নাসিমা খাতুন (রুপা)
আমার বড় বোনের দু’গালে গাঢ় কালচে দাগ ছিল। হঠাৎ একদিন মনে হল, ওর ঐ দাগগুলো কিসের? মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা বড় আপার গালে ওগুলো কিসের দাগ। মায়ের সেদিনের কথাগুলো শুনে আমার গা ছমছম করে উঠেছিল। মা আমার প্রশ্নটা শুনে একটু থেমে গেলেন, মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম, চোখ দুটো তার জলে ছল ছল করছে।
মা আমাকে বুকে টেনে নিলেন এবং বলতে শুরু করলেন। ১৯৭১ সালের ঝাঁঝালো চৈত্রের কোন এক দুপুর বেলা পাক হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঠিক সেই মুহুর্ত্বে মা না কি প্রসব যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিলেন। দাদীমা তখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। তিনি কোন উপায় না দেখে কিছু শুকনো খর জোগার করে একখানা কাঁথা বিছিয়ে মাকে বাড়ীর উঠোনে রেখে সবাই যার যার জীবন বাঁচানোর তাগিদে দৌঁড়ে এক কিলোমিটার দূরে যমুনা নদীর পাড়ের নিচে পালিয়েছিলেন।
এমতাবস্থায়, এই নিষ্ঠুর অমানবিক পরিবেশে ভূমিষ্ঠ হয় ফুট ফুটে চাঁদের মত একটি মেয়ে। সন্তান জন্মের পর তিনি না কি দীর্ঘ সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন তার ¯েœহময়ী সন্তানের দিকে তাকিয়ে দেখেন চৈত্রের প্রখর রৌদ্রের তাপে তার প্রিয় সন্তানের মুখখানা ততক্ষনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। নান্দনিক এই পৃথিবীতে আসা শিশুটির নরম কোমল চিৎকার জানান দিচ্ছে মাকে। তার ঝলসে যাওয়া মুখের বেদনার আকুতি এবং পিপাসার্ত গলার আর্তনাদ। তখন অসহায় মা শিশুটিকে পরম মাতৃত্বের কোলে শপে নিলেন এবং বুকের দুধ পান করালেন।
মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে সেই শিশুটি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। হাজারও প্রতিকুলতা শিশুটিকে জীবন্ত মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছে। -’৭১ এর সেই অসহায় জলজ্যান্ত সাক্ষী শিশুটিই হল আমার বড় বোন। যার গালের লালচে দাগটি আজও সেই বিভীষিকাময় করুণ ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের পরিবারকে। এমনি হাজারও পরিবার আজও আমাদের স্বাধীনতা ইতিহাসের স্বাক্ষী।