তরুণ প্রজন্ম রক্ষায়  তামাক কোম্পানীর প্রভাব বন্ধ করা জরুরী

Spread the love

শুভ কর্মকার

সাম্প্রতিক গণমাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিতে কোম্পানির প্রভাব সংক্রান্ত বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হওয়ায় সচেতন মহল উৎকন্ঠিত। দীর্ঘদিন ধরেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, করনীতি, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিতে তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে হস্তক্ষেপ করছে। তামাক নীতিতে তামাক কোম্পানিগুলোর এ ধরনের প্রভাব সরকারের ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যকে ব্যাহত করার সুপষ্ট অপচেষ্টা বলে প্রতীয়মান হয়। এমতাবস্থায় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিতে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রভাব বন্ধে প্রথমেই  আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসি-র আর্টিকেল ৫.৩ অনুসারে সরকারকে দ্রুত গাইডলাইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে নীতি ও কার্যক্রমে তামাক কোম্পানিগুলোর অনৈতিক হস্তক্ষেপের কতিপয় ঘটনা তুলে ধরা হল:

১) তামাক কোম্পানি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ এবং সংসদ বিভাগের সিনিয়র সচিবকে প্রভাবিত করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের স্বাস্থ্য সতর্কবানী প্রদানের বিধানকে দূর্বল ও বিলম্বিত করা (জাগো নিউজ, ২১ অক্টোবর ২০১৯);

২) ১৩ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক একটি প্রজ্ঞাপন জারী করে বিড়ির সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ কমিয়ে ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করা;

৩) তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ভঙ্গ করে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিএটি-র ব্যাটেল অব মাইন্ড নামক প্রতিযোগিতা আয়োজনসহ আইন বিরোধী নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে যুব-সমাজকে তামাকে আকৃষ্ট করার অপচেষ্টা;

৪) সরকারকে প্রভাবিত করে একটি বিশেষ তামাক কোম্পানী কর্তৃক বিগত অর্থ বছরে ২০০০ কোটি টাকার ট্যাক্স মওকুফ সুবিধা আদায়;

৫) খসড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিকে পাশ না করার জন্য বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফেকচার এসোসিয়েশন কর্তৃক শিল্প, কৃষি, অর্থ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পত্র প্রদান উল্লেখযোগ্য।

এগুলো বিগত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনা মাত্র। এছাড়া আরও দৃশ্যমান ও অদৃশ্য অপকৌশল গ্রহণ করে দেশী এবং বিদেশী কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত সরকারের নীতিকে প্রভাবিত করছে যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।

তামাক কোম্পানিগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য হল, তাদের ব্যবসার প্রসার। এ ব্যবসা প্রসারের লক্ষ্যে তরুণদের তামাক ব্যবহারে আকৃষ্ট করতে কোম্পানিগুলো নানা বিজ্ঞাপন, প্রচারণা, কর ফাঁকি, কর কম দেয়া, কম দামে তামাক সরবরাহসহ নানা কার্যক্রমের প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান, সিএসআর কার্যক্রমের নামে প্রভাবিত করার চেষ্টা, আইন ও নীতিকে দূর্বল করা, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রভাবিত করার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং তামাক বিরোধী শক্তিশালী নীতি গ্রহণ ও তার কার্যকর বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে কোম্পানির লাভ ও তামাক  ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দেশ , সমাজ ,অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

সরকারের উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহার কমানো, আর তামাক কোম্পানির উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহার বাড়ানো। এই পরস্পর বিপরীত অবস্থানের কারণে সরকারের উচিত তামাক কোম্পানির সাথে কার্যক্রমগুলো সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান কাঠামোতে তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগসমূহকে তামাক কোম্পানিগুলো কর্তৃক প্রভাবিত করার সুযোগ রয়েছে। বিএটি নামক তামাক কোম্পানীতে বাংলাদেশ সরকারের শেয়ার রয়েছে মাত্র ১২.৮৬ শতাংশ। অথচ এই সামান্য শেয়ারের জন্য বিএটি পরিচালনা পর্ষদে মোট ৯ জন পরিচালকের মধ্যে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন ৬জন। বোর্ডে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকায় বিএটি নানাভাবে সরকারের নীতিতে প্রভাবিত করে আসছে। এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের তামাকের দাম নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়গুলোতে তামাক কোম্পানিগুলোর অনির্ধারিত আলোচনার সুযোগ থাকায় কোম্পানিগুলো নানাভাবে সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাস্থ্য হানিকর ভেষজ নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তামাক চাষ কমানো, নতুন তামাক কোম্পানি স্থাপনের লাইসেন্স না প্রদানসহ তামাক নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা রয়েছে। সরকার আগামী ২০৪০ সালে মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এমতাবস্থায় তামাক কোম্পানীতে সরকারের শেয়ার, তামাক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে সরকারি কর্মকর্তাদের রাখা, কৃষি মন্ত্রণালয়ে তামাক পাতার দাম নির্ধারণে কমিটি রাখা বা তামাক কোম্পানিগুলোকে কর সুবিধা প্রদান সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ এবং সরকারের নীতি ও কার্যক্রমের সাথে সরাসরি  স্ববিরোধী তথা সাংঘর্ষিক। তাই এসব বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। পাশাপাশি সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত তামাক চাষ, তামাক কোম্পানির আয় হতে নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে রোডম্যাপ গ্রহণ করা। কোনভাবে তামাক কোম্পানিগুলোর পক্ষ অবলম্বন, তাদের সুবিধা দেয়া, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতির বিরোধিতা করা সমিচীন নয়।

তামাক কোম্পানির বোর্ডে থাকার কারণে বা কোম্পানিতে সরকারী কর্মকর্তাদের স্বজনের চাকুরির সুবাদে তামাক কোম্পানিগুলোর নীতিতে প্রভাবিত করার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তামাক কোম্পানি হতে শেয়ার প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত কোম্পানির কর্মকর্তাদের দায়িত্ব, কাজের পরিধি এবং কার্যক্রমের সুপষ্ট তথ্য সরকারের কাছে জমা দেয়া জরুরি। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই তরুণ, যাদের বয়স ১০-২৪ বছরের মধ্যে। তামাক কোম্পানীগুলো এমন ভোক্তা খোঁজে যারা দীর্ঘদিন তামাক ব্যবহার করবে। সেদিক থেকে তামাক কোম্পানীগুলোর জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তামাক কোম্পানীগুলোর টার্গেট এই তরুণরা। দেশের তরুণদের তামাক সেবনে আসক্ত করে তোলার জন্য নানা কৌশলে কোম্পানীগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্থ করছে এবং তামাক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতিসমুহ প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে। সরকারের উচিত কঠোরভাবে তামাক কোম্পানির এ সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে দেশের তরুণ সমাজকে রক্ষা করা।

টেকসইউন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশের বড় বাধা তামাক। এই লক্ষমাত্রা অর্জনে তামাকের মতো স্বাস্থ্যহানিকর পণ্য নিয়ন্ত্রণ জরুরী। তামাকের কারণে প্রতিদিন বহুলোক অকালে প্রাণ হারাচ্ছে, পঙ্গুত্ব বরণ করছে। তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে পৃথিবীতে ৮০ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার জন। স্বাস্থ্যের পাশপাশি পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও তামাক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। তামাকের ভয়াবহতা তথা সার্বিক দিক বিবেচনায় আন্তর্জাতিকভাবে সারাবিশ্বে তামাক নিয়ন্ত্রণে গ্রহণ করা হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। বাংলাদেশেও জনস্বাস্থ্যের ওপর তামাকের এই ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে টাস্কফোর্স কমিটি গঠনসহ আরো অনেক দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সরকার জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন ও তামাক-কর কাঠামো শক্তিশালি করতে কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে কাংখিত লক্ষ্য অর্জনের রোডম্যাপ প্রস্তত করছে সরকার। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় তামাক কোম্পানীগুলো দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি ও আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করে চলেছে।

তরুণ জনগোষ্ঠী কেন তামাক কোম্পানীর অন্যতম টার্গেট

তামাক কোম্পানীগুলো এমন ভোক্তা খোঁজে যারা দীর্ঘদিন তামাক ব্যবহার করবে। সেদিক থেকে তামাক কোম্পানীগুলোর জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৪৯% মানুষের বয়স ২৮ বছর বা তার নিচে (প্রথম আলো, ২৫ এপ্রিল ২০১৬)। তামাক কোম্পানীগুলোর টার্গেট এই তরুণরা। দেশের তরুণদের তামাক সেবনে আসক্ত করে তোলার জন্য নানা কৌশলে কোম্পানীগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্থ করছে এবং তামাক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতিসমুহ প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে।

দীর্ঘদিন ধরেই তামাক কোম্পানীগুলো নানা কৌশল অবলম্বন করলেও সম্প্রতি বাংলাদেশে তামাকের উপর কর বৃদ্ধি,তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি এবং আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ নানা বিষয়ে তামাক কোম্পানীগুলোর প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোম্পানীগুলোর এধরনের কার্যক্রম দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণকে অগ্রসর হতে দিচ্ছে না । যা সার্বিক জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের ইপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

কর সুবিধা আদায়

প্রকৃত মূল্য এবং কর বৃদ্ধি তামাক নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর একটি পন্থা।পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো বাংলাদেশে তামাকের দাম কম। চলতি অর্থ বছরে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে বিড়ির উপর ৩৫ শতাংশ সম্পুরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। যদিও তামাক নিয়ন্ত্রণের স্বপক্ষের আন্দোলনকারীরা বাজেটে প্রতিক্রিয়ায় জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও রাজস্ব আয় বাড়াতে বিড়ির ওপর সম্পূরক শুল্ক আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু কর বৃদ্ধির বদলে বিড়ির সম্পুরক কর ৫ শতাংশ কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়। গত ১৩ অক্টোবর ২০১৯ (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) এনবিআর এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারী করে। এ প্রজ্ঞাপন অনুসারে আগামী ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত ২৫ শলাকার ১৪ টাকা মূল্যের প্যাকেটসহ সবধরনের বিড়ি এই সুবিধা পাবে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তামাকখাত থেকে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৯শ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে বলে তথ্য দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিড়ির ওপর বর্ধিত ৫% এসডি প্রত্যাহার করায় রাজস্ব আয় আরও কমে আসবে। এতে একদিকে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি অন্যদিকে বিড়ি কোম্পানীগুলোর লাভ বাড়বে। ফলে জনস্বাস্থ্য মারাতœকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বিড়ির ভোক্তা গ্রামীণ দরিদ্র ও শ্রমজীবি মানুষ হওয়ায় দরিদ্র মানুষগুলোর স্বাস্থ্য আরও হুমকির মুখে পড়বে।

উল্লেখ্য, এনবিআর এর তথ্যানুসারে চলতি অর্থ বছরে সঠিক তামাক করনীতির অভাবে সিগারেট হতেও রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কোনো বিবেচনাতেই বিড়ির ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট এর পক্ষ থেকে অবিলম্বে বিড়ির ওপর কর কমানো ও সম্পূরক শুল্ক হ্রাসের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। সেইসাথে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করতে সকল তামাকজাত দ্রব্যের উপর সুনির্দিষ্ট কর আরোপের পাশাপাশি জাতীয় তামাক করনীতি প্রণয়নের ও জোর দাবি  উঠেছে।

মিথ্যা ও বিভ্রান্তকর তথ্য দিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়া বানচাল করার অপতৎপরতা

সরকার জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি’ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই উদ্যোগকে ব্যাহত করতে বরাবরের মত মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও খ-িত তথ্য উপস্থাপন করে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়া বানচাল করতে ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা শুরু করেছে তামাক কোম্পানীগুলো। তামাক কোম্পানীদের একটি সংগঠন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরিত চিঠিতে তামাক খাত থেকে বছরে ২৮,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের কথা বার বার তুলে ধরেছে। এখানে রাজস্ব আয়ের বিষয়ে তারা মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেছে এবং তামাক ব্যবহারজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। গবেষণার তথ্যানুসারে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। একই সময়ে শুধুমাত্র তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানোর ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

অপরদিকে বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক সিগারেটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ই-সিগারেট মরাত্মক স্বাস্থ্যহানিকর তা আন্তর্জাতিক নানা গবেষণায় প্রমাণিত। ই-সিগারেটের ক্ষতির দিক বিবেচনা করে ভারত ইতোমধ্যে এই পণ্যটিকে নিষিদ্ধ করেছে। আমেরিকাসহ অনেক দেশ এটিকে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। অথচ পত্রে তামাক কোম্পানী এটিকে নিরীহ পণ্য হিসাবে উপস্থাপন করে বৈধ ব্যবসার সুযোগ দাবী করেছে। এটিকে এখনই নিষিদ্ধ করা না হলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

