জর্জিয়াস মিলন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দুই দফা আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ, রামুতে বৌদ্ধমন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া, পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসত বাড়িতে হামলা, নওগাঁয় চারজন সাঁওতাল কৃষককে হত্যাকরা, দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির উচ্ছেদের চেষ্টা, চিরিরবন্দরে হিন্দু উপাসনালয়ে আক্রমণ, পাবনার হেমায়েতপুরে শ্রীশ্রী অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের সেবায়েতকে হত্যা এ রকম বহু নজির আমাদের স্মৃতিতে। ভারত-পাকিস্তান ভাগই হয়েছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, যার মূল কথা ছিল হিন্দু ও মুসলিম দুটি আলাদা জাতি (যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিকভিত্তি নেই), তাদের আর একসঙ্গে থাকা চলে না। ভারত ভাগ নিয়ে হিন্দু, মুসলিম আর শিখ ধর্মের মানুষেরা ইতিহাসের ভয়ংকরতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মেতে উঠেছিল। কলকাতা, নোয়াখালী, বিহার আর পাঞ্জাবের এসব দাঙ্গায় কমপক্ষে ১২ লাখমানুষ নিহত হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতা পাকিস্তানেও চলেছে। রামমন্দির-বাবরি মসজিদ দাঙ্গার ধাক্কা লেগেছিল বাংলাদেশেও। বহুসংখ্যক হিন্দু মানুষ তখন দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। বদরূদ্দীন উমর বলেছিলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ রয়ে গেছে।
তারপরেও আমরা দেখেছি ১৯৪৮ ও ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর ১১-দফা ভিত্তিক গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি অংশগ্রহণ করেছে সকল ধর্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে। পবিত্র উচ্চারণে ও শ্লোগানে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলীর ঐক্যবদ্ধ স্বত্বা “তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি”; “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা”; এবং “বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি”। পাশাপাশি, বাঙালিত্বের চেতনাবাহী “জয় বাংলা” ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র! আর সবশেষে যখন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বিশ্বকবির “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…” নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন তখন অসাম্প্রদায়িক স্বদেশ “সোনার বাংলা” প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়টির দৃঢ়তা ও গভীরতা স¤পর্কে সব সন্দেহ দূরীভূত হয়ে গিয়েছিল। সম্রাট আকবরের সময়কালে শুরু হওয়া পহেলা বৈশাখ আজ বিশ্ববাংগালীর তথা বাংলাদেশের এক অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর উৎসবের সূতিকাগার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি , ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা, ঘোড়ামেলা, চট্টগ্রামে বর্ষবরণ সহ নানা আয়োজনে বাংলার সকল মানুষ যেন হয়ে ওঠে এক নিবির বাঙ্গালী। যেখানে কোন ভেদাভেদ ব্যবধান থাকে না। এমন সম্প্রীতিময় উৎসবে সকল সাম্প্রদায়িকতা মুছে বাঙালীর পরিচয় প্রকাশিত হোক সম্প্রীতিময়তার এক বিশ্বজনীন নজির হিসেবে।
লেখক : কবি ও সাহিত্যিক।