তাড়াশবাসীর দূর্ভাগ্য ঃ তারা কখনই ‘ত্যাগী’ নেতা পায়নি !

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু

এটা মনে হয় কোন পশ্চাৎপদ জনপদের সচরাচর বৈশিষ্ট্য যে, সেখানে কোনো ত্যাগী ও জনগণের জন্য উসর্গিত নেতৃত্ব সহজে আবির্ভূত হয় না বা আগমন ঘটে না। আরো নির্দিষ্ট করে বললে তাড়াশের কথাই বলতে হয়। কারণ এখানকার রাজনৈতিক অঙ্গনে অদ্যাবধি সত্যকার আদর্শবান ও নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বের শূন্যতা রয়েছে; যা তাড়াশবাসীর জন্য দূর্ভাগ্য বটে। এ অভাব পূরণ হওয়া জরুরী যদিও বাস্তবে তা সুকঠিন। আমরা ভেবে দেখেছি, তাড়াশ আজো পিছিয়ে থাকার এটাই বড় কারণ, অবশ্য একমাত্র কারণ নয়। প্রকৃত জনকল্যাণকামী কোন বড় মাপের, প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গীর কেউ সমাজের হাল না ধরলে সেই এলাকা ও সমাজ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে  অনেক বিলম্ব করে ফেলে। নির্বাচিত না হয়েও তাড়াশের অন্তত: দু’জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব  স্বাধীনতার  পর জাতীয় সংসদে যাবার সুযোগ পেলেন। ৮০’ দশকে মরহুম আতাউর রহমান বাম দল থেকে জাতীয় পার্টিতে গিয়ে হাত মেলালেও সে সময়ে মনোনীত  এমপি হিসেবে জাতীয় সংসদে গিয়ে এলাকার উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখার বেশী সুযোগ তিনি পাননি। তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেটা ছিল তার অনভিপ্রেত। তবে পার্লামেন্টে তিনি কথা বলেছেন, বিতর্ক করেছেন- তা আমরা শুনেছি। একজন রাজনীতিকের প্রধান গুণ যে বাগ্মীতা , তা আতাউর রহমানের মধ্যে পুরোটাই বিদ্যমান ছিল। ছিল রাজনৈতিক জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা। আর তাদের সময়ে রাজনীতিতে সততা ও স্বচ্ছতা ন্যূনতম হলেও অনুসৃত হত। তখনও রাজনীতি এত লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়নি। কিন্তু স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে একমাত্র উপজেলা মডেল ছাড়া অনুকুল  গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় আর ব্যাপক কোন উন্নয়নের অবকাশ ছিল না।

এর পূর্বে তাড়াশের উপজেলা ইতিহাসে প্রথম সরাসরি ভোটে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যন সরদার আব্দুল জলিল তাড়াশ উপজেলার বেশ কিছু উন্নয়ন কাজ করেছেন। তিনি বিএনপি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট হলেও তার মধ্যে স্বার্থপরতা ও লোভলালসা তেমনটি  কেউ দেখেছে বলে শোনা যায় না। ব্রেইন স্ট্রোক করার পর আজও তিনি  দোবিলা গ্রামের যে বসতবাড়ীতে বলতে কি অন্তরীন অবস্থায় কোনো মতে বেঁচে আছেন, সে বাড়ির চেহারা দেখলেও প্রতীয়মান হবে, তিনি এক সময়ের বড় নেতা হয়েও আপন অবস্থা বা ভাগ্য পরিবর্তনের কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেননি। এরপরই আসে অপরাপর নেতৃত্বের  ইতিকাহিনী  যারা ’৯০ এর দশক থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত  তাড়াশ উপজেলা ও সংসদীয় আসন পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে কর্ণধার হয়েছেন। সাধারণ আমজনতা প্রথমেই নেতৃবৃন্দকে এভাবে মূল্যায়ন করে যে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা কতটুকু নিজেদের ভাগ্য বদলিয়েছে। আর কতটাই বা এলাকার  গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করেছে। নেতৃত্বের গুণাবলী বই পুস্তকের সংজ্ঞায় কিংবা পরিভাষায় মানুষ যাচাই করতে চায় না। তারা চায় সমাজের নেতৃবৃন্দ সর্ব সাধারণের চোখের ওপর যা কিছু আমল বাস্তবায়ন করে তার প্রত্যক্ষ চুলচেরা বিশ্লেষণ।

তাই এযুগে যারা  স্থানীয় সরকারের  বিভিন স্তরে তাড়াশের নেতৃত্ব দিলেন তাদের মানুষ মনে রাখবে নানা কারণে। তাদের মধ্যে কে বা কারা সমাজকে কি দিয়েছে তা মানুষ কখনই ভুলবে না। বেশী স্মরণে পড়বে তাড়াশ হতে মনোনয়নের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়ে ২০১৫ সালে গাজী ম.ম আমজাদ হোসেন মিলনের সংসদে  যাবার সৌভাগ্যের কথা। এটা ছিল গর্বের ও গৌরবের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এই সুযোগ লাভের সুবাদে তাড়াশের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটা বিরাট সম্ভাবনার সোনালী দ্বার খুলে গিয়েছিল। বিশেষ করে তাড়াশ এলাকাবাসী বিরাট আশায় বুক বেঁধেছিল, সুদূরের  স্বপ্ন দেখেছিল । সেটা  টিআর, কাবিটা, কাবিখা ধরণের  তুচ্ছ বরাদ্দ বা সাহায্য ভাগবাটোরা নয়। সেটা মূলত বড় কোন দান-অনুদানও নয়। বরং তাহল, আর্থিক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির উর্দ্ধে তাড়াশের নেতৃত্বের ত্যাগ দেখাবার একটা চমৎকার মাহেন্দ্রক্ষণ। লোভ-লালসা তথা নিজের আখের গোছানো বিসর্জন  দিয়ে নেতৃত্ব কতখানি জনসেবায় ,জনকল্যাণে ও গণ উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারেন – সেই ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়ার বিশাল চান্স। এর দু’টো দিক ছিল। প্রথমত জাতীয় নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রনায়ক এতে করে বুঝে যেতেন, অবহেলিত-বঞ্চিত তাড়াশ উপজেলায় যোগ্য এবং মানসম্পন্ন নেতৃত্ব আছে। টেকসই দক্ষ দূরদর্শী নেতৃত্ব তাড়াশের জন্য অপরিহার্য। ফলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এদিকটায় তাদের  শুভ নেক দৃষ্টি থাকতো ভবিষ্যতে। এটা তাড়াশের জন্য সুনাম ও সুখ্যাতির বিষয়।

দ্বিতীয় উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হল- এম সেরাজুল হকের পর এই প্রথম তাড়াশের মানুষ আশা করেছিল, ভিষন প্রতীক্ষায় ছিল ভিন্নমাত্রার নেতৃত্বের স্বাদ পাবার জন্য। কেননা, ইতিহাসের গোড়া থেকেই সংসদীয় আসনের প্রেক্ষাপটে এখানকার নেতৃত্বে ছিল পার্শ্ববর্তী উপজেলা। সেকারণে তাড়াশ বরাবরই বাইরের নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল থেকেছে, উমেদারী করতে হয়েছে। এবারই প্রথম সেই শৃংখল ভেঙে  এই স্বর্ণদুয়ার খুলে গিয়েছিল। ওদিকে আজো বাংলাদেশের বহু এলাকার মানুষ “তাড়াশ” নামের সাথে পরিচিত নন। তাই পার্লামেন্টে তাড়াশের মানুষের প্রকৃত সুখ দু:খ ,সমস্যা-সম্ভাবনা তুলে ধরার পাশাপাশি সাংসদের নিজস্ব প্রজ্ঞা , দক্ষতা ও প্রচেষ্টা দিয়ে এলাকার আর্থিক-সামাজিক, শিল্প-বাণিজ্য-শিক্ষা-স্বাস্থ্য,তথ্য-প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোগত তথা সার্বিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে একটি নজির সৃষ্টিকারী অনন্য ইতিহাস তৈরী করবেন- সেই প্রত্যাশায় ছিল গোটা তাড়াশবাসী। তার বীরত্বগাঁথা শুনে সবাই মুগ্ধ এবং আশান্বিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতি হবে এমন যে- “মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন”। অথচ আমরা দুঃখজনকভাবে বাস্তবে কী দেখতে পেলাম। পারস্পারিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব ক্রমশ অভ্যন্তরীণ দলীয়  ক্ষমতার লড়াইয়ে উপনীত হয়ে সংকীর্ণ আক্রমণ-প্রতি আক্রমণে রূপ নিয়ে এলাকার নেতৃত্বের মধ্যে শুরুতেই অনৈক্য, অসৌহার্দ্য ও সমন্বয়হীনতার ব্যাপক ব্যবধান সূচিত হল যার অপ্রীতিকর ছায়াপাত এখনো বিদ্যমান। যেখানে স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে জনগনের বৃহত্তর উন্নয়নের  দৃষ্টিকোনে পারস্পারিক সম্প্রীতি ,সমঝোতা ও ঐক্যমত থাকে না- সেখানে এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন-অগগ্রগতি উপেক্ষিত  তথা ব্যাহত হয়।

তাছাড়া সমাজের নানা স্তরে ক্ষমতাসীনদের দৌরাত্ম্য মানুষ ভাল চোখে নেয়নি। এলাকার রাস্তাঘাটের দীর্ঘকালীন দৈনদশাসহ নানা অনুন্নয়ন ও অব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের উদাসীনতা ও অযত্নশীলতার প্রতিফলন ঘটেছে। এসব দেখে মানুষ চুপে চুপে অথবা প্রকাশ্যে উপহাস করতে কৃপণতা করেনি। কোন বড় নেতৃত্বের নিকট মানুষ নীচতা ও অরুচিশীলতা প্রত্যাশা করে না। তা দেখলে তারা হতাশ হয়, আস্থা ও ভরসার  জায়গা হারায় নেতৃত্বের ওপর। বাড়ী-গাড়িসহ বিচিত্র সৌভাগ্য গড়ার ইতিকাহিনী মানুষ শুনলে আহত ও ব্যথিত হয়। আশাহত হয় দারুনভাবে। তারা নেতৃত্বকে ভোগ সম্ভারে  নিমজ্জিত হওয়া কখনো ইতিবাচক লক্ষণ মনে করেনি। জনগন এগুলো পচ্ছন্দ নয়  বরং ঘৃনা ও নিন্দা করে। পক্ষান্তরে তার আত্মত্যাগ-তিতিক্ষা, মানুষের জন্য তার বিলিয়ে দেবার উদার দৃষ্টি, লোভ সংবরণের মানবিক মহতী দৃষ্টান্ত, সর্বোপরি “পরের  কারণে স্বার্থ দিয়ে বলি, এ জীবনমন সকলি দাও”- সেটাই দেখবার আশায় উদগ্রীব  ছিল আপামর জনতা। আরো  আকাঙ্খা ছিল তাড়াশের সকল অতীত অখ্যাতি ও দূর্নাম তিরোহিত হয়ে উন্নত সমৃদ্ধ-সভ্য ও আধুনিক তাড়াশ বিনির্মিত হবে- এই ছিল গভীর একান্ত চাওয়া-পাওয়া। প্রবাদে আছে “ প্রতিটি সৌভাগ্যের পেছনেই পাপ লুকায়িত” থাকে।

অবশেষে বলতে হয়, দূর্ভাগ্য তাড়াশবাসীর, তারা একজন ত্যাগী ও নিবেদিত নেতৃত্ব আজো খুঁজে পেল না; যারা নিজেদেরকে কম ভোগ-উপভোগে লিপ্ত করে, ভারসাম্য নেতৃত্বের আদর্শ অনুসরণ করে জনগণকে তথা তাড়াশ উপজেলাবাসীর সার্বিক চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়নের রোল মডেল ধারায় অভিসিক্ত করবে। সবশেষে আবারো প্রতীক্ষায়  থাকার পালা যার শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। গত ৪৭ বছরেও তা অধরাই থেকে গেল তাড়াশবাসীর কাছে। এখন নতুন নৌকার মাঝির উদয় হতে যাচ্ছে পানিহীন, স্রােতহীন,নাব্যতাহীন তাড়াশের  বিষাদ সিন্ধুর মাঝে। পূর্বসূরীর ভুল ও বিচ্যুতি থেকে শিক্ষা নিয়ে এই নতুন সূর্য সারথী কী ত্যাগ, কী মহত্ত্ব, কী প্রগতিশীল নেতৃত্ব উপহার দিতে পারে যা হবে স্মরণীয়-বরণীয়,তৈরী করবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আশার আলো এবং  ব্যতিক্রমী নতুন ইতিহাস-  সেটাই এখন দেখার বিষয়। সেজন্য আবারো তাড়াশবাসীকে অপেক্ষা  করতে হবে আরো কত কাল তা কে জানে !

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD