হাজার বছরের ঐতিহ্য চলনবিলাঞ্চলের নবান্ন উৎসব

Spread the love

সুজন কুমার মাল

বাংলাদেশ তথা চলনবিলাঞ্চলে নবান্ন উৎসব ঐতিহ্যবাহী একটি শস্যোৎসব। বাংলার কৃষক ও কৃষি প্রধান পরিবারগুলো শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করে নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম।

নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন ধানের  চালের  রান্না করা অন্ন বা ভাত। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমণ ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুতকৃত চালের প্রথম  রান্না উপলক্ষ্যে আয়োজিত ভোজন উৎসব। অগ্রহায়ণ মাস এলেই সর্বত্র বেজে ওঠে নতুন ধ্বনি। যেহেতু নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব ,তাই  প্রতি বছরই ঘুরেফিরে আসে নবান্ন উৎসব। হেমন্ত ঋতুতে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। পুরোনো এই উৎসবটি যুগ যুগ ধরে একইভাবে পালন হয়ে আসছে। নবান্ন উৎসবে গ্রামগঞ্জে আয়োজন করা হয় গ্রামীণ মেলার।

ষড়ঋতুর এই দেশ। ভিন্ন উৎসবের ভিন্ন আয়োজন বৈচিত্রময়। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে মেতে ওঠে এ জনপদের মানুষজন। আর এই উৎসব-পার্বণগুলো আমাদের সমাজ, সংস্কৃতির ধারক বাহকও বটে। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা মানুষের জীবনকে করে তোলে ক্লান্ত, বৈচিত্রহীন। আর মানুষজন নবান্ন সহ নানা অনুষ্ঠানে সংকীনণ গন্ডি হতে পরিত্রাণের লক্ষ্যে বৃহৎ পরিসরে মেতে ওঠে সকলের সাথে আনন্দ সহভাগিতা করতে।

এসব মেলায় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নামে। আনন্দ দেখা যায় ছোট বড় সব বয়সের মানুষের মধ্যে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ এই উৎসব ভিন্নভাবে পালন করে। মেলার এককোণে রাতভর চলে লোক গানের উৎসব। এই উৎসবে উপস্থিত থাকেন নবীন প্রবীণ সবাই। হরেক রকমের বাহারি সব খাবারের দোকানের পসরা দিয়ে বসানো হয় গ্রামীণ মেলাতে। তবে গ্রামীণ মেলা এখন আর শুধু গ্রামেই হয় না, শহরের মানুষও এখন নবান্নের স্বাদ নিয়ে থাকে।

সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমণ ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উদযাপনের প্রথা রয়েছে বলে জানা গেছে। নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন চালের নৈবেদ্য (ফলমূল,দুধ, কলা, চিনি, বাতাসা প্রভৃতি দিয়ে তৈরী করা বিশেষ খাবার ) সেই অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয় স্বজনদেরকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারের সদস্যদের নতুন গুড় সহ নানা পদের খাবার তৈরী করার মধ্য দিয়ে নতুন অন্ন গ্রহণ করেন।

নতুন চালের তৈরি খাদ্য কাককে নিবেদন করা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের নবান্নের অঙ্গ, একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা।

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে “কাকবলী” বলা হয়। অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিনেও গৃহ দেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল বলে জানা যায়। নবান্ন উৎসব হিন্দুদের একটি প্রাচীন প্রথা। হিন্দুশাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে । হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষেরা  নতুন অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। এই কারণে হিন্দুরা পার্বণ বিধি অনুযায়ী নবান্নের দিনে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানও করে থাকেন।  আরো লোকবিশ্বাস রয়েছে, নবান্ন উৎসবের দিনে শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। অতীতে অত্যন্ত  সাড়ম্বরে  নবান্ন উৎসব উদযাপন হত; সকল মানুষের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে নবান্ন উৎসবের প্রচলন ছিল।

কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই নবান্ন উৎসব এখন বিলুপ্ত প্রায়। তবে এখনও বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে পালন করা হয়ে থাকে। এক সময়ে হিন্দু পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্য সদস্য উপবাস থেকে জমি থেকে আমণ ধানের আঁটি বা বোঝা  কেটে নিয়ে আসতো । আর সেই আঁিট বা বোঝা থেকে ঢেঁকিতে চাল ছাটা হতো। কিন্তু কালের বির্বতনে ঢেঁকির বদলে এখন যন্ত্রশিল্পের সুচনা হওয়ার ফলে মিলেই নতুন ধান ভাঙ্গানোর কাজটি করা হয়। আরো জানা যায় , নব্বই দশক থেকে  ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদযাপন শুরু হয়েছে। জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ প্রতি বছরই পহেলা অগ্রহায়ণ মাসের  প্রথম তারিখে নবান্ন উৎসব উদযাপন করে।

ঋতু বৈচিত্রময় হেমন্ত আসে শীতের আগেই। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু। অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন নিয়ে আসে খুশির বার্তা। নতুন ধান ঘরে উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকে নারী -পুরুষেরা। আর নতুন  ধান ঘরে উঠলে  বাঙ্গালী পরিবারগুলোতে পিঠা, পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। নবান্ন অনুষ্ঠানে হালকা আবেশ আসে বা থাকে । সেহেতু শীতের নানা রকমের পিঠাপুলির আয়োজন থাকে নবান্ন উৎসবে। আমাদের দেশে নবান্ন উৎসবে অঞ্চলভেদে চলে জারি, সারি, মুর্শিদি, লালন, পালা ও বিচার গান। আর মেলায় পাওয়া যায় নানা স্বাদের খাবার। ছোটদের বাড়তি আনন্দ দিতে মেলায় আসে নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস, বায়োস্কোপ। তখন হয়তো মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দূর অতীতের কথা যেখানে মা বাবা ভাই বোন আত্মীয়স্বজন সবাই একসাথে মিলে নবান্নের উৎসব উপভোগ করত। আর তাই গ্রাম বাংলায় নতুন ধানের খাবার অর্থাৎ নবান্ন এক আবহের সৃষ্টি হয়। নবান্ন উৎসবের সাথে মিশে আছে বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সং¯ৃ‹তির নানা দিক।

প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালি জাতি ধর্ম বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। আর নবান্ন সহ নানা উৎসব মানুষের প্রীতি বন্ধন দৃঢ় করে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় এক সামাজিক মেল বন্ধন। প্রতিটি উৎসবই মানুষের মধ্যে চেতনার বিকাশ ঘটায়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের হতাশা, ক্লান্তি , দুঃখ , দুর্দশা ঘুচাতে এই সকল সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

 

লেখক: তরুণ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD