আবুল কালাম আজাদ
চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র গুরুদাসপুর উপজেলা। নাটোরের এই উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে মোট জনসংখ্যা ২ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭ হাজর ৫২০ জন এবং নারী ১ লাখ ৭ হাজার ২৬৮ জন। মোট আয়তন ৭৮ বর্গ কিলোমিটার (৫০ হাজার ২১৪ একর), মোট খানার সংখ্যা ৫৮ হাজার ৩৭৯টি। ভুমি অফিসের তথ্যমতে উপজেলায় নদ-নদীর সংখ্যা ৮টি (আর এস ন´া হিসেবে)। নদী ৮টি হচ্ছে-গুমানী নদী দৈর্ঘ্য ১৪.৫০ কি.মি. নন্দকুজা নদী দৈর্ঘ্য-১৬.৫ কি.মি. আত্রাই নদী দৈর্ঘ্য ১৫ কি.মি. বেসানী নদী ৩ কি.মি. তুলসীগঙ্গা নদী ৫কি.মি. গুড় নদী ৩ কি.মি. খুবজিপুর নদী ৩ কি.মি. এবং মির্জামামুদ নদী ৪ কি. মিটার দৈর্ঘ্য। পুকুর সংখ্যা উপজেলা মৎস্য অফিসের হিসেবে ৬৩৬২টি, যার আয়তন ১ হাজার ৮০০ হেক্টর গত বছরে ছিল ৫৪৩৫টি , বেসরকারী হিসেবে বর্তমানে পুকুর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশী।
উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৬টি নদীর মেেধ্য নন্দকুজা, আত্রাই, গুমানী ও বেসানী নদী প্রভাবশালী নদী খেকোদের দখল-দূষণের নির্মম ঝুঁকির ধাক্কা সহ্য করেও অর্ধমৃত হয়ে কোন রকম চলমান আছে। কিন্ত অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, চাপিলা ও নাজিরপুর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এককালের প্রমত্তা তুলসীগঙ্গা ও মির্জামামুদ নদী প্রভাবশালী নদী খেকোদের দখল নির্যাতনের নির্মম মরণ কামড় সহ্য করতে না পেরে একেবারেই মরে গেছে বললে ভুল হবে; তবে দখলদারেরা নদীর হাড্ডি হুড্ডি সবই ইতোমধ্যে সাবার করে ফেলেছে। শুধু নদী খেকোদের দোষ দিলে আবারো ভুল হবে, এর সাথে জড়িত ভুমি অফিসের অসাধু করিৎকর্মা অফিসারদের কারিশমা। টাকার বিনিময়ে রাতারাতি ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে বনে গেছে বৈধ মালিক আর অফিসাররা হয়েছেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। এই দুইটি নদীর উপর গড়ে উঠেছে পুকুর,মসজিদ,মাদ্রাসা, বসতবাড়ি , পাকা ইমারত , রাস্তা,ইত্যাদি। সিএস রেকর্ড ন´ায় নদী থাকলেও আরএস রেকর্ড ন´ায় অদৃশ্য শক্তির ছোঁয়ায় প্রবাহমান নদীর অস্তিত্ত্বই হারিয়ে ফেলেছে। কথায় আছে ‘ নদী মরে গেলেও তার ধারা থাকে’।
এখন সেই ধারাই জানান দিচ্ছে ‘এখানে এক নদী ছিল জানলো নাতো কেউ’।এই তুলসীগঙ্গা ও মির্জামামুদ নদী দিয়ে চন্দ্রপুর, মহারাজপুর,লক্ষিপুর, গোপীনাথপুর, বৃকাশো, খামারপাথুরিয়া, ওপাড়া, বৃগড়িলা, বৃপাথুরিয়া এবং চাকলের বিলের পানি নিষ্কাশন হতো। মুরব্বিদের কাছে শোনা যায় এই দুই নদী দিয়ে এক সময় বড় নৌকা , বজরা এবং লঞ্চ চলাচল করতো। এখন সেই নদীর বুকে ইমারত, বসতবাড়ি, পুকুর হয়েছে কৃষি আবাদ হচ্ছে, করা, শাক-সব্জি চাষ হচ্ছে।
এখন গুরুদাসপুর উপজেলায় চলছে মাছ চাষের উন্নয়নের জোয়ার। মাছ এবং কলা চাষের অর্থনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে দেশে।পরিকল্পনা হচ্ছে গুরুদাসপুরের জীবন্ত মাছ বিদেশে রপ্তানির। আসবে বৈদেশিক মুদ্রা, গড়বে সমৃদ্ধ বাঙলাদেশ।চলছে প্রতিযোগীতা, চলছে পুকুর খননের মহোৎসব। পুকুর গিলছে কৃষি জমি ,নদী,নালা, খাল-বিল আর জলাশয়।মানা হচ্ছে না সরকারী আইন-কানুন, বিধিবিধান। অভিযোগ আছে, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তা থেকে নি¤œ শ্রেনির কর্মচারিরা পরোক্ষভাবে পুকুর খননে সহযোগিতা করেছেন, করছেন। প্রতিরোধে স্থানীয় নদীরক্ষা আন্দোলন , চলনবিল রক্ষা আন্দোলন, পরিবেশ বাাঁচাও আন্দোলন,সচেতন নাগরিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন কমিটি নানাভাবে প্রতিবাদ জানালেও প্রশাসনের অনৈতিক আচরণে প্রভাবশালীদের কাছে অপ্রতিরোধ্য থেকে গেছে। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস এই অপ্রতিরোধ্য পুকুর খননের বেপরোয়া কর্মযজ্ঞ বন্ধে বিভিন্ন সময়ে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সচেতনতামুলক মাইকিং করেছেন, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদেরকে এবং প্রশাসনকে কঠোর ভাষায় নির্দেশ দিয়েও ব্যর্থ হয়ে তিনি নিজ হাতে স্পটে গিয়ে পুকুর খননের যন্ত্র এ´েভেটর জব্দ করেছেন, পুড়িয়ে দিয়েছেন। তারপরও থেমে নাই পুকুর খননের কর্মতৎপরতা। এ অপতৎপরতা রোধে মাননীয় হাইকোর্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাষÍবায়নে প্রশাসনিক কঠোর ব্যবসস্থা নেওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সবার সহযোগিতা চেয়ে গরুদাসপুর ইউএনও মো. তমাল হোসেন বলেন, নদী দুটি উদ্ধারে অবৈধ দখলদারদের তালিকা করা হবে এবং তাদের উচ্ছেদ করা হবে।
অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র পুকুর খননের ফলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে উপজেলার চাপিলা আর নাজিরপুর ইউনিয়নবাসী। নতুন খননকৃত পুকুরের চাপে পরে কৃষি জমিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃস্টি হয়েছে। এদিকে নদী খেকোদের অবৈধ দখলের ফলে তুলসী গঙ্গা ও মির্জামামুদ নদী অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলায় পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশনের সুযোগ না থাকায় এই দুই ইউনিয়নের মহারাজপুর,বৃপাথুরিয়া, বৃগড়িলা, বৃকাশো,পশ্চিম নওপাড়া,বৃচাপিলা,রানীনগর, লক্ষীপুর,খামার পাথুরিয়াসহ এলাকার বিভিন্ন গ্রাম স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধ থাকায় সারা বছর পানিতে ডুবে থাকে। এর প্রভাবে চাপিলা ও নাজিরপুর ইউনিয়নের মুল্যবান কৃষিজমি,অভ্যন্তরীন রাস্তা,পাকা সড়ক, ফলজ ও বনজ বাগান,শ্ক-সব্জির বাগান, বাড়িঘর স্কুলমাঠ (বৃপাথুরিয়া হাইস্কুল ও প্রাইমারী স্কুল,মহারাজপুর মাদরাসা ও প্রাইমারি স্কুল এবং মহারাজপুর বাজার) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পানির নীচে তলিয়ে থাকায় কৃষি আবাদ সম্পুর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। পানিবাহি রোগ ছড়াচ্ছে, পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, মশার উপদ্রপ বেড়েছে, ফলজ ও বনজ বাগান এবং বাঁশবাগান ধ্বংস হয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তা চলাচল অনুপযোগী হয়ে গেছে। সবমিলে প্রাকৃতিক পরিবেশ দুষিত হয়ে মানুষের বসবাসের সম্পূর্র্ণ অনুপযোগী এবং মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগপুর্ণ হয়ে পড়েছে। যে কোন সময় জনজীবনে মহামারি আকার ধারন করতে পারে। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা চেয়ে গুরুদাসপুর ইউএনও মো. তমাল হোসেন বলেন, নদী দুটি উদ্ধারে অবৈধ দখলদারদের তালিকা করা হবে এবং তাদের উচ্ছেদ করা হবে।
মানবসৃষ্ট এই দুর্যোগ থেকে উদ্ধার পেতে হলে ,চাপিলা,নাজিরপুর ইউনিয়নের স্থায়ী জলাবদ্ধতা দুর করতে হলে একমাত্র উপায় -তুলসীগঙ্গা ও মির্জামামুদ নদী জরুরী ভিত্তিতে সিএস রেকর্ডমুলে জরীপ করে সিমানা নির্ধারণ ও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে হবে এবং পুনঃ খনন করে পানি নিষ্কাশনের জোড়ালো পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: সভাপতি, চলনবিল প্রেসক্লাব।