানে বেড়াতে এসেছে। বড়ই সরল সাদামাটা আর মেধাবী ছাত্র। কোন দল বা মতে নেই। বামনকোলায়ও তার আত্মীয় আছে। আমাদের এলাকায়ই তার বাপ দাদার  বসতি। সে বামনকোলা যাবার পথে এখানে আমাদের বাড়ীতে উঠেছে দু’ একদিন থাকার জন্য।  তাকে কেন এই গভীর রাতে ঘুম থেকে টেনে তুলে এখানে নিয়ে এসেছিস। ওকে ছেড়ে দে ভাই। তোরাও আমাদের ছেলেপেলে। রাজ্জাকও আমাদের আপনজন।  এই কথাগুলো বলে জয়নাল ভাই ওদের হাত থেকে একপ্রকার জোর করে ছাড়িয়ে আমাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গেল ওদের ঘরে। এই রাজাকারগুলো ছিল শিকারপুর-মসিন্দা গ্রামাঞ্চলের। তাছাড়া এদের কতিপয় জয়নাল ভাইদের প্রতিবেশী আত্মীয় বটে। ফলে অনেকটা অধিকারের সুত্র ধরেই সে আমাকে ওদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। অবশ্য প্রথমে ওরা আমাকে ছেড়ে দিতে সম্মতি না দিয়ে আমতা আমতা করছিল। কিন্তু জয়নাল ভাই এবং ততক্ষণে তাদের পরিবারের অন্যান্যরা এসে হৈচৈ লাগালে রাজাকাররা নিরুপায় হয়ে আমাকে রেখে যায়। এর পরপরই রাজাকারদের একজন জয়নাল ভাইকে গোপনে বলেছিল যে, আপনি না এলে আর  অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাজ্জাককে মেরে নদীতে ফেলে দেবার নিশ্চিত প্লান ছিল দলের সবার। জয়নাল ভাই পরের দিন সে কথা আমাকে বলেছিল একান্তে।

 

ইতোমধ্যেই ওই বাড়ী ও পাড়ার অনেক নারী পুরুষ এসে জুটে গেল। তারা বলল, তারা অনেক আগেই ওখানে জমায়েত হলেও রাজাকারদের দুর্ব্যবহার ও দুর্ধষপনার ভয়ে কেই অকুস্থলে যেতে সাহস পায়নি। সবাই নদীর দক্ষিণ তীরের বাঁশ ঝাড়ের অপর পাশেই বাড়ীর আঙ্গিনার মধ্যে চুপেচাপে লুকিয়েছিল। তবে তাদের অনেকের চোখেই জল ও মুখে ভীতির ছাপ দেখা গেল হারিকেন ও কুপি বাতির আলোকে। উল্লেখ্য, তখনো এসব গ্রাম পল্লীতে বিদ্যুতের আলো পৌছে নি। জয়নাল ভাই ছিলেন ছোট একজন কাপড়ের ব্যবসায়ী। স্বল্প শিক্ষিত মানুষ। তবে অনেকটা সামাজিক ও মিশুক প্রকৃতির। এলাকার প্রায় সবার সাথেই তার ছিল সখ্যতা ও প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক। সেদিন তাই মহান আল্লাহ্র ইচ্ছায় ও জয়নাল ভাইদের সুবাদে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। তানাহলে আমার নির্ঘাত মৃত্যু ছিল সেদিন। তাই ভাবি, রাখে আল্লাহ, মারে কে ?

 

বিশেষ উল্লেখ্য, তাড়াশের আশানবাড়ীতে  মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে থাকা খুব স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ ছিল না হেতু আমি এক পর্যায়ে বামনকোলা চাচাতো ভাইদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে নৌকা যোগে ধামাইচ আসি। সেখানে ময়েজ উদ্দিন মৌলভীর ছেলেদের রাজাকার হওয়া ও স্থানীয় অন্যান্য রাজাকারদের দাপট দৌরত্ম্যের বিষয় জানতে পেরে আমি ধামাইচ আত্মীয় বাড়ী থাকাও সমিচীন মনে না করে বামনকোলা যাবার পূর্বে আপাতত দু-একদিন  মসিন্দায় জয়নাল ভাইদের বাড়ীতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তবু সেখানেও মৃত্যুর কবল থেকে রহস্যজনকভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তারপরও দুর্ভাগ্য ও বিরম্বনা পিছু ছাড়েনি। কেননা স্বাধীনতা যুদ্ধের ওই দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে কোন মানুষেরই নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে সমাজে বসবাসের এবং চলাফেরার অনুকুল পরিবেশ পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল না। সর্বত্রই নৈরাজ্য এবং নারকীয় পরিবেশ কায়েম করেছিল পাকিস্তানী বাহিনির দোসর-দালাল এই রাজাকার শান্তি কমিটির লোকেরা।

 

তখনকার দিনে ধামাইচ হাট ছিল ছোট বাজারের মত। সকাল বিকালের বাজার আর হাটের মধ্যে ছিল না  তেমন পার্থক্য। আমি ছোটবেলা থেকেই এ হাটের সাথে পরিচিত। এখানে কাটাবাড়ী-বিন্নাবাড়ী খাল নদীতে মেশায় ত্রিমোহনা টাইপের খেয়াঘাট চলছে শত বছর যাবত। এলাকার জনতার কত আবেদন নিবেদন আর লেখালেখি হলো তথাপি এখানে আজো কোন ব্রিজ নির্মাণ হল না। চলনবিলের হাজার হাজার মানুষ আজো প্রতিদিন এই খেয়াপথ পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করে। আমি শৈশব থেকেই পিতার সাথে ও পরবর্তীতে একাকী বা লোকজনের সাথে বর্ষায় নৌকায় আর শুস্ক মওসুমে হেঁটে এই খেয়াঘাট পাড় হয়ে চাঁচকেড়, গুরুদাসপুর , বামনকোলা প্রভৃতি এলাকায় কাজে কিংবা বেড়াতে গিয়েছি বহু দিন। গ্রীস্মকালে এখানে এসে যদি একবার খেয়া নৌকা মিস করেছি তো প্রায় ঘন্টাখানেক বসে থাকতে হয়েছে নদী পাড়ে। যাকে কবি বর্ণনা করেছেন –  এক নদী বাইশ ক্রোশ রুপে। সেব কথায় আর না যাই। আমার সেই মৃত্যুর কুপ থেকে ফিরে আসার পর দিন থেকেই জয়নাল ভাইয়ের বউ মানে আমার ভাবি আমাকে দ্রুতই মসিন্দা থেকে অন্যত্র সড়ে  পড়া অথবা বামনকোলা চলে যাবার জন্য পরামর্শ দিলেন।

 

আমিও তার কথার গুরুত্ব বুঝলাম। কিন্তু একটা সামান্য তারুণ্যসুলভ মোহে পড়ে গেলাম ভিন্ন মেলামেশার সূত্রে। জয়নাল ভাইদের বাড়ীর পূর্বের পাশের্^ নদীর ধারেই তৎকালীন মসিন্দা ইউপি সচিব আব্দুল হাকিম সাহেবের বাসা। প্রতিবেশীরা তাকে কেরানী সাহেব বলতেন। তার কনিষ্ঠ মেয়ে বেবী। আর স্ত্রী শিক্ষিতা, নাটোরের মেয়ে। তার কলেজ পড়ুয়া  ছোট ছেলে মঞ্জু আমাকে বন্ধুর ন্যায় প্রীতির আবেশে জড়িয়ে ফেলল। তারা আমার কবিত্ব, সাহিত্য ভাবভঙ্গিতে  কিছুটা হল আকৃষ্ট। জয়নাল ভাইদের বাড়ীতে খেয়ে বেবীদের বাড়ীতে শুরু হল দিনভর আড্ডা। কখনো আবার দুপুরে তাদের বাসায় খাওয়া হতো। এলাকায় মঞ্জু ভাইরা ছিল সর্বোপরি শিক্ষিত পরিবার। ফলে  আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন দূর গ্রামে তাদের সুরুচিশীল ব্যবহার মাধুর্যে  এবং  ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আমি কিছুটা মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লাম। ভুলে গেলাম সদ্য ঘটে যাওয়া আমার জীবনের দুর্ঘটনার কথা। বিষয়টি লক্ষ্য করে একদিন সন্ধ্যায় জয়নাল ভাইয়ের স্ত্রী আমাকে বেশটা শাসালেন এই বলে যে, আমার মনে হয় তোমার কপালে আবার দুর্ভোগ আছে। তুমি বোধ হয় বেবীদের পরিবারে আড্ডায় মেতে গেছো। তবে সময় যে ভাল না তা ভুলে আছো। এভাবে থাকলে যে কোন মুহুর্তে তুমি আবার বিপদে-মুসিবতে পড়বে। কথাগুলো সতর্কবাণী হিসেবে  শোনালেও তার মধ্যে  আমার জন্য সহানুভূতি ও মমতার সুর মিশ্রিত ছিল। আমিও ভাবলাম আর এখানে থাকা নয়। দু-একদিনের মধ্যেই আমি বামনকোলা চাচাতো ভাইদের বাড়ী চলে যাবো।  মোটামুটি মনস্থ চূড়ান্ত করেই ফেললাম।

 

ঠিক পরদিন কী একটা উদ্দেশ্যে ধামাইচ বাজারে গেছি দুপুরের দিকে। এখানে নদীর পশ্চিম তীরে আমাদের পিতৃকুলের আত্মীয় দেছের উদ্দিন প্রামাণিক। তাকে আমরা চাচা বলতাম।  তার ছেলেরা প্রায়শই বাজারে আসে। ভাবলাম ওদের পেলে সাক্ষাৎ করে যাই। যেহেতু আনেক দিন যাবৎ দেখা হয়নি। সেজন্য বাজারের মধ্যে ঘুরে খুঁজে ফিরছি।  তাদের দেখা পেলে কথা বলে ফিরে যাবো জয়নালদের বাড়ীতে। সেখান থেকে হয়  আজ বিকেলে, নয়তো  আগামীকাল সকালে বামনকোলা রওয়ানা হব। এমনি মুহুর্তে আমার পেছন থেকেমনে হয় দু’জন ডেকে বলল, ভাই আপনাকে চাষ্টলে ডাকছেন চা খাওয়ার জন্য আসুন, এদিকে।  তাদের কথা মত পাশের চাষ্টলে গেলাম। কয়েকজন যুবক ধরনের পোলাপান প্রথমে আমাকে চা খাওয়ার আমন্ত্রন জানালো। বললাম, চা খাই না। তারা মিষ্টি খাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে কাউকে মিষ্টি আনতে পাঠালো পাশর্^বর্তী দোকানে। যথারীতি মিষ্টি আনা হল আর তা খেলামও। পানি খেতেই তারা আমাকে জিজ্ঞাসা শুরু করল। আপনার বাড়ি মনে হয় তাড়াশ। তাহলে  এ সময়ে এখানে আসার উদ্দেশ্য কী? কী করেন? এখান থেকে যাবেন কোথায়? ইত্যাকার নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তুলল। ইতোমধ্যে ঘটনা দৃষ্টে সেখানো লোকজন জুটে গেল। আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম এ কথা স্মরণ করে যে, জয়নালের ভাইয়ের সহধমির্নী আমাকে গতকালই সাবধান করে দিয়েছিলেন আসন্ন বিপদ সম্পর্কে। সে মছিবতই আজ উদয় হল কি  না। মনে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। ওরা আমাকে নিকটস্থ রাজাকার ক্যাম্পে নেওয়ার জন্য বলাবলি করছে। কেউ বা আবার আমার হাত ধরে ওদিকে নেয়ার জন্য টানাটানি আরম্ভ করল। প্রমাদ গুনলাম মনে মনে।

ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছি নিজের ভেতরে ভেতরে। কেননা একদিন পূর্বেই তো রাজাকারদের হাতে ধরা খেয়ে মুত্যুর গহ্বর থেকে  অল্পের জন্য ফিরে এসেছি।  ইতোমধ্যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। আমি শুধু বললাম,  ভাই আমাকে নিয়ে এমন করছেন কেন? এখানেও তো আমাদের আত্মীয় আছে। জেনে দেখুন তাদের কাছে। নদীর উত্তর পাড়ে দেছের প্রমাণিকের ছেলে মোছলেম, সে আমার চাচাতো ভাই, তার ছেলে ছালাম হল ভাতিজা। মহান আল্লাহ্র কী রহস্য। মোছলেম ভাই ধামাইচ বাজার করে ওই মুহুর্তে খেয়া নৌকায় বাড়ী ফিরছিল তখন। ভীরের মধ্য থেকে কে যেন জোরে ডাক মারলো তাকে, বোধ হয় আমার কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। বাজারের ব্যাগ হাতে জনসমাগম স্থলে এসেই আমাকে দেখে “ আরে, রাজ্জাক এখানে .. বলতে বলতে এসে আমার গা ছুয়ে ওদের লক্ষ্য করে বলল, একে নিয়ে তোদের কী ব্যাপার বলতো? ওরা আমাকে অচেনা অজ্ঞাত তরুণ মুক্তিবাহিনির লোক ভেবে সন্দেহ করছিল, সে কথা জানালো। জবাবে মোছলেম ভাই বলল, সে আমাদের খুবই আপনজন। বাড়ী তাড়াশ। এর আগেও বহুবার ধামাইচে  এসেছে। ওকে নিয়ে গোল পাকাবার দরকার নেই। সে আমার সাথে আমাদের বাড়ি যাবে। তোরা চলে যা। আমি ওকে নিয়ে গেলাম। আর তার ইঙ্গিতে তার পেছনে পেছনে আমি সেদিনের মত মোছলেম ভাইদের বাড়ী গিয়ে রাত্রি যাপন করে পরদিন শিকারপুর জয়নাল ভাইদের বাড়ীতে পৌছুলে তার বউ অর্থাৎ ভাবীজান আমাকে গতকাল বাসায় না ফেরার কারণ জানতে চাইলো। সব শুনে মন্তব্য করল, আমি এর পূর্বভাস তোমাকে আগেই দিয়েছিলাম। জবাবে আমি ভগ্ন স্বরে বললাম , দুঃখিত , ভাগ্যের লিখন..।  যাহোক,পরে একই দিন বিকেলেই আমি  জয়নাল ভাইদের বাড়ির সবাইকে বলে ব্যাগ-লাগেজ সহ পায়ে হেঁটে পুরাতন বামনকোলার পথে রওয়ানা দিলাম। (আগামীতে ৯ম পর্ব পড়ুন)

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD