মোঃ আবুল কালাম আজাদ
প্রাক কথন :
১৯৭০ সাল । আমি তখন শিকারপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত । রাজনীতি সম্পর্কে আমার কোন ধারনা বা সম্যক যা জ্ঞান থাকা দরকার তা ছিলন না। প্রায়ই দেখতাম মিছিল। মিছিলে লাইন ধরে শত শত বিভিন্ন বয়সের মানুষ শ্লোগান দিতে দিতে চলে যেত । আমাদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে যখন মিছিল যেত আমার বয়সের কিছু ছেলেদের নিয়ে ঐ মিছিলে যোগ দিতাম। আর উচ্চ স্বরে শ্লোগান ধরতাম “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো , জয় বাঙলা , তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা,তুমি কে, আমি কে- শেখ মুজিব শেখ মুজিব , পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা ,শেখ মুজিবের কিছু হলে – জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে ” ইত্যাদি শ্লোগানে মুখরিত করে তুলত । মিছিল দেখার জন্য বাড়ির ভিতর থেকে বহু নারী- পুরুষ বের হয়ে আসতো । মিছিল যাওয়ার পরে আমরা শিশুরা অমনিভাবে মুষ্ঠিবদ্ধ ডান হাত উঁচিয়ে শ্লোগান দিয়ে গ্রাম ঘুরতাম । এভাবে প্রায়ই শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে শ্লোগান দিয়ে সকাল- রাত্রে মিছিল বের হতো । আমরাও বন্ধুদেরকে সাথে নিয়ে মিছিলে যোগ দিতাম । এজন্য বাড়িতে এসে মা‘র হাতের পিটুনিও খেতাম । মিছিলে আমি বন্ধুদের নেতৃত্বও দিতাম ।
আমার আব্বা ছিলেন শিকারপুর প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং এলাকার নামকরা প্রধান বুদ্ধি-পরামর্শদাতা ।গ্রাম্য এবং জাতীয় রাজনীতিতে তাকে নেতৃত্ব দিতে দেখেছি । দেখতাম প্রায় প্রতিদিনই দুর দুরান্ত থেকে শিক্ষিত এবং মাতবর শ্রেনির মানুষজন আসতো আব্বার কাছে বুদ্ধি পরামর্শ নিতে । তারা এসে আব্বার সাথে সলাপরামর্শ আর পরিকল্পনা করতেন । আমি যে ঘরে পড়তাম সেই ঘরেই আলোচনা হওয়ায় পড়ার ফাঁকে আলোচনা শুনতাম । আমাদের পরিবার পূর্বপুরুষ থেকেই গোষ্ঠিগত বড় হওয়ায় গোটা মশিন্দা ইউনিয়নে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে নেতৃত্ব দিত । আমার দাদার খালাতো ভাই কাছিকাটার সরাফতুল্লা তালুকদার গোষ্ঠির প্রভাবে ইউনিয়ন নির্বাচনে একাধিকবার বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন । আমাদের গোষ্ঠির শিকারপুর, মশিন্দা,কাছিকাটা , হাসমাড়ি, রানিগ্রাম, শিধুলি, চরকাদহ সহ যে যেখানেই ছিল সবাই আওয়ামি লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক। তাই বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামিলীগের নেতা- সমর্থক আমাদের বাড়িতে এসে ঘরোয়া মিটিং করতো । এমনকি সুফি আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা অত্র এলাকার পীর শেরই বাবুর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশও আমাদের বাড়িতে এসে অবস্থান করে তাঁর ভক্ত এবং আওয়ামীলীগের নেতাদের নিয়ে মিটিং করতেন । পাকিস্তানি সমর্থকদের ভয়ে সতর্ক থাকতে হতো । আমাদের গ্রামের সাথেই বাহাদুরপাড়া শিকারপাড়া গ্রামে আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের বসবাস । তারা ছিল জামায়াত- মুসলিমলীগ সমর্থক। আমাদের হানাফি মযহাব সম্প্রদায়ের সাথে আহলে হাদিস মযহাবের ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক মতের কখনই মিল পড়ত না ।এজন্য ফারায়েজী সম্প্রদায়ের সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক আর ধর্মীয় বিষয় নিয়ে মাঝে-মধ্যেই বচসা হতো ।
১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস। চারিদিকে রব উঠেছে গুরুদাসপুরে আসবেন আওয়ামিলীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন । আসন্ন প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রিয় নির্বাচনে স্বৈরাচারী পকিস্তানী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে তার দল আওয়ামীলীগের প্রার্থীর নৌকা মার্কা প্রতিকে ভোটের প্রচার ও জনসংযোগে গুরুদাসপুরে আসছেন এবং তিনি গুরুদাসপুর হাইস্কুল মাঠে ভাষন দিবেন । এ খবরে গুরদাসপুর , বড়াইগ্রাম, সিংড়া , তাড়াশ ,চাটমোহর থানার সকল মানুষের মধ্যে ব্যাপক জাগরনের সৃস্টি হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনকে কেন্দ্র করে মিছিল আর মিছিল । একটাই শ্লোগান ‘ জেলের তালা ভেঙ্গেছি- শেখ মুজিবকে এনেছি, আইয়ু খানের গদিতে- আগুন জ্বালো এক সাথে’ ইত্যাদি ।আমরা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্ররাও মিছিলে অংশ গ্রহণ করি ।শ্লোগান যারা ধরিয়ে দেয় তাদের হাতে একটা করে লম্বা টিনের চঙ থাকে । চঙ মুখে লাগিয়ে শ্লোগান দিলে অনেক দুর থেকে শোনা যায় । সেই চোঙ দিয়ে শ্লোগান ফুকে দিচ্ছে আর আমরা মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উচিয়ে শ্লোগান ধরছি আর দৌড়াচ্ছি ।
২৩ শে নভেম্বর সোমবার ১৯৭০ তারিখে শেখ মুজিবকে একনজর দেখার জন্য বিশাল মিছিল নিয়ে ব্যান্ড পার্র্টির ঢাকঢোল বাজাতে বাজাতে দির্ঘ ৪ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে গুরুদাসপুর হাইস্কুল মাঠে গিয়ে পৌছাই । আমার জীবনের এই প্রথম গুরুদাসপুর আসা । দেখি বিশাল মাঠ ভর্তি , রাস্তায় মানুষ ভর্তি । দাঁড়ানোর জায়গা নাই । শোনা য়ায় পশ্চিমে নারিবাড়ির মোড় , পুর্বে চাঁচকৈড়, দক্ষিনে শিধুলি পর্য্ন্ত মানুষ আর মানুষ । হাতে হাতে ব্যানার , ফেস্টুন আর শ্লোগানে মুখরিত সারা গুরুদাসপুর এলাকা । আমরা মিছিল নিয়ে সরাসরি মাঠের পুর্ব পার্শ্বে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিচ্ছি আর মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে লাফাচ্ছি । মাঠের দক্ষিণ -পশ্চিমে ( এখন যেখানে হাইস্কুলের একাডেমিক নতুন ভবন ) বিশাল উঁচু মঞ্চ তৈরী করা হয়েছে । এত উঁচু মঞ্চ এবং এত মানুষ আমি কখনও দেখি নাই । দুপুর থেকে আমরা সদ্য জেল থেকে মুক্তি পাওয়া বাঙ্গালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এর আগমনের অপেক্ষায় টানা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকি । এদিকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কালো হাফ কোট সাদা পাঞ্জাবির উপর গায়ে দিয়ে একজন হালকা পাতলা চেহারার কালো অল্প বয়সের লোক অত্যন্ত বলিষ্ঠ অগ্নি ঝরা কন্ঠে মাইকে বক্তৃতা দিচ্ছে ।একজনের কছে বক্তার পরিচয় জানতে চাইলে জানায়, বক্তা হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের তুখোর ছাত্রনেতা আব্দুল কুদ্দুস । তার বাড়ি বিলের মধে বালসা গ্রামে । তিনি নেতা শেখ মুজিবের অত্যন্ত নিকটের । এ কথা শুনে গর্বে আমার বুক ভরে গেল । কারণ, আমার এলাকার একজন ছাত্রনেতার অত বড় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিকটের তাই ।এদিকে ‘ তোমার নেতা , আমার নেতা , শেখ মুজিব, শেখ মুজিব । জেলের তালা ভেঙ্গেছি , শেখ মুজিবকে এনেছি, জেগেছে জেগেছে, বীর বাঙ্গালী জেগেছে । তোমার আমার ঠিকানা , পদ্মা মেঘনা যমুনা, তুমি কে আমি কে ,বাঙালী বাঙালী ‘ ইত্যাদি শ্লোগানে শ্লোগানে মাঠ গম গম করছে । মঞ্চে একের পর এক স্থানীয় এবং ঢাকা, নাটোর- রাজশাহী থেকে আগত বিভিন্ন নেতা বক্তৃতা করে জনগনকে ধৈর্য ধরার আহবান জানাচ্ছেন আর আওয়ামলিীগের নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার আহবান জানাচ্ছেন । সাথে সাথে জনগন উজ্জিবিত হয়ে জোরে জোরে শ্লোগানে শ্লোগানে মাঠ মুখরিত করে তুলছে ।
সময় ক্রমেই গড়িয়ে যাচ্ছে বহু কাঙ্খিত নেতার আগমনের কোন খবর নাই । অবশেষে বহু প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে জীপে করে কয়েকজন মাঠের দক্ষিণ দিক দিয়ে ঢুকে মঞ্চে উঠে ঘোষণা দিল, প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এসেছেন । কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মঞ্চে পৌছাবেন আপনারা ধৈর্য ধরেন । এ ঘোষণার পর যারা মাঠের বাইরে ঘোরাফেরা করছিল তারা ছুটে মাঠের মধ্যে এসে জায়গা দখল করছিল ।আমরাও পিছিয়ে নেই । সুযোগমত দাঁড়িয়ে যাই দলবল নিয়ে মাঠের পুব্র্ পার্শ্বে যাতে মঞ্চে নেতাকে দেখতে পাই । এত মানুষের জনসভা আমি কখনও দেখি নাই । এত মানুষের মাঝে নিজেকে মনে হচ্ছিল আমি যেন একজন বড় মানুষ হয়ে গেছি । বিশাল জনসমুদ্রে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি । রাজনীতিতে একজন সক্রিয় কর্মী বলে ভাবতে শিখেছি ।
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো । আছরের নামাজ শেষ । বেলা প্রায় ডুবু ডুবু । মানুষের আর তর সইছে না । বাড়ি যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে । বহু দুর-দুরান্ত থেকে মানুষ এসেছে । যেতে রাত হবে । ছোট ছোট ছেলেরাতো ভয় পাচ্ছে জঙ্গল পেরিয়ে রাত হলে কীভাবে যাবে এই চিন্তায় সবাই চিন্তিত । সকল ভয়কে দুরে ঠেলে দিয়ে একই চিন্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখবো আর তার ভাষন শুনেই যাব এই দৃঢ় পণ করে কেউ মাঠ থেকে লড়ছেনা । এরই মধ্যে কয়েকটা জীপ গাড়ি থানার সামনে আসার সাথে সাতে জনগন গাড়ি ঘিড়ে ধরেছে । বঙ্গবন্ধু সহ কফেকজন নেতা গাড়ি থেকে নামলেন । আমি ছোট তাই দেখার জন্য ছাগল চানার মত লাফালাফি করছি।দেখছি কালো হাফ কোট সাদা পাঞ্জাবির উপর গায়ে একজন উঁচু লম্বা স্বাস্থ্যবান মানুষ দ্রুত বেগে লোকের জটলা ঠেলে মাঠের মধ্যে ঢুকে মঞ্চের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন আর তাকে অনুসরণ করে পিছে পিছে দৌড়ের সাথে অনেক লোক যাচ্ছেন । ঐ লম্বা স্বাস্থ্যবান উঁচু মানুষটাই শেখ মুজিব বলা কওয়া করছে । আমিও তাই মনে করে নেতা দরশনে সৌভাগ্যবান হলাম । নেতারা আমাদের কাছ দিয়েই মঞ্চের দিকে গেলেন ।তাই কাছ থেকেই দেখতে পেলাম । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রথম দেখাই কাছ থেকে দেখার অনুভূতিটা আমাকে যে কী পরিমাণ বিমূগ্ধ এবং বিমোহিত করেছিল তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয় । মাইকে তখন সে কী গগনবিদারী শ্লোগান বঙ্গবন্ধুর আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম । শেখ শেখ শেখ মুজিব ,লও লও লও ছালাম , জেলের তালা ভেঙ্গেছি শেখ মুজিবকে এনেছি, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব, পিন্ডি না ঢাকা , ঢাকা ঢাকা ইত্যাদি ।
জনসমুদ্র ঠেলে দুই হাত উঁচিয়ে বীরদর্পে হেটে বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে উঠলেন সঙ্গের নেতাদের নিয়ে । তখন মাইকে ঘোণনার সাথে সাথে মাঠের কানায় কানায় উপছে পড়া উত্তাল জনসমুদ্র করতালিতে এবং শ্লোগানে আরো উত্তাল হয়ে উঠলো । আমরা মাঠের প্রায় মাঝামাঝি থেকে হাত উঁচিয়ে শ্লোগানের সাথে লাফাচ্ছি । সময় না থাকায় বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠেই দুই হাত উঁচিয়ে মাইকে উপস্থিত জনতার কাছে তাঁর আসতে দেরীর কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেন । তারপর তাঁর সাথে আসা কয়েকজনের বক্তৃতার পর বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করেন ।বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বিশাল জনসমুদ্রের দিকে দুই হাত তুলে অভিবাদন জানান । জনগন বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে স্ব-চোখে দেখতে পেয়ে উল্লাসে করতালি আর শ্লোগানে ফেটে পড়ে । বক্তৃতার শুরুতেই জনতার উদ্দেশ্যে সালাম দেন। তারপর বলেন, পথে আসতে বহু স্থানে জনসভা করতে হয়েছে তাই আমার আসতে দেরী হয়েছে । আপনারা আমার জন্য অনেক কস্টকরে না খেয়ে অপেক্ষা করছেন । এ জন্য আমি দুঃখিত । তারপর বক্তৃতায় তিনি আওয়ামিলীগের নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য জনগনের সমর্থন চান। উপস্থিত জনতা দুই হাত তুলে সমর্থন জানায় । সন্ধ্যা লাগার কারণে পূর্ণ বক্তৃতা না শুনেই আমরা মাঠ থেকে বের হয়ে চলে আসি । সারা রাস্তা মিছিল করে শ্লোগান দিতে দিতে রাত ৮ টার দিকে বাড়িতে ফিরি ।
লেখক : সভাপতি, চলনবিল প্রেস ক্লাব, গুরুদাসপুর।