আব্দুল কুদ্দুস তালুকদার
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক ফকির মজনু শাহ্ এর শিষ্য পীরপাল ভোলা দেওয়ানের স্মৃতিধন্য এককালের প্রবল বেগে বয়ে যাওয়া নদী এখন যা কালের প্রবাহে পলিতে ভরে গেছে সেই করতোয়ার তীরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিমগাছি বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় আজ দূর থেকে সুরম্য অট্টালিকা মনে হলেও ভেতরে অবস্থা নাজুক। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান জিন্নাহ্ জানান, পিছিয়ে পড়া দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত এই এলাকায় উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৯৩৭ সনে গ্রামের জোতদার যিনি পরে ভাটার পাড়ায় স্থানান্তর হন গোকুল চন্দ্র মাহাতো জমি দান করেন স্কুলের নামে। তার বন্ধু পার্শ্ববর্তী পুল্লা নিবাসী কর্মবীর হাজী আহমদ আলী সরকার , তার ভাই সেরাত আলী সরকার, এছাহাক আলী সরকার, ভাইপো আজগর আলী সরকার, ভূঁয়ট গ্রামের মছের খাঁ, নায়েব আলী শেখ, পাষান আলী সরকার, এনছাব আলী সরকার, যাদুল্লা মাহাতো, নিমগাছির ডাঃ ক্ষীতিশ কুমার গুন, হরেন্দ্র নাথ পোদ্দার, শশধর রায়, গোপালপুরের আছের আলী তালুকদার সহ অত্রাঞ্চলের শিক্ষানুরাগীগণের উৎসাহ ও পরামর্শে এই বদান্যতা। ঐ সময়ে সিরাজগঞ্জের এসডিও ছিলেন জনাব ইসহাক সাহেব। তিনি ছিলেন প্রচন্ড বিদ্যোৎসাহী। তার নামে আজও স্কুল আছে তাড়াশের বস্তুলে, শাজাদপুরের তালগাছি, উল্লাপাড়ার গয়হাট্টা সহ তৎকালীন মহুকুমার অনেক জায়গায়। তার স্ত্রী সালেহার নামে সিরাজগঞ্জে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় যা আজ একমাত্র সরকারী স্কুল শহরের। তার পৃষ্ঠপোষকতাও এক্ষেত্রে স্মরণীয়। তবে নিমগাছির জমিদার বিদ্যোৎসাহী শচীন্দ্রনাথ ভাদুড়ী ওরফে ভাদু বাবুর উৎসাহ বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত। তিনি তার আত্মীয়কে ডেকে এনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন ; যখন এই এলাকায় কোন ম্যাট্রিক পাশ লোক ছিল না। কারণ তার পৈত্রিক বাড়ী ছিল লাহিড়ী মোহনপুর অঞ্চলে এবং ঐ এলাকার লোকজন ছিল সেই সময় তুলনামূলক শিক্ষিত নিমগাছি অঞ্চলের চেয়ে ।
মাইনর স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে আশানুরুপ সরকারী সহযোগিতা না পেয়ে বা নিজেদের উদ্যমের অভাবে কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে। এছাড়া ঐ সময়ে বা তৎপরে নানা আন্দোলনের কারণে রাজনৈতিকভাবে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। পাকিস্তান নামক আলাদা দেশ গঠন হবার পর স্কুল কমিটি নতুনভাবে কাজ চালিয়ে যাবার লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতে সরকারী গ্রান্ট পায় যার মাধ্যমে ১৯৬৪ সনে বিল্ডিং নির্মিত হয়। ঐ সময়ের প্রধান শিক্ষক পিয়ার আলী সরকার জানান, তিনি ছিলেন সিরাজগঞ্জের বাগবাটি স্কুলে তরুণ সহকারী শিক্ষক। ভূয়টের তার বন্ধু নুরু মেম্বর ও নিমগাছি প্রাইমারী স্কুলের তৎকালীন হেডমাষ্টার আব্দুর রহমান তালুকদার সাইকেল চালিয়ে গিয়ে তাকে ধরেন বাগবাটিতে, হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেবার জন্য। তাদের নিরাশ করেননি তিনি। স্কুলের ঐ সময়ের হেড মাষ্টার শিক্ষা অফিসার হিসেবে যোগ দিয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ ছাড়েন। তিনি আরও জানান, দালান নির্মাণ কাজের অর্ডার পেয়ে
ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টির এই দুর্দশা নিরসনের জন্য এলাকাবাসী তাড়াশ-রায়গঞ্জের সুযোগ্য সাংসদসহ সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
স্কুল মাঠে ইটের ভাটা তৈরী করে ইট পোড়ানো হয়। কিন্ত তার মান ভাল না হওয়ায় পাবনার চাটমোহর উপজেলার অষ্টমনিষা থেকে নৌকায় ইট এনে তাড়াশের চন্ডিভোগের তমাল তলায় ফেলা হয়। ঐ স্থান হতে তা গরু – মহিষের গাড়ীতে এনে স্কুলের বিল্ডিং তৈরী। তারও আগে পরিদর্শন করেন স্কুলটি তৎকালীন সিরাজগঞ্জের এসডিও ইনাম আহমেদ চৌধূরী যিনি পরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা হন। সিরাজগঞ্জ থেকে তিনি ভাঙ্গা – চোরা ধুলি ধুসরিত কাঁচা রাস্তায় জীপ নিয়ে আসেন স্কুল ভিজিটে ধুলায় গাড়ী ও নিজে আচ্ছন্ন হয়ে। স্কুল পরিদর্শনের একদিন আগে রাতারাতি সেরাত সরকারের গোয়াল ঘর ভেঙ্গে এনে বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণ করে কমিটি। কারণ, ঐ সময়ে ইউনিয়ন বোর্ডের পঞ্চায়েত ছিলেন সোনাখাড়ার প্রবল পরাক্রান্ত আব্দুল গফুর তালুকদার। তিনি চাইছিলেন স্কুল হবে সোনাখাড়ায়। জমিও দান করেন তার গাঁয়ের লোকজন। বিশাল মাঠ ছিল তা খেলার। ইউনিয়ন বোর্ড অফিস ছিল সোনাখাড়া হাটখোলায়। মাঠ ছিল তার সামনে। প্রতি বৎসর ধুমধাম করে দেশের নামকরা টিম এসে ফুটবল খেলত সেই মাঠে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে। আজ সেই মাঠ দাতাগন দখলে নিয়ে ধানচাষ করে। কিন্ত মাঠ থাকলেও সেখানে স্কুল ঘর ছিল না। তাই পঞ্চায়েতকে ফাঁকি দেবার জন্য ভিজিটের আগে রাতারাতি ঘর তোলে নিমগাছি হাইস্কুল কমিটি। ফলে ঘর না থাকায় সোনাখাড়া হাইস্কুল অনুমোদন পেল না, পেল নিমগাছি ; ডাকসাইটে পঞ্চায়েতের প্রবল বিরোধীতা সত্বেও। পঞ্চায়েতের যুক্তি ছিল নিমগাছি অঞ্চলের আদিবাসী মাহাতো, উরাওঁ, তাঁতী, মালী এসব ছোট জাতের লোকজন লেখাপড়া শিখলে বা মানুষের মত মানুষ হলে ওরা আর পঞ্চায়েত বা এলাকার প্রভাবশালীদের মান্য করবে না। তাই থাকুক ওরা যেমন আছে তেমনি নেংটি পরে অসভ্যের মতই শিক্ষার আলো থেকে দুরে এবং আজীবন তাদের পায়ে প্রনাম দিক বসংবদ হয়ে। কারণ, নিমগাছি বা পাশের গ্রামসমূহের আদিবাসীরা তখন ধুতি – লুঙ্গী পরিধান করতো না বেশীর ভাগ। গামছা সাইজের লেংটি নামক একখন্ড বস্ত্র বিশেষভাবে পরতো যা অর্ধ – উলঙ্গের মতই দৃষ্টিতে মনে হতো।
সদ্য স্বাধীন দেশে আবারও স্কুলটি অনুদান পায় যখন ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হাজী আহমেদ আলীর বড় ছেলে আবুল কাশেম সরকার। আর একটা দালান হলো দক্ষিন দুয়ারী আগের টার পূর্বপাশে তিন কক্ষ বিশিষ্ট। প্রথমটি ছিল এক রুমের। পরে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিম দূয়ারী দোতলা দালানটি তৈরী হয়েছে বিভিন্ন সরকারের এক্সটেনসন বাজেটে। এরপরেও স্থান সংকটে শিক্ষাদান কাজ বিঘিœত হচ্ছে। বর্তমান প্রধান শিক্ষক স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতার নাতী। তার যোগদানের পর থেকেই ছাত্র – ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। পাশেই নামকরা তিনতলা গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজ থাকলেও দিন দিন ছাত্রী সংখ্যা বাড়ছে এখানে উল্লেখযোগ্য হারে। কিন্ত ২০ জন শিক্ষক – শিক্ষিকা থাকলেও ক্লাশরুম আছে ১৫টি। আরও দশটা রুম নির্মাণ হলে মোটামুটি সমস্যাটির বর্তমান সমাধান হয়।হাজারের উপর শিক্ষার্থী অথচ শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে তাদের বসতে দেয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশী সমস্যা হয় স্পেসাল ক্লাস নিতে। যেমন- হিন্দু ধর্মের শিক্ষার্থীগনের আলাদা রুম দরকার হয়। এছাড়া আর্টস বা কমার্সের বিশেষ সাবজেক্ট নেবার জন্য, কৃষি বিভাগের কিংবা গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীগনের জন্যেও কক্ষ দরকার। তাছাড়া টয়লেট নাই বললেই চলে। সমস্যাটা মারাত্মক রূপ ধারন করেছে। এব্যাপারে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বার বার লিখে, আবেদন দিয়েও সাড়া নেই। দৌড়াদৌড়িও কম করা হচ্ছে না মর্মে তিনি আক্ষেপ করেন। যারা উন্নয়নের কুসীলব তারা বিশেষভাবে ম্যানেজ হওয়ার কারণে তার স্কুলের নামে বরাদ্দ হওয়া বিল্ডিং অন্যত্র নির্মাণ হচ্ছে। এ যেন- রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায় – এর মত দশা.. ।ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টির এই দুর্দশা নিরসনের জন্য এলাকাবাসী তাড়াশ-রায়গঞ্জের সুযোগ্য সাংসদসহ সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
লেখক : বিশিষ্ট কবি , সাংবাদিক ও কলামিষ্ট ।