তামাক কোম্পানীগুলো বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, টেলিফোনে ধূমপানে উৎসাহিতকরণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে “ব্যাটল অব মাইন্ড” নামক কর্মসূচীর আড়ালে তামাকের প্রচারণা, পৃষ্ঠপোষকতামূলক কার্যক্রম পরিচালনাসহ নানান কৌশলে প্রত্যহ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লংঘন এবং নানা বিষয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করে তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের শুভ উদ্যোগসমূহকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে চাইছে। যা রাষ্ট্রের আইনের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের সামিল। তাদের এই অপচেষ্টাগুলোকে এখনই প্রতিরোধ করতে না পারলে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের পদক্ষেপসমূহ ও এর বাস্তবায়ন মারাত্বকভাবে ব্যাহত হবে।

ক্রমবর্ধমান তামাক চাষের কারণে খাদ্য উৎপাদনযোগ্য জমি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। চুল্লিতে তামাকপাতা প্রক্রিয়াজাত করার কারণে ধ্বংস হচ্ছে বন। বাড়ছে জলবায়ূ পরিবর্তনের ঝুঁকি। তথাপি তামাক কোম্পানীগুলো কৃষকদের নানাভাবে তামাক চাষে প্রলুব্ধ ও প্রতারিত করছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে কক্সবাজারের চকরিয়ায় ১৫শ তামাক চাষী একটি তামাক কোম্পানীর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কোম্পানীর পক্ষ থেকে চাষ শুরুর পূর্বে চাষীদের তামাক চাষে উৎসাহিত করা হয়। চাষীরা টাকা আগাম নিয়ে বীজতলা তৈরী, চারা উৎপাদন, তন্দুল নির্মাণ কাজ শেষ করার পর শেষ মুহূর্তে এসে কোম্পানী তামাক ক্রয় করবেনা মর্মে চাষীদের জানিয়ে দেয়।  (জনকন্ঠ, ২৪ অক্টোবর ২০১৯)।

তামাক কোম্পানীগুলো নানা কৌশলে দীর্ঘদিন ধরে সুকৌশলে প্রভাব বিস্তার করছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমেও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। তামাক কোম্পানীর অপকৌশলের ফলেই সংশোধিত আইন’ অনুযায়ী তামাকজাত পণ্যের সচিত্র সতর্কবার্তা প্যাকেটের উপরিভাগের ৫০ শতাংশে রাখার বিধান থাকলেও সেটা বদলে তামাক কোম্পানির দাবি অনুযায়ী নিচের অংশে ওই সতর্কবার্তা ছাপানোর সুযোগ দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। একটি তামাক কোম্পানি তাদের পক্ষে ও বিলম্বে বিধিবিধান করানোর জন্য নীতি নির্ধারর্নী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সন্তানদের চাকরী এবং তামাক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতি বিলম্বিত করেছে সেই তথ্যও গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে গণমাধ্যমে।

তামাক কোম্পানীতে বাংলাদেশ সরকারের শেয়ার রয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। অথচ এই ১১ শতাংশ শেয়ারের জন্য বিএটি পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে এর মোট ৯ জন পরিচালকের মধ্যে সরকারের রয়েছেন ৬জন। যা তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে। সেই সাথে তামাক কোম্পাণী আয়োজিত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কার্যক্রমে (সিএসআর) নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ, বাংলাদেশে তামাক কোম্পানীগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণে সুযোগ তৈরী, তামাক কোম্পানীগুলোকে সবোর্চ্চ করদাতাসহ বিভিন্ন ইভেন্টে পুরুস্কার প্রদানসহ সরকারের দ্বিমুখী আচরণ তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি প্রশ্ন বিদ্ধ করছে।

প্রকৃতপক্ষে তামাকে বিনিয়োগ এবং তামাক ব্যবসা সম্প্রসারণ রাষ্ট্রের কোন কল্যাণ বয়ে আনছে না। তামাক কোম্পানীর কাছে জনস্বার্থ ও নীতি-নৈতিকতার চেয়ে মুনাফা অগ্রগণ্য। কিন্তু সরকারের কাছে অগ্রগণ্য ‘জনস্বার্থ’। এফসিটি আর্টিক্যাল ৫.৩ তামাক কোম্পানীর হস্তক্ষেপ থেকে সহায়ক নীতিগুলো সুরক্ষার রক্ষা কবজ। তামাক নিয়ন্ত্রণকে এগিয়ে নিতে সহায়ক বিধায় এসডিজিতেও এফসিটিসি বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় সার্বিক দিক বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করতে মুনাফালোভী তামাক কোম্পানীর অপচেষ্টা প্রতিহত করে তামাক নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ গহণ করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট।

 

লেখক : উন্নয়ন কর্মী ।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD