বাতিঘর হিসেবে চলনবিল বার্তা 

Spread the love

মির্জা মোঃ আজিম হায়দার :

চলনবিল বার্তার ২য় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী  তাড়াশে উদযাপিত হচ্ছে ২৫ জুলাই ২০১৯। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হবে। দেশের উন্নয়নে তথ্যের বিস্তার-এর বিকল্প নাই। তথ্যই শক্তি, যোগাযোগই শক্তি আর এই কাজটি করছে ধারাবাহিকভাবে চলনবিল বার্তা। বলা হয়ে থাকে যার কাছে যত বেশী তথ্য আছে সে তত বেশী শক্তিশালী মানুষ এবং সমৃদ্ধ মানুষ। আবার যার যত বেশী যোগাযোগ আছে সে তত বেশী শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ মানুষ। আর এই কাজ করছে চলনবিল বার্তা। তাড়াশ উপজেলার তথ্য তথা চলনবিলের তথ্য খুব অল্প সময়ের মাঝে জেনে যাচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মানুষ এমনকি বিদেশে বসেও মুহুর্তের মধ্যেই জানতে পারছে চলনবিল এলাকায় ঘটে যাওয়া ভালো এবং মন্দ ঘটনা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় জানার সুযোগ করে দিয়েছে এই চলনবিল বার্তা। বিভিন্ন ধরনের তথ্যের মাঝে বিগত সময়ে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক লেখা থেকে উপকৃত হয়েছে, বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পেয়েছে অনেকেই।

তাড়াশ উপজেলায় বসবাসরত মানুষ একসময় নাটোরের জমিদারের অধিনস্ত ছিলো। জমিদারদের জমিতে মালিকানা প্রাপ্তির বিষয়গুলো জানা যায় বই থেকে, লেখা থেকে, আবার কাগজপত্র দেখে। কাগপত্র দেখার বা জানার জন্য লেখা পড়া জানতে হয়েছে অথবা অন্যের নিকট থেকে জেনে নিতে হয়েছে। ভূমির কাগজপত্র দেখা কেউ কেউ জানতে পেরেছে তাদের জমিদারের নাম কি ছিলো। ১৯৫০ সালের জমিদারী অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ত্ব আইনের ফলে জমির মালিকানা চলে যায় রাষ্ট্রের নিকট। রাষ্ট্রের সম্পত্তি যারা কবুলিয়ত মূলে ভোগ দখল করতেন তাদের নামে পরবর্তীদে ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড হয়। ভূমি রেকর্ড, সিএস, এসএ, আরএস এবং পরবর্তীতে আসবে বিআরএস জরিপ। এই বিআরএস জরিপ আসার সময় হয়তো ৫-৭ বছর লাগতে পারে। কারণ গত ১৯৭৮ সালের দিকে হয়েছে আরএস জরিপ যখন এই অঞ্চলের মানুষ বিষয়গুলো এতো বেশী জানতো না। ফলে বিভিন্নভাবে প্রতারণা শিকার হয়েছে অনেক মানুষ। কিন্তু আগামীতে যে বিআরএস জরিপ আসবে তার পূর্ব থেকেই যদি বিভিন্নভাবে জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করা যায় তাহলে হয়তো জনগণ উপকৃত হবে। নি:শ^ হতে হবে না সহজ সরল মানুষকে। আর এই কাজটি করতে পারে বিভিন্নভাবে প্রচারণার মধ্য দিয়ে চলনবিল বার্তা।

১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ত্ব আইনের ৯৭ ধারা বলে আমাদের দেশের সমতলে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধারায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলাদেশের সমতল ও পাবর্ত্য এলাকায় বসবাসরত প্রায় ৫৭টিরও বেশী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এই জনগোষ্ঠীর কোন কোনটির অস্তিত্ত্ব প্রায় বিলিন হতে চলেছে। বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য কোথাও নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসসহ তাদের জীবনের হারানো অনেক জানা-অজানা বিষয় এর পাশাপাশি বইটিতে ভূমি বিষয়ক তথ্য সম্পৃক্ত করা হয়েছে যা আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন এবং আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেও সমৃদ্ধ করবে। বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতে কোন না কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে বসবাস করে সর্বাধিক সংখ্যক সমতলের আদিবাসী। ঢাকা বিভাগের টাংগাইল, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলাতেও রয়েছে আদিবাসীদের বসবাস। আদিবাসীদের বিভিন্ন গ্রামের আদিবাসী সম্পর্কে জীবন জীবিকা, সংস্কৃতি, ইতিহাস বিষয়ক নানা তথ্য সংগ্রহের সাথে সাথে ভূমি বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এক্ষেত্রে ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা, সমস্যার কারণ এবং সমস্যা সমাধানে করণীয় বিষয়গুলো তাদের সাথে আলোচনা করা হয়।

তথ্য সংগ্রহ করার সময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আদিবাসীদের সাথে কথা বলা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মুন্ডা/পাহান, উরাঁও, সাঁওতাল, মাহালী, বাগদি, রাজবংশী, মাহাতো, পাত্র, খাসিয়া, ভূমিজ, রায়, রবিদাস, ভূঁইয়া, কর্মকার, রাজোয়াড়, কোল, কোচ, তুরী, মুসহর, মালো, বসাক/বড়াইক, রাখাইন, তেলী, ঘটমাঝি/পাটনী, পাহাড়ী, মল্লিক, গারো, হাজং এবং কোঁচ সম্প্রদায় ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল, উঁরাও, গারো, হাজং, মাহাতো (কর্মী) এবং মুন্ডা/পাহান সম্প্রদায়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়।

এক সময় বেশীর ভাগ আদিবাসীর প্রধান পেশা ছিল কৃষি কাজ। কৃষিকাজ ছাড়াও তারা কৃষিজাত কুটির শিল্প, মাছধরা, শিকার, ক্ষুদ্র ব্যবসা, দিনমজুরী প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিত ছিল। শ্রমিকের মধ্যে কৃষি মজুরী, বাঁশ ও বেঁতের কাজ, ধান কুড়ানো, কুলীর কাজ করা অন্যতম। এছাড়াও তারা মাছ ধরা, পশু ও কচ্ছপ শিকার, শামুক ও ঝিনুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করত তারা। আদিবাসী সেলুন, স্বর্ণকারের দোকান, চুন, হাঁস-মুরগীর খামার, দর্জীর দোকান প্রভৃতি ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িত। কিছু সংখ্যক আদিবাসী রিকশা ও রিকশা ভ্যান চালনা, চাকুরী, মুচি, কাঠের কাজসহ বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত। আদিবাসীরা যাযাবরের মত জীবন যাপন না করলেও তাদেরকে প্রয়োজনের তাগিদে বিশেষ করে খাদ্যের সন্ধানে, পশু শিকারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় বা তৎকালীন ভারতের এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে বসতী স্থাপন করতে হয়েছে। তাই তাদের স্থায়ী জমি ও আবাসনের ক্ষেত্রে সকল সময় চিন্তাা করতে হয়েছে। যাদের সাথে কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বেশী আদিবাসী পরিবারের নিজস্ব কোন জমি নাই। কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাদের বসত বাড়িও নাই। গারো, খাসিয়া, পাত্র এবং মনিপুরী জনগোষ্ঠী সাধারণত খাস জমি, বন বিভাগের গেজেটের জমি, অথবা অন্যের জমিতে বসবাস করছে। আলোচনা থেকে জানা যায় যে, ১৯৫৬-৬২ সালের এসএ রেকর্ড-এর পূর্বে এদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে অনেকের জমির পরিমান ছিল বৃহৎ পরিবারের মত। কিন্তু বর্তমানে সেটা কমে এখন আর বৃহৎ আদিবাসী পরিবার চোখে পরে না।

পক্ষান্তরে এসএ রেকর্ড বা ১৯৬২ সালের পূর্বের তুলনায় বর্তমানে ভূমিহীন এবং প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ভূমি মালিক আদিবাসী পরিবারের/খানার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি আদিবাসীদের প্রধান পেশা হলেও আদিবাসীদের কৃষি জমির মালিকানা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। আদিবাসীদের মালিকানাধীন বাগান ও পুকুরের পরিমাণ খুবই সীমিতি। কৃষি জমির মালিক আদিবাসীরা নিজেরাই নিজেদের জমি চাষাবাদ করেন। অর্থের প্রয়োজনে জমি বন্ধক/ লীজ দিয়েছেন এবং লীজের জন্য তেমন কোন ডকুমেন্ট বা সরকারি নিয়ম না জানার কারণে তাদের কাছে কোন প্রমাণপত্র নাই। কিছু কিছু পরিবার জমি বর্গা দিলেও তার কোন ডকুমেন্ট/কাগজ তারা সংরক্ষণ করছে না। এরজন্যই বেশীরভাগ আদিবাসীদের জমি জাল দলিলের মাধ্যমে হাতছাড়া হয়েছে।

ভূমিহীন আদিবাসীরা অন্যের মালিকানাধীন জমি যেমন; ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি, সরকারি খাসজমি, খাস জলাশয়, চা বাগানের জমি, বনবিভাগের জমি, রেলওয়ের জমি, সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি, অর্পিত সম্পত্তি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আবার বিনা অনুমতিতে বসতভিটা হিসেবে ও কৃষিকাজে ব্যবহার করছেন। কারণ এই সম্পত্তি যথাযথ কর্তৃপক্ষ তাদের কাজে না লাগিয়ে ফেলে রাখে। আদিবাসীরা নির্ঝঞ্জাট ও সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলেও ভূমিকে কেন্দ্র করে তাদের নানা ধরণের জটিলতা ও বিরোধের মুখোমুখী হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মূলতঃ নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ-আদিবাসীদের দ্বারা আদিবাসীদের জমি আত্মসাতের কারণে ভূমি বিরোধ দেখা দিচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আদিবাসীদের নিজেদের মাঝেও ভূমি বিরোধ দেখা দিচ্ছে। জমি দখলে আছে কিন্তু দলিলপত্র না থাকা, দলিলপত্র থাকা সত্ত্বেও জমি দখলে না থাকা, জোরপূর্বক জমি থেকে উচ্ছেদ করা, জালিয়াতি/ প্রতারণাকে ভূমি বিরোধের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমায় ফেলে তাদের হয়রানী করা হয়। ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের এলাকা/ পাড়া থেকে বিতারিত এমনকি দেশ ত্যাগেরে মত ঘটনাও নিরবে নিভৃতে ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। এলাকা থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ এবং আদিবাসীদের দেশ ত্যাগ করার তথ্য প্রদান করেছে যাদের সাথে কথা বলা হয়েছে সেই সকল আদিবাসীগণ। আদিবাসীরা ভূমি সংক্রান্ত  বিরোধ মোকাবেলায় বিশেষ করে ভূমি মালিকানা রক্ষায় আদালতে এবং স্থানীয় পর্যায়ে মামলা মোকদ্দমা ও অভিযোগ দায়ের করে থাকে। ভূমি বিরোধ থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য আদালত এবং স্থানীয় পর্যায়ে মামলা এবং অভিযোগ দায়ের করেছেন। এক্ষেত্রে আদালতে মামলা করার হার স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোগ দায়েরের চেয়ে অনেক বেশী। কোন কোন স্থানে দেখা যায় যে, আদিবাসীদের নামে সরকারী বন্দোবস্তকৃত জমি বিনা পারমিশনে বিক্রি/ক্রয় করে দখলে নিয়ে খাচ্ছে বাঙ্গালীরা যা ৯৭ ধারার বিধান মতে কোন অবস্থাতেই সঠিক নয়। আবার আদিবাসীদের জমি অর্পিত সম্পত্তি তালিকায় গেলে সেগুলো দখলে রেখেছে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী। এই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। এখনো কোন কোন এলাকায় আদিবাসীরা আদিকাল থেকেই ভূমির যৌথ/সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী এবং ভূমিকে যৌথভাবে ব্যবহার করে থাকেন। বর্তমান ভূমি ব্যবস্থাপনায় যৌথ ভূমি মালিকানার চেয়ে ভূমির ব্যক্তি মালিকানা কেন্দ্রিক রেকর্ডের কারণে কিছু কিছু জমি আদিবাসীদেরও এই ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। অবশ্য এখনও আদিবাসীদের যৌথ মালিকানায় জাহেরথান, মন্দির, প্যাগোডা, আশ্রম, কবরস্থান, শশ্মাণ প্রভৃতি সম্পদ আছে। এছাড়াও সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য একটি স্থান তারা যৌথভাবে ব্যবহার করে থাকে। শুধু আদিবাসীদের ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি নয়, তাদের যৌথ/সামাজিক মালিকানাধীন সম্পত্তিও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। মন্দির, প্যাগোডা প্রভৃতি ধর্মীয় স্থান এবং শশ্মাণ ও কবরস্থান বেদখল হওয়ার ঘটনাও বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটছে। যৌথ/সামাজিক মালিকানাধীন সম্পত্তি নিয়ে মারামারি ও মামলা দায়ের হওয়ার তথ্য প্রদান করেছেন তথ্য প্রদানকারীরা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায়।

আদিবাসীরা ব্যক্তির নামে জমির দলিল করার নিয়মকানুন সম্পর্কে না জানা এবং ভূমি বিষয়ক কাজে অফিস ও কাচারিতে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা তাদের ছিলনা বলে অনেকের সমস্যা হয়েছে। যদিও আদিবাসীরা বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতায় ভূমি মালিকানা পদ্ধতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। ভূমি অফিসের অসহযোগিতার কারণে নিয়মিতভাবে ভূমি রাজস্ব প্রদান করতে তারা ভয়পায়। তাই তারা তাদের রাজস্ব প্রদান করতে যায় না। আদিবাসী ভূমি মালিকের ভূমি রাজস্ব হালনাগাদ করার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহী নয়। কারণ হিসেবে দেখা যায় যে, তহসিল অফিসের সহযোগিতা তারা সহজে পায় না অথবা তারা সেখানে যেতে ভয় পায়। হাল নাগাদ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার ডকুমেন্ট চাওয়ার কারণে তারা আরো বেশী ভয় পায়। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে পদবীর পরিবর্তনের ফলে তাদের সম্পত্তি মিউটেশনের ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক কম। তার উপর ভূমি বিষয়ক কোন সমস্যার পড়লে তারা শিক্ষিত আদিবাসীদের সহায়তা খুব কমই পান। কোন কোন আদিবাসী ভূমি রেজিস্ট্রেশন (সংশোধন) আইন-২০০৫ পাশ হওয়া সম্পর্কে অবহিত আছেন। তবে বেশীর ভাগ আদিবাসী এই আইন কিছুই জানে না। এছাড়াও আদিবাসীদের সম্পত্তি পারমিশন নিয়ে বিক্রি করতে হয়। সেখানেও পারমিশন নিতে গেলে অনেক সময় লাগে এবং হয়রানীর স্বীকার হতে হয়। এই আইনগুলো আরো সহজ করা হলে তারা অনেক কম হয়রানীর শিকার হবে। আমাদের দেশের কোন নীতিমালা প্রণয়নের সময় আদিবাসীসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিষয়টিকে আমলে নেওয়া হয় না। এই বৈষম্য আদিবাসীদের দারিদ্র্য ও ভূমিহীনতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। যা মূলতঃ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীরই প্রতিফলন। ক্রমাগত ভূমি হারানোর জন্য আদিবাসীদের প্রতি নেতিবাচক রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণকে দায়ী বলে মনে করেন আদিবাসী জনগোষ্ঠী। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলেও আদিবাসীরা জমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। আবার তাদের সরলতার সুযোগ নিচ্ছে অনেকে।

ভূমি হারানোর কারণ ঃ আদিবাসীসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমি হারানোর কারণ হিসেবে জালিয়াতি/প্রতারণা, অ-আদিবাসীদের/ক্ষমতাধরদের দ্বারা জোরপূর্বক ভূমি দখল, আদিবাসী/প্রান্তিক মানুষের মাঝে সমন্বয়হীনতা ও দারিদ্র্য, সংগঠনের অভাব, ভূমি দখলকারীদের অবৈধ কার্যকলাপ সম্পর্কে আদিবাসী/প্রান্তিক মানুষের অসচেতনতা এবং ভূমি আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকাকে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়াও অ-আদিবাসী/ক্ষমতাধরদের নিকট জমি বন্ধক দিয়ে ফেরৎ না পাওয়া, ভূমি রাজস্ব হালনাগাদ না করা, নাম খারিজ (মিউটেশন) না করা, আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আইনের জটিলতা ইত্যাদি বিষয়কে ভূমি হারানোর জন্য দায়ী বলে মনে করেন। বন্ধকী নিয়ম নীতি মেনে বন্ধকী প্রদান না করা, অর্পিত সম্পত্তি আইনের জালে আটকা পরে, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতার অভাব , এনজিও’র বেশী সুদে টাকা নেওয়া এবং মহাজনী ঋণের জালে পরে জমি হারানো। এক্ষেত্রে তারা জমির মালিকানার জন্য রাষ্ট্রের আইনের চেয়েও কখনো কখনো রীতিনীতির প্রতি বেশী দূর্বল ছিল। তাই কাগজ সংরক্ষণ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিত না। বিভিন্নভাবে চরা সুদে ঋণ নেওয়ার কারণে আদিবাসী/প্রান্তিক মানুষ সম্পত্তি হারাতে বাধ্য হচ্ছে। তারা তাদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য চেষ্টা করলেও চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের সুদ এবং বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে উঠতে না পারা, মাঠে কৃষি শ্রমের অভাবের কারণে তারা তাদের সম্পত্তি হারাতে বসেছে।

বেশীরভাগ প্রান্তিক মানুষের বক্তব্য হচ্ছে ভূমি অফিসে গেলে তাদের ভালভাবে সহযোগিতা করা হয় না এবং তাদের আচারণ সহজসরল আদিবাসী এবং সাধারণ মানুষের কাছে বিমাতা সুলভ মনে হয় বলে তারা বলেন। এই কারণে তারা তাদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য করণীয় হিসেবে ভূমি প্রশাসনের স্থানীয় পর্যায়ের অফিস উনিয়ন ভূমি অফিসের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মনোভাবের পরিবর্তন কামনা করেন।

পারিবারে নারী-পুরুষ উভয়কেই সম্পত্তির বিষয়ে সম্পৃক্ত করে পারিবারিক সম্পত্তি স্বচ্ছ করার ক্ষেত্রে অংশীদারীত্ব প্রদানে উৎসাহিত করা। পারিবারিক, সামাজিক এবং সংগঠন পর্যায়ে নারীর সম্পত্তিতে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা। পারিবারিক সম্পত্তি রক্ষায় নারীর অবদানের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা। পিতার সম্পত্তি ছাড়া যৌথ/পরিবারের ক্রয়কৃত জমির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশীদারীত্ব নিশ্চিত করার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা। অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিকভাবে ভূমির সাধারণ ধারণা প্রদানে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা।

মানুষের মাঝে যদি শিক্ষার প্রসার ঘটানো যায় তাহলে তাদের ভূমিসহ অন্যান্য সমস্যা মোকাবেলা করা দ্রুত সম্ভব। বাংলাদেশের প্রচলিত ভূমি আইন শিক্ষার পাশাপাশি তাদের মাঝে সামাজিক রীতিনীতি বিষয়েও পরিষ্কার ধারণা প্রদানের লক্ষ্যে সচেতনতামূলক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সম্পত্তির মালিকানা রক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে চলনবিল বার্তা ধারাবাহিকভাবে ভূমি সংক্রান্ত আইন-কানুন নিয়ে প্রতিটি সংখ্যায় ছোট্ট একটি কলাম রাখলে চলনবিল অঞ্চলের মানুষের সম্পত্তি রাক্ষায় ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ^াস করি। বিশেষ করে সম্পত্তি মালিকানা রক্ষায় দলিল দস্তাবেজ, দখল, খাজনা এবং খারিজ বিষয়ে ধারাবাহিক তথ্য তুলে ধরার। ভূমি রেজিস্ট্রেশন : হস্তান্তর আইন, মিউটেশন, খাজনা, মাপঝোক ইত্যাদি শিক্ষায় সচেতন করার ক্ষেত্রে বাতিঘর হিসেবে কাজ করতে পারে চলনবিল বার্তা। শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা, নৈতিক শিক্ষায়ও চনলবিল বার্তা কাজ করছে এবং করবে আগামীতে এই   কামনা করছি।

 

লেখক: উন্নয়ন কর্মী । কথা: ০১৭১১১২৩৭৩০, ০১৫৫২৪৬৩৩৬১, ইমেইল: ধুরস@ধষৎফ.ড়ৎম

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